ইসরাইল কিভাবে এত অস্ত্র বিক্রি করছে
ইসরাইল কিভাবে এত অস্ত্র বিক্রি করছে - সংগৃহীত
অস্ত্র, যুদ্ধ এবং লোকক্ষয়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক হিসাব-নিকাশে যাওয়ার জন্য বিস্তারিত অ্যালগরিদম বা পর্যায় পরম্পরার প্রয়োজন হয় না। কারণ, কার্যক্ষেত্রেই এর বহু প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায়। মধ্যপ্রাচ্যের লিবিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, ফিলিস্তিন, সিরিয়া ও দক্ষিণ সুদানের দ্বন্দ্বের মূল কেন্দ্র বা এপিসেন্টারে রয়েছে সিরিয়া। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, সেরা পাঁচটি ‘মার্চেন্টস অব ডেথ’ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি ও চীন। মজার ব্যাপার হলো, বিগত পাঁচ বছরে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র রফতানি দ্রুত থেকে দ্রুততর গতি নিয়ে বেড়েছে ৭৬ শতাংশ, সেখানে রাশিয়ার অস্ত্র রফতানি কমে গেছে ১৮ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রবাজার ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। অন্য দিকে রাশিয়া তার প্রধান অস্ত্র আমদানিকারক দেশ ভারতকে হারিয়েছে। দিল্লির কাছে মস্কোর চেয়ে তেলআবিব এখন অধিকতর সমমনা অস্ত্র সরবরাহকারী।
২০১৭ সালে ভারতের সাথে ইসরাইল ২০০ কোটি ডলারের অস্ত্রচুক্তি করার পর ভারতে এর অস্ত্র রফতানি রেকর্ড পরিমাণ ৯০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। ভারতের সাথে এই ২০০ কোটি ডলারের চুক্তিটিকে বিবেচনা করা হয় ‘ইসরাইলি এয়ারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ’-এর একক বৃহত্তম অস্ত্রচুক্তি হিসেবে। ভারত যখন ইসরাইলি অস্ত্রের বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ হয়ে উঠছে, তখন ভারত-পাকিস্তানের দীর্ঘসূত্রী দ্বন্দ্বে ইসরাইল হয়ে দাঁড়িয়েছে এক মাধ্যমিক পক্ষ। পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই দেশ ২০১৯ সালের মার্চের দিকে পুরোদস্তুর যুদ্ধের একদম কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছিল। স্বাভাবিকভাইে এই দেশ দু’টির মধ্যে ভবিষ্যতে যদি কোনো কারণে যুদ্ধ লেগেই যায়, তখন প্রধানত ইসরাইলি অত্যাধুনিক অস্ত্র ভারত ব্যবহার করবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি প্রকাশিত সামরিক তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার পর দ্বিতীয় দেশ হচ্ছে ইসরাইল, যে দেশ অস্ত্র রফতানি সবচেয়ে বেশি হারে সম্প্রসারণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। কারণ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইলের অস্ত্র উৎপাদন অভাবনীয় মাত্রায় বেড়েছে। এসআইপিআরআইয়ের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইলের অস্ত্র উৎপাদন ৭৬ শতাংশ বেড়েছে। গত বছর ইসরাইলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘ইন্টারন্যাশনাল ডিফেন্স কো-অপারশন ডিরেক্টরেট’ যুক্তরাষ্ট্র, ফিনল্যান্ড ও ভারতের ওপর বিশেষ আলোকপাত করে ইসরাইলের অস্ত্রবাজার সম্প্রসারণের ব্যাপক পরিকল্পনা প্রকাশ করে। এই ডিরেক্টরেট ইসরাইলের অস্ত্র উৎপাদন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রফতানি-সংক্রান্ত ব্যাপারটি দেখাশোনা করে।
প্রশ্ন হচ্ছে, অন্যান্য দেশের তুলনায় ইসরাইলি অস্ত্রশস্ত্র কেন অধিকতর আকর্ষণীয় হয়ে উঠল? এর কারণ, ইসরাইলি অস্ত্র কেনার সাথে কোনো পলিটিক্যাল প্রাইস ট্যাগ থাকে না, অন্য কথায় কোনো রাজনৈতিক শর্ত জুড়ে দেয়া হয় না। এর অর্থ হচ্ছে- ইসরাইল শর্তহীনভাবে যেকোনো দেশে অস্ত্র বিক্রি করতে প্রস্তুত, এমনকি রাষ্ট্রীয় মর্যাদাহীন পক্ষের কাছেও খোলাখুলি কিংবা গোপনে অস্ত্র বিক্রি করতেও দেশটির কোনো আপত্তি নেই। এই অস্ত্র কিনে কারা, কোথায় ব্যবহার করল, তা সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার হলো কি না, তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলো কি না, সেসব ব্যাপারে ইসরাইলের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের একমাত্র কথা; ‘ডলার দাও, অস্ত্র নাও’।
২০১৯ সালের মে মাসে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’এর ইসরাইলি শাখা একটি ইন-ডেপথ রিপোর্ট প্রকাশ করে।
এই রিপোর্টে ইসরাইলের অস্ত্র রফতানি বাজার পর্যালোচনা করা হয়। রিপোর্টে বলা হয়, ‘ইসরাইলি ডিফেন্স এক্সপোর্ট কন্ট্রোলস এজেন্সি’র প্রধান র্যাশেল চেনের দাবি হচ্ছে, ‘we will carefully examine the state of human rights in each country before approving export licenses for selling them weapons’’. কিন্তু, এ এক নির্লজ্জ মিথ্যাচার। কারণ, ইসরাইল অস্ত্র ফেরি করে বেড়ায় বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের কাছে। এদের তালিকায় আছে মিয়ানমার, ফিলিপাইন, দক্ষিণ সুদান ও শ্রীলঙ্কা।
র্যাশেল চেনের এই বক্তব্য যে সর্বৈব মিথ্যা তার প্রমাণ হচ্ছে ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে ইসরাইল সফরের সময়ে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতার্তের দেয়া বক্তব্য। তখন ইসরাইলি প্রেসিডেন্ট রিউভেন রিভলিনকে দুতার্তে বলেছিলেন, ‘কোনো ‘রেস্ট্রিকশন’ না থাকার কারণে এখন থেকে ফিলিপাইন শুধু ইসরাইল থেকেই অস্ত্র কিনবে’। এই খবর প্রকাশিত হয়েছিল ‘টাইমস অব ইসরাল’-এ। দুতার্তে আরো বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ভালো বন্ধু, তবে জার্মানি ও চীনের মতো যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র আনতে হয় নানা সীমাবদ্ধতার মাঝে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে ৩০০ কোটি ডলারের অস্ত্র দেয় শুধু এই বিবেচনায় যে, এগুলো অবাধে ব্যবহার হবে শুধু দখল করা ফিলিস্তিনের ফিলিস্তিনি ও অন্যান্য আরবজাতির বিরুদ্ধে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন যা-ই থাকুক না কেন।’ দুতার্তের এই বক্তব্যকে বিস্ময়করই বলতে হবে।
একটি দেশ যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত ও চরম দারিদ্র্যের শিকার দক্ষিণ সুদানে অস্ত্র পাঠায়, তখন সে দেশটির সামান্যতম নৈতিক মান আছে বলে ধরে নেয়া যায় না। ইসরাইলের অস্ত্র রফতানি ও তথাকথিত বাকি দুনিয়ার ‘সিকিউরিটি টেকনোলজির অনন্য একটি দিক হচ্ছে, এগুলো সেখানেই প্রয়োগ করা হয়; যেখানকার মানুষ সবচেয়ে নিপীড়িত ও ভঙ্গুর।
উদাহরণ টেনে বলা যায়, বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি সরকারের ‘আনডকুমেন্টেড ইমিগ্র্যান্ট’-বিরোধী যুদ্ধে ইসরাইলি কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের পাশে সামনের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। অধিকন্তু, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইলের বর্বর সামরিক কৌশলগুলো ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে মার্কিন সমাজের স্তরে স্তরে। এর মধ্যে রয়েছে মার্কিন পুলিশ বাহিনীর সামরিকায়ন। হাজার হাজার আমেরিকান পুলিশ প্রশিক্ষণ নিয়েছে ইসরাইলে।
একইভাবে, ২০১৮ সালে ইসরাইলি ‘যুদ্ধপ্রযুক্তি’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সিকিউরিটি অ্যাপারেটাসে। ছয় কোটি ৮০ লাখ ডলারের এ ধরনের একটি চুক্তি হয়েছে ইসরাইলি কোম্পানি ‘এলবিট’-এর সাথে। এই চুক্তির আওতায় ইউরোপীয় ইউনিয়নকে দেয়া হবে মানববিহীন এয়ারক্র্যাফট সিস্টেম সার্ভিস। এতে ব্যবহার করা হয় ‘হারমিস ৯০০ ম্যারিটাইম পেট্রোল সিস্টেম’।
এ ব্যবস্থায় ইউরোপিয়ান বর্ডার অ্যান্ড কোস্ট গার্ড এজেন্সি ‘ফরটেক্স’ সুযোগ পাবে যুদ্ধকালীন শরণার্থী এবং ইউরাপীয় ভূখণ্ডে প্রবেশে ইচ্ছুক অভিবাসীদের প্রতিহত করতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইইউ ইসরাইলের কাছ থেকে সেসব মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র কিনছে, যা ইসরাইলি সেনারা ২০১৪ সালে গাজা উপত্যকায় তথাকথিত প্রটেক্টিভ ওয়্যারের সময় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল।
এসআইপিআরআই এবং অ্যামনেস্টি ইনটারন্যাশনাল যথার্থই বলেছে, ইসরাইলের রফতানি করা অস্ত্রের বেশির ভাগই চলে যাচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের হাতে। তবে মনে রাখতে হবে- ইসরাইল হচ্ছে একটি দুষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী দেশ। আর ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে করা অপরাধের জন্য দেশটিকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এই দায়িত্ব বিশ্ববাসীর। আর তা করতে হলে বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর সবার আগে এক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।