করোনার পর কী হবে মোদি-ট্রাম্পের?

সুবীর ভৌমিক | Apr 27, 2020 08:59 pm
করোনার পর কী হবে মোদি-ট্রাম্পের?

করোনার পর কী হবে মোদি-ট্রাম্পের? - সংগৃহীত

 

ইন্টারন্যাশনাল বেস্টসেলার হোয়াই ন্যাশন্স ফেইল অ্যান্ড ডিরেক্টর-এর সহ-লেখক এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পারসন ইনস্টিটিউট ফর দি স্টাডি অ্যান্ড রেজুলেশন অব গ্লোবাল কনফ্লিক্টস-এর পরিচালক জেমস রবিনসন ‘কনফ্লিক্ট রেজুলেশন’বিষয়ক বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ। সাউথ এশিয়ান মনিটরের কলামনিস্ট সুবীর ভৌমিকের সাথে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাতকারে অধ্যাপক রবিনসন কোভিড-পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। বিভিন্ন দেশের গণস্বাস্থ্য উন্নতির জন্য কঠোর বিধিবিধান আরোপ করার ফলে সৃষ্ট আতঙ্কের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও ব্যক্তি স্বাধীনতার মধ্যে ভারসাম্য বিধানে তার অভিমত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

রবিনসনের সর্বশেষ গ্রন্থ দি ন্যারো করিডোর: স্টেটস, সোসাইটিজ অ্যান্ড ফেট অব লিবার্টিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে কেন কয়েকটি দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বিকশিত হলেও অনেক দেশ স্বৈরতন্ত্রের কাছে নতি স্বীকার করেছে। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে স্বাধীনতার করিডোরটি সংকীর্ণ এবং রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সংগ্রামের কারণেই তা কেবল উন্মুক্ত থাকে।
কোভিড মহামারি স্বৈরাচার ও সেইসাথে গণতন্ত্রী উভয়কেই অপব্যবহারের সুযোগ এনে দিয়েছে। এই সঙ্কটের সময় ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গোপনীয়তা খর্ব করার জন্য রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্প্রসারিত হচ্ছে।
এখানে সাক্ষাতকারটি প্রকাশ করা হলো

প্রশ্ন : অনেক বিশ্লেষক বলছেন যে করোনাভাইরাসের ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাতিন আমেরিকার অনেক দেশের সামরিক বাহিনীকে নিজেদেরকে আরো শক্তিশালী করার সুযোগ দেবে। কারণ এসব অনেক দেশ দীর্ঘ দিন সামরিক শাসনে ছিল এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও সামরিক বাহিনী এখনো রাজনৈতিক দলের চেয়ে শক্তিশালী রয়ে গেছে। আপনার ভাবনা কী?
রবিনসন : আমি মনে করি, এটা একটি উন্মুক্ত বিষয়। আমি মনে করি, এ ধরনের স্বাস্থ্য সঙ্কটে জনগণ নিরাপত্তা ও সিদ্ধান্তসূচক পদক্ষেপ কামনা করে। অবশ্য ভেনেজুয়েলা বা জিম্বাবুয়ের মতো অনেক দেশের সামরিক বাহিনী অর্থনীতি বা সরকারি পরিষেবা পরিচালনার মতো যোগ্য নয়। ফলে এই সঙ্কট তাদের আরো অযোগ্য করে ফুটিয়ে তুলবে, তাদের বিরুদ্ধে আরো অনেকে সরব হবে।

প্রশ্ন : এই মহামারি ও এটি সংযত করতে চীনের দৃশ্যমান ব্যর্থতার ফলে কি কমিউনিস্ট পার্টি ও এর বর্তমান নেতৃত্বের জন্য সমালোচনা বয়ে আনবে, চীনা জনগণের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আরো দুর্বল করবে? এটি কি দলের মধ্যে অন্তঃকলহ বাড়িয়ে দেবে? এটি কি ২১ শতকের মাও হতে তাড়াহুড়া করা শি জিনপিংকে চ্যালেঞ্জ করবে?
রবিনসন : এখন পর্যন্ত যেসব প্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে ড্রোন ও মোবাইল ফোন অ্যাপস ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ আরো জোরদার হচ্ছে। অন্তঃকলহ আছে, তবে তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও কমিউনিস্ট পার্টির আছে। চীনা মডেলে আমৃত্যু প্রেসিডেন্ট থাকার ধারণাটি আছে। বরং আমার মতে, দেং জিয়াওপিং ও তার ধ্যান-ধারণা বিচ্ছিন্ন কিছু। ফলে আমার ধারণা, প্রেসিডেন্ট শি দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকবেন।

প্রশ্ন : সজীব গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে লোকরঞ্জক নেতাদের ভবিষ্যত নিয়ে পরস্পরবিরোধী দুটি যুক্তি দেখা যাচ্ছে। অনেকে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প, ভারতের মোদি, ব্রাজিলের বলসানারো, হাঙ্গেরির অরবানরা নিন্দিত হবেন, মহামারি মোকাবিলায় তাদের অদক্ষতার ফলে তাদের প্রভাব হ্রাস পাবে। আবার অনেকে বলছে যে এসব নেতা এখন আরো বেশি ক্ষমতা পাবে, তারা তাদের স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা ব্যবহার করবে তাদের দেশে দীর্ঘ দিনের প্রয়াসের ফলে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আপস করতে বাধ্য করার কাজে। আপনার বক্তব্য কী?
রবিনসন : আমি মনে করি, স্থানভেদে জবাবও হবে ভিন্ন। ভারতের কথাই ধরুন। এখানে বর্ণের ভিত্তিতে সামাজিক দূরত্ব রয়েছে। আমি মনে করি, ভারত আসলেই ভাইরাসটি দমন করার জন্য ভালো কাজ করছে। কারণ এই সমাজ তা করতে সঙ্ঘবদ্ধ। মোদি ভালো করবেন। কিন্তু ব্রাজিলের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমার মনে হয়, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট অযোগ্য ও অপ্রস্তুত। ট্রাম্প আরো ক্ষমতা চাইতে পারেন। কিন্তু আমরা আসলে যা দেখছি তা হলো ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণে না থাকা রাজ্য ও রাজ্য গভর্নরেরা ভালো কাজ করছেন, ট্রাম্প এজন্য কৃতিত্ব পাচ্ছেন না। ট্রাম্প আরো স্বৈরাচারী হয়ে যান কিনা তা নিয়ে আমার সংশয় রয়েছে। মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষার দায়িত্ব ওই দেশের জনগণেরই।

প্রশ্ন : আপনার দ্বিতীয় বিকল্পটি যদি সত্য হয়, তবে কি কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে চীন কি তার স্বৈরতান্ত্রিক মডেল আরো কার্যকরভাবে বিক্রি করতে পারবে?
রবিনসন : আমার সন্দেহ আছে। কোনো চীনা মডেল আছে বলে আমার মনে হয় না বা অন্তত হস্তান্তর করার মতো কিছু আছে বলে মনে হয় না। চীনের সফলতার মূলে রয়েছে চীনা সমাজের বিশেষ কিছু বিষয়। যেমন ধরা যাক মেধাতন্ত্র। এটি বিশ্বে প্রায় বিরল। চীন যখন প্রাক-আধুনিক দেশ ছিল, তখনো তারা পরীক্ষার মাধ্যমে এলিট শ্রেণী গঠন করত। আপনি এটা ভারতে কিভাবে হস্তান্তর করবেন, ভারতে তো এটি ভিন্নভাবে কাজ করে।

প্রশ্ন : কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে কি সামরিক বাজেট হ্রাস পেযে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বাজেট বাড়বে বলে মনে করেন?
রবিনসন : মনে হয় না। আর যুক্তরাষ্ট্রও তার অর্থনৈতিক আধিপত্য হারাবে না। এই দেশটি এখনো প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে বিপুলভাবে এগিয়ে আছে। তারা সোনার হরিণ ধরতে গিয়ে ইরাক আর আফনিস্তানে অনেক অর্থ ব্যয় করেছে। কিন্তু তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না। আর প্রতিরক্ষা বাজেট হ্রাস না পেয়ে বরং বাড়বে।

প্রশ্ন : বিশ্ব অর্থনীতি কেমন হবে বলে মনে করছেন? মহামারির ফলে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের সূচনা হবে কি? নাকি এটি তার আধিপত্য সৃষ্টির প্রয়াসটিই ভণ্ডুল করে দেবে?
রবিনসন : চীনের অবস্থান সৃষ্টিতে মহামারিটির কোনো ভূমিকা আছে বলে মনে করি না। চীন মনে হয় না তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারবে। চীনের ইতিহাসের দিকে নজর দিন। শি যে মাত্রায় ক্ষমতা ধারণ করে আছেন, তাতে করে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে তা শেষ হওয়াই স্বাভাবিক। মহামারিটির ফলে বড় ধরনের পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।

প্রশ্ন : বিশ্ব অর্থনীতি কি আরো ডিজিটাল হবে? আমরা কি করোনার পর আরো কম ক্লাবে যাওয়া, সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া, কম পার্টি করা, পরিবারকে বেশি সময় দেয়া, বাড়িতে বসে অফিস করার দিকে যাব? আমাদের জীবনে এটি কেমন প্রভাব ফেলবে?
রবিনসন : খুবই ভালো প্রশ্ন। আমার মনে হয়, সবচেয়ে বড় সামাজিক হবে বৈষম্য নিয়ে। অত্যন্ত দক্ষ ও শিক্ষিত লোকজন সীমাহীনভাবে বাড়িতে থেকে অফিস করবে। আর কম দক্ষ লোকজনকে কাজের জন্য বাইরে যেতে হবে। তারাই রোগের মুখে পড়বে বেশি করে। এটি বৈষম্যের দুঃস্বপ্ন।

প্রশ্ন : ধর্মের ওপর এর প্রভাব কী হবে? লোকজন কি আরো বেশি ধর্মপ্রবণ হবে না বিজ্ঞানমনস্ক হবে বেশি? ভারতে হিন্দু রাজনীতিবিদেরা বিজ্ঞানের লেশমাত্র ছাড়াই বলেন যে প্রাচীন ভারতে ইন্টারনেট ছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হাতির মাথাওয়ালা গণেশের মূর্তিকে প্লাস্টিক সার্জারির উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন। আবার যারা বলেছিল, গরুর মূত্র পান করলে করোনা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, তাদের অনেকে এখন হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করাচ্ছে। বিষয়টি কিভাবে নিচ্ছেন আপনি?
রবিনসন : আরেকটি গভীর প্রশ্ন। আমার জবাব হবে অনুমানভিত্তিক। তবে মানুষ অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস করে। এটিই অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষের প্রধান পার্থক্য। আবার বিজ্ঞান কিন্তু বলতে পারে না যে কে অসুস্থ হবে, কে মারা যাবে, কে বেঁচে থাকবে। ফলে আমার মনে হয় এ ধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ধর্মের ওপর বিশ্বাস আরো বাড়বে। কারণ, লোকজন যুক্তিহীন মনে হওয়া বিষয়গুলোতে যুক্তি চায়।

প্রশ্ন : শেষ প্রশ্ন... মহামারিটি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর কী প্র্রভাব ফেলবে?
রবিনসন : আমি মনে করি বিপরীত প্রভাবই ফেলবে। যারা জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকার করে আসছিল, তারা এখন একথা বলতে পারবে যে বিষয়টি খুবই অস্পষ্ট। তারা বলবে, আমাদের বরং ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগে থাকা উচিত।... এর ফলে পুরো আলোচনাই এক প্রজন্ম পেছনে চলে যাবে।
(সাক্ষাতকারটি ব্যবস্থা করেছিলেন জিনেত্তি ও’কনর, আর তা হয়েছিল ই-মেইলে।)


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us