যে কারণে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন জাপানের অভিজাত পরিবারের এই নারী
প্রতীকী ছবি - সংগৃহীত
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের রহস্যময় হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বহু প্রচারমাধ্যম ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারণা শুরু করে তখন ইসলাম ধর্মের প্রকৃত চিত্র সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন জাপানি তরুণী ‘অতসুকু হুশিনু’। ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা ও জানা-শোনার পর অবশেষে তিনি এই ধর্মের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
‘অতসুকু হুশিনু’ ইন্টারনেটে অনুসন্ধান চালিয়ে সংগ্রহ করেন পবিত্র কুরআন। পবিত্র কুরআনের পরিপূর্ণতা ও সার্বজনীনতা অভিভূত করে অতসুকু হুশিনু-কে। আর এ জন্যই তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সবার থেকে দূরে থেকে ইন্টারনেট থেকে পবিত্র কুরআন পড়তেন তিনি যাতে এ মহাগ্রন্থের বাণীগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারেন।
অতসুকু অত্যন্ত কোমল ও দয়ার্দ্র মনের মানুষ। তিনি পড়াশুনা করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে। বর্তমানে অতসুকু ইরানে রয়েছেন এবং তিনি ইসলাম ও বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদের (সা.) পবিত্র আহলে বাইত সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা অর্জনের চেষ্টা করছেন।
ইসলামের প্রতি ঈমান আনার ঘটনা তুলে ধরতে গিয়ে জাপানি তরুণী অতসুকু জানিয়েছেন, ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার দৃশ্য বার বার দেখার পর প্রথম দিকে তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হন। এরপর তার কাছে মনে হয়েছে এই ঘটনার সঙ্গে হলিউডের ছায়াছবিগুলোর বেশ মিল রয়েছে এবং ঘটনাটি এমন রহস্যময় যে এর পেছনে বা নেপথ্যে অনেক চালিকাশক্তি কাজ করছে। এই ঘটনার সঙ্গে ইসলাম ও মুসলমানদের জড়িয়ে অনেক নেতিবাচক কথা প্রচার করা হয়। আর সেইসব প্রচারণায় প্রভাবিত না হয়ে বরং এ ধর্ম সম্পর্কে সত্যিকারের চিত্র জানতে আগ্রহী হন অতসুকু। এরপর অনুসন্ধান চালিয়ে দেখতে পান যে ইসলামই হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে মহৎ ও বড় ধর্ম।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে অতসুকু বলেছেন : 'আমি বড় হয়েছি এক বৌদ্ধ পরিবারে। বৌদ্ধরা নিজ ধর্ম বিষয়ে খুবই রক্ষণশীল। আমার এক চাচা জাপানি সংসদে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিনিধি ছিলেন। তাই এ ধর্ম সম্পর্কে আমার গভীর জানাশোনা ছিল। আমার আরেক চাচা ছিলেন পুরোহিত। তিনি খ্রিস্টানদের বাইবেলও পড়েছেন। ফলে খ্রিস্ট ধর্মের সঙ্গেও আমি পুরোপুরি পরিচিত ছিলাম। আমার মনে কোনো কোনো বিষয়ে কিছু প্রশ্ন জাগতো, কিন্তু কেউই সেইসব প্রশ্নের জবাব দিতে সক্ষম হননি। কিন্তু ইসলামের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর আমার জীবনের রঙ ও ঘ্রাণ বদলে যায়। মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কুরআন প্রথমবারের মতো পড়েই মনে হয়েছে যে, সত্যিই তা আসমানি বা ঐশী কিতাব এবং অন্য ধর্মগ্রন্থগুলোর সঙ্গে এর রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তাই বুঝলাম যে ইসলামই প্রকৃত খোদায়ী ধর্ম। পবিত্র কুরআন আমার মনের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে এবং দূর করেছে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। ফলে ইসলামের দিকে আরো গভীরভাবে ঝুঁকে পড়ি এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেই।'
নিজের ওপর পবিত্র কুরআনের অমূল্য ও অতুলনীয় বাণীর প্রভাব প্রসঙ্গে জাপানি নওমুসলিম অতসুকু বলেছেন: 'আমি যা কিছু পেয়েছি তা এই কুরআন থেকেই পেয়েছি। কুরআনই আমাকে চিনিয়েছে ধর্মের বাস্তবতা ও এর ফলে আমি মুসলমান হয়েছি। এ মহাগ্রন্থ আমাকে দিয়েছে প্রশান্তি এবং কুরআনের নির্দেশনা পেয়েই আমি কঠোর পরিস্থিতিতেও ধৈর্য ধরেছি ও হিজরত করেছি নিজ দেশ থেকে এমন এক দেশে যে দেশ আর তার জনগণ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। এই দেশে আমি ছিলাম আগন্তুক বা প্রবাসী; কিন্তু কুরআনের কারণেই আমি এখানে নিঃসঙ্গতা অনুভব করিনি। কুরআন সব সময়ই আমার জন্য আলো ও মুক্তির উৎস। এ মহাগ্রন্থ আমাকে ভয় ও নিঃসঙ্গতার শিকার হতে দেয়নি। যে কেউ কুরআন পড়লে অবশ্যই সুপথ বা মুক্তির দিশা পাবেন। আমি আমার সমগ্র অস্তিত্বের মধ্যে এই মহাসত্যটি অনুভব করছি। কঠিন অবস্থার মধ্যে আমি যখন বিশ্বনবীর (সা.) পবিত্র আহলে বাইতের দোয়াগুলো পাঠ করতাম তখন মনে হত যেন স্বয়ং মহানবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইত যেন আমাকে শিক্ষা দিচ্ছেন। তাই যতই আহলে বাইতের সঙ্গে সম্পর্কিত দোয়া ও জিয়ারত পাঠ করি ততই তাঁদের প্রতি এবং তাঁদের জীবনাদর্শ সম্পর্কে আমার ভালবাসা বাড়তেই থাকে ও তাঁদের মাধ্যমে বাড়তে থাকে খোদাপ্রেম।'
জাপানি নওমুসলিম অতসুকু মহানবীর (সা.) পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য নবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা জাহরা সালামুল্লাহি আলাইহাকে গভীরভাবে ভালবাসেন। আর তাই মুসলমান হওয়ার পর নিজের নাম হিসেবেও বেছে নিয়েছেন জ্যোতির্ময় ও পবিত্র এই নাম। তিনি হযরত ফাতিমা (সা.আ.)'র জীবনী ও বাণী অধ্যয়ন করে নিজেকে তাঁরই আদর্শের অনুসারী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন।
অতসুকু তার স্বামীর সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আগে ইন্টারনেটে হযরত ফাতিমা (সা.আ.)'র জীবনী সম্পর্কে জেনেছেন। বিশ্বের সর্বকালের সেরা এই নারীর জীবনাদর্শ তাকে এতটা অভিভূত করেছে যে তিনি নিজেকে তাঁরই অনুসারী হিসেবে গড়ে তুলতে আগ্রহী হন। এই মহিয়সী নারী হযরত আলী (আ.)'র সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন অতি সামান্য মোহরানা নিয়ে, আর কনের জন্য নির্ধারিত সেই পুরস্কার বা মোহরানাও সংগ্রহ করা হয়েছিল আলী (আ.)'র বর্ম বিক্রি করার মাধ্যমে। -এ ঘটনাও জাপানি নওমুসলিম অতসুকুকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ফলে তিনিও নিজের জন্য একই ধরনের পরিস্থিতি কামনা করেছেন মহান আল্লাহর কাছে যাতে নবী-নন্দিনীর মতই আচরণ করতে পারেন।
এরপর অতসুকু বিয়ের মোহরানা হিসেবে স্বামীর কাছে কেবল একটি স্বর্ণমুদ্রা দাবি করেন এবং তা দিয়েই নতুন সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় বা জরুরি জিনিসগুলো কেনেন। এত কম পরিমাণ মোহরানা নেয়ার জন্য তিনি মোটেই অনুশোচনা করছেন না, বরং দাম্পত্য জীবন শুরু করার ক্ষেত্রে ইমামগণের মাতা ও আলী (আ.)'র স্ত্রী হযরত ফাতিমা জাহরার (সা.) আদর্শ অনুসরণ করতে পেরে গভীর আধ্যাত্মিক তৃপ্তি অনুভব করছেন। তার মতে মাত্র এই একটি স্বর্ণমুদ্রা তার জীবনে এনেছে অনেক বরকত বা প্রাচুর্য। আর এ জন্য তথা ফাতিমা জাহরার (সা.) আদর্শ অনুসরণের সুবাদে এতো বরকত পেয়ে অতসুকু মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ।
অতসুকুর পরিবার তার মুসলমান হওয়ার প্রবল বিরোধিতা করেছিল। বিষয়টা তাদের কাছে ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত। প্রথমে তারা বিষয়টিকে বিশ্বাসই করেননি। পরে দেখলেন যে তাদের মেয়ে নিজেকে অনেক কিছু থেকেই দূরে রাখছে, বিশেষ করে তারা যখন দেখলেন যে অতসুকু হারাম গোশত খাচ্ছেন না তখন তারা বিরোধিতা জোরদার করেন।
এবার তারা অতসুকু'র ওপর অর্থনৈতিক ও মানসিক চাপসহ নানা ধরনের চাপ দিতে থাকে ও তাকে হয়রানি করতে থাকে যাতে সে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে। অতসুকু'র সমস্ত বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাই তাকে ত্যাগ করেন। ফলে পরিবার ও নিজ শহরে নিঃসঙ্গ ও কোণঠাসা হন অতসুকু। অত্যন্ত কঠিন সেই দিনগুলোতে ইন্টারনেটে পবিত্র কুরআনই ছিল তার একমাত্র সঙ্গী যে তাকে যোগাতো প্রশান্তি ও সহায়তা। কুরআনের সহায়তার কারণেই তিনি সে সময় নিজ ঈমানের ওপর অবিচল থাকতে পেরেছেন। নানা ধরনের চাপ অতসুকু'র ঈমানকে বরং আরো মজবুত করে দেয়। ফলে চাপ ও হয়রানি বাড়তেই থাকে। কিন্তু প্রশান্ত হৃদয়ে সব সহ্য করে যান তিনি। এ সময় অতসুকু পবিত্র কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী কেবল আল্লাহর ওপরই ভরসা করতেন ও আশার আলো দেখতেন।
অতসুকু হুশিনু থেকে ফাতিমা হুশিনুতে পরিণত হওয়া জাপানি নারী ইসলাম সম্পর্কে ভালোভাবে জানার জন্য ইরানে আসেন। কোনো একটি ইসলামী দেশে জীবন যাপন করা ছিল হুশিনুর বহু বছরের স্বপ্ন। তার সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার ফলে একটি অমুসলিম দেশে মুসলমানিত্ব বজায় রাখার কঠোরতা থেকে মুক্তি পান তিনি।