ক্ষুধার যন্ত্রণায় প্রবাসীরা
দেশে দেশে ক্ষুধার যন্ত্রণায় প্রবাসীরা - সংগৃহীত
সৌদি আরবে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ২২ লক্ষাধিক প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিক থাকলেও দেশটিতে ত্রাণের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র ৮০ লাখ টাকা। যা একেবারেই নগণ্য বলে মনে করছেন প্রবাসে থাকা বাংলাদেশী ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। দেশটির রিয়াদ, দাম্মাম ও জেদ্দার বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাতে কাটাতে হাফিয়ে উঠছেন। অভিযোগ রয়েছে, অনেক কর্মীর জমানো টাকা ফুরিয়ে যাওয়ায় এখন ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করছেন। কারো কারো ভাগ্য জুটছে এক বেলা খাবার। এরপরও অনেকের ভাগ্য জুটেনি ত্রাণের চাল ডাল তেল সাবান।
শুধু সৌদি আরব নয়; একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ ধনী দেশ কাতার, আবুধাবি, কুয়েত, বাহরাইন ও ওমানে অবস্থানরত হাজার হাজার বাংলাদেশীর দিন কাটছে চরম খাবারের কষ্টে। তাদের অনেকেই দেশগুলোর লকডাউন আইন মেনে ঘরে থাকার কারণে বের হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। নেই কোনো কাজও।
তবে বৈধভাবে যেসব শ্রমিক গিয়ে কাজকর্ম শুরু করেছিলেন তারা এখন মোটামুটি লকডাউনের মধ্যেও কম খেয়ে হলেও দিন কাটাচ্ছেন। তবে সেটাও অনিশ্চিত। অপর দিকে যারা লাখ লাখ টাকা খরচ করে বৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার পরও কাজ ও চলাফেরার জন্য আকামা করতে ব্যর্থ হয়েছেন, তারা এখন অবৈধভাবে পালিয়ে কোনোভাবে একটি ঘরের মধ্যে গাদাগাদি করে দিন পার করছে। এখন তাদেরই হয়েছে মরনদশা। এই সংখ্যাও লাখ লাখ হবে বলে প্রবাসীরা মনে করছেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছাড়াও আসিয়ানভুক্ত দেশ মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, মালদ্বীপ, কম্বোডিয়াসহ অন্যান্য দেশে থাকা প্রবাসীদের এই মুহূর্তে দিন কাটছে চরম বিপদের মধ্যে। আগামী দিনগুলো কিভাবে পার করবেন এই দুশ্চিন্তায় অনেকের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এসবের পরও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া ত্রাণ বিতরণ নিয়েও রয়েছে কোনো কোনো দেশের দূতাবাসের বিরুদ্ধে নয়-ছয়ের অভিযোগ। এর মধ্যে সৌদি আরবের জেদ্দা ও কুয়েতে ত্রাণ বিতরণে বেশি অনিয়ম হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
রিয়াদের আল কাশিম ডিস্ট্রিক এলাকার সিটি করপোরেশনের চাকরি করছেন পুরান ঢাকার নিমতলীর বাসিন্দা শান মোহাম্মদ শানু। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যে কেমন আছেন জানতে চাইলে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে নয়া দিগন্তকে তিনি বলেন, আলহামদুল্লিলাহ এখন পর্যন্ত ভালোই আছি। আমার চাকরি তো সরকারি, তাই আমি প্রতিদিন শিফট করে করোনার মধ্যেও ডিউটি করছি। বেতনও পাচ্ছি। তবে সৌদি আরবে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের অবস্থা খুবই খারাপ। আপনার এলাকায় অন্যান্য বাংলাদেশীরা কেমন আছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশির ভাগ লোকই তো অবৈধ হয়ে এখন ঘরের মধ্যে ঢুকে আছে। তাদের কাজও নাই টাকাও নাই। মাসের পর মাস কাজ করলেও তারা ঠিকমতো বেতন পান না। কারণ তাদের আকামা নাই। তাদের অনেকেই ঘরে থেকেই এখন খাবারের জন্য কান্নাকাটি করছেন। ধারকর্য করে তিন বেলার খাবার এক বেলা খেয়ে কোনোমতে দিন কাটাচ্ছে। বিদেশে কার খবর কে রাখে ? বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সৌদি আরবের রিয়াদ, জেদ্দাসহ অন্যান্য প্রদেশে ত্রাণ হিসাবে কর্মীদের চাল ডাল চিনিসহ অন্যান্য পণ্য দেয়া শুরু হয়েছে। আপনি কি এসব ত্রাণ পেয়েছেন অথবা যারা অসহায় অবস্থায় গৃহবন্দী হয়ে আছেন তাদের কেউ কি পেয়েছেন? এমন প্রশ্নের উত্তর শুনে তিনি প্রথমে অবাক হন। বলেন কিসের ত্রাণ। এই প্রথম শুনলাম। আমার জানা মতে এখানে যারা নীলফামারী, ফরিদপুর, ফেনীসহ বেশকিছু জেলার বাংলাদেশী অবৈধ আছেন। তাদের সাথে আমার প্রতিদিন কথা হচ্ছে। তারা কেউই ত্রাণের কোনো খাদ্য এখনো পাননি। কিভাবে এবং কোথা থেকে কারা দিচ্ছে তাও তো আমরা জানি না।
শুক্রবার দিবাগত রাতে কুয়েত থেকে এক শ্রমিক নাম না প্রকাশের শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, কুয়েতে বাংলাদেশ সরকার যে ত্রাণের টাকা দিয়েছে সেটি দিয়ে ৩ হাজার ৫০০ জনকে ত্রাণ দেয়ার তালিকা তৈরি হয়েছে। প্রত্যেক কর্মীর জন্য সাড়ে ৭ দিনারের পণ্য দেয়া হচ্ছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি দাবি করে বলেন, যাদের ত্রাণ দেয়ার তালিকা তৈরি করা হয়েছে সেগুলো দূতাবাস আর কমিউনিটির নেতারা মিলে দলীয় লোকদের দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে দলীয় পর্যায়ের অনেক নেতার কর্মীরা ত্রাণ না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে জেদ্দার কনসাল জেনারেল অফিসের জন্য ৪০ লাখ টাকা আর রিয়াদ দূতাবাসের জন্য ৪০ লাখ টাকার ত্রাণ বিতরণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। গতকাল জেদ্দা থেকে একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, যে ৪০ লাখ টাকা জেদ্দার প্রবাসীদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তার মধ্যে প্রত্যেকের জন্য ৭০ রিয়ালের পণ্য দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরমধ্যে অবৈধ যেসব শ্রমিক আছে তারাও পাবেন। সেই হিসাবে জেদ্দায় আড়াই হাজার অসহায় প্রবাসীকে ত্রাণের চাল, ডাল, সাবানসহ পণ্য দেয়ার প্যাকেজ করা হয়েছে। কিন্তু জেদ্দায় রয়েছে কয়েক লাখ প্রবাসী। জেদ্দা বাংলাদেশ কমিউনিটি সূত্রে জানা গেছে, জেদ্দার শ্রম কাউন্সেলর আমিনুল ইসলাম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কারণে ত্রাণ বিতরণেও সমস্যা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দূতাবাস/হাইকমিশনের চাহিদার ভিত্তিতে মোট ২৪ দেশে ত্রাণের টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে লেবাননে ১৭ লাখ টাকা, ফ্রান্সে ২০ লাখ টাকা, রিয়াদে ৪০ লাখ টাকা, কুয়েতে ২৫ লাখ টাকা, মালয়েশিয়ায় ৪০ লাখ টাকা, লিবিয়ায় ১০ লাখ টাকা, হংকংয়ে ১০ লাখ টাকা, জেদ্দায় ৪০ লাখ টাকা, মালদ্বীপে ১৫ লাখ টাকা, মিলানে ১০ লাখ টাকা, ব্রুনাইয়ে ২৫ লাখ টাকা, বাহরাইনে ২০ লাখ টাকা, দুবাইয়ে ২০ লাখ টাকা, জর্ডানে ৩০ লাখ টাকা, গ্রিসে ২০ লাখ টাকা, কাতারে ৫ লাখ টাকা, ওমানে ২০ লাখ টাকা, ইরাকে ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা, রোমে ২৫ লাখ টাকা, আবুধাবিতে ২০ লাখ টাকা, থাইল্যান্ডে ৮ লাখ, পর্তুগালে ১০ লাখ, সিঙ্গাপুরে ৩০ লাখ ও স্পেনে ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে আরো ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার কথা জানান প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে তিনি বলেছেন, প্রবাসীদের সুরক্ষায় সরকারের সবধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে।