ট্রাম্পের আজব চিকিৎসাপদ্ধতি : করোনা সারার সম্ভাবনা কতটুকু?
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প - সংগৃহীত
ম্যালেরিয়ার ওষুধ ক্লোরোকুইনিন প্রয়োগ নিয়ে মাতামাতির পর কোভিড-১৯-এর চিকিৎসায় নতুন প্রেসক্রিপশন নিয়ে হাজির হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জীবাণুনাশকের ইঞ্জেকশন দিয়ে করোনাভাইরাস ধ্বংস করা যায় কি না - তা নিয়ে গবেষণা শুরুর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। একইসাথে, কোভিড-১৯ রোগীর শরীরে (ইউভি) বা অতি-বেগুনি আলোকরশ্মির তাপ দিয়ে করোনাভাইরাস মেরে ফেলা যায় কিনা - সেটাও খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এসব পরামর্শের কথা জানার পর চিকিৎসা জগতের লোকজনের চোখ কপালে উঠেছে। গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তাদের অনেকেই।
কারণ, শরীরে জাবাণুনাশক ঢুকলে বিষক্রিয়ায় মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। এমনকী শরীরের বাইরের অংশও অতিমাত্রায় জীবাণুনাশকের সংস্পর্শে এলে তা চামড়া, চোখ, এমনকী শ্বাসযন্ত্রের জন্য বিপদ তৈরি করতে পারে।
কী বলেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প
বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউজে করোনা টাস্কফোর্সের এক ব্রিফিংয়ে সরকারি একজন কর্মকর্তা একটি গবেষণার ফলাফল হাজির করেন।
তিনি দাবি করেন, তাদের ঐ গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া গেছে সূর্যের আলো এবং তাপে করোনাভাইরাস দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে।
ঐ গবেষণার ফলাফলে আরো বলা হয় মুখের লালা এবং শ্বাসযন্ত্রের ফ্লুইডের মধ্যে ব্লিচ বা জীবাণুনাশক দিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে এই ভাইরাস মেরে ফেলা যায়। আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল (অধিকতর শক্তিশালী জীবাণুনাশক) দিয়ে আরো দ্রুত ভাইরাস ধ্বংস করা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা দপ্তরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের অস্থায়ী প্রধান উইলিয়াম ব্রান্টের কাছ থেকে এসব কথা শোনার পরপরই উৎসাহিত হয়ে পড়েন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
হোয়াইট হাউজের করোনাভাইরাস বিষয়ক রেসপন্স টিমের সমন্বয়কারী ড. ডেবরা ব্রিক্সের দিকে তাকিয়ে মি. ট্রাম্প বলেন, “সুতরাং আমরা যদি দেহকে আলট্রা-ভায়েলেট বা অন্য কোনো শক্তিশালী রশ্মির নিচে রাখি - তাহলে কি হয় আপনারা তা পরীক্ষা করে দেখুন।“
“ঐ আলোক রশ্মি চামড়ার ভেতর দিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে রোগীর শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে তার ফল কী হয়, তাও আপনারা দেখুন।“
এরপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শরীরে জীবাণুনাশক প্রয়োগের পরামর্শ দেন।
“জীবাণুনাশক মিনিটের মধ্যে ভাইরাস ধ্বংস করে দিতে পারে। আমরা কি এমন কিছু করতে পারি যাতে দেহের মধ্যে জীবাণুনাশক ঢুকিয়ে দেহকে একেবারে জীবাণুমুক্ত করে ফেলা সম্ভব হয়।“
“সেটা পরীক্ষা করে দেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।“
এরপর নিজের মাথার দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, “আমি একজন চিকিৎসক নই। কিন্তু আমি এমন একজন মানুষ যার যথেষ্ট ভালো...আপনারা বুঝতে পারছেন আমি কী বলছি।"
ড. ব্রিক্সের দিকে তাকিয়ে এরপর তিনি বলেন, তাপ এবং আলো প্রয়োগ করে করোনাভাইরাসের চিকিৎসার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন কি না।
ড. ব্রিক্স উত্তর দেন, তিনি জানেন না। তিনি বলেন, “জ্বর হলে, শরীরের তাপমাত্রা বাড়লে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কাজ করতে শুরু করে। কিন্তু বাইরে থেকে তাপ এবং আলো প্রয়োগ করে চিকিৎসার কথা আমি জানিনা''
শরীরের ভেতর জীবাণুনাশক কী কাজ করে?
বিবিসির স্বাস্থ্য বিষয়ক সংবাদদাতা র্যাচেল শ্রারেয়ার বলছেন, জীবানুনাশক প্রয়োগ করে বাইরে যেকোনো জায়গায় ভাইরাস মেরে ফেলা যায়।
এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে যে, সূর্যের আলোতে বেশিক্ষণ থাকলে ভাইরাস তাড়তাাড়ি মরে। কিন্তু অতি বেগুনি রশ্মিতে ভাইরাস মরে কি না বা মরলেও কতক্ষণে মরে তার কোনো প্রমাণ এখনো নেই।
ভাইরাস যখন শরীরে প্রবেশ করে তখন তা দ্রুত সংখ্যায় বাড়তে থাকে, এবং শেষ পর্যন্ত ফুসফুসে গিয়ে ঢোকে।
সে সময় শরীরের ভেতর জীবাণুনাশক ঢুকলে তা কাজ করার সম্ভাবনা আদৌ নেই। বরঞ্চ মানুষের জীবন চলে যেতে পারে।
একইভাবে ভাইরাস শরীরে একবার ঢুকলে যত ইউভি রশ্মির সামনেই রোগীকে নেওয়া হোক না কেন, তাতে কোনো কাজ হবেনা। বরঞ্চ চামড়ার বড় ধরণের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
চিকিৎসকরা কী বলছেন
চিকিৎসকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পরামর্শ শুনলে মানুষের জীবন চলে যেতে পারে।
পালমোনোলজিস্ট ড. ভিন গুপ্তা বিবিসিকে বলেছেন, “শরীরে ভেতর জীবাণুনাশক ইঞ্জেক্ট করার এই ধারণা অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন, এবং বিপজ্জনক।''
তিনি বলেন, “মানুষ এই পদ্ধতিতে আত্মহত্যা করে।''
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার চিকিৎসক কাশিফ মাহমুদ বলেছেন, “ কোভিড-১৯ চিকিৎসায় আমি কখনই রোগীদের ফুসফুসে জীবাণুনাশকের ইঞ্জেকশন দিতে বলবো না, অথবা ইউভি রশ্মির নিচে তাকে রেখে দিতে বলবো না।''
“ট্রাম্পের কাছ থেকে মেডিকেল পরামর্শ নেবেন না।''
ইউভি রস্মি দিয়ে শরীরের ভেতর করেনাভাইরাস ধ্বংস করা যায় কিনা - তা তলিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন মি ট্রাম্প
জুকারবার্গ সান ফ্রান্সিককো জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক জন বামস বলেন, ব্লিচ দিয়ে তৈরি জীবাণুনাশক শুঁকলেও শরীরে সমস্যা তৈরি হতে পারে। তিনি বলেন, “ক্লোরিন ব্লিচ নাক দিয়ে শোঁকাটাও ফুসফুসের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে।“
ট্রাম্প করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় ক্লোরোকুইনিন নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। তা নিয়ে বিস্তর সমালোচনার পর তিনি এখন অবশ্য তা নিয়ে আর কথা বলছেন না।
এ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের এক হাসপাতালে এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্লোরোকুইনিন দিয়ে যাদের করোনাভাইরাসের চিকিৎসা করা হয়েছিল তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার বেশি।
এ সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এবং প্রিভেনশন দপ্তর থেকে জনগণকে বাড়িতে অতিমাত্রায় জীবাণুনাশক ব্যবহার সম্পর্কে সাবধান করা হয়।
এই দপ্তরের সাপ্তাহিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে মার্চের গোড়া থেকে জীবাণুনাশকের বিষক্রিয়া নিয়ে সাহায্য চাওয়ার সংখ্যা বেড়ে গেছে।
কোভিডের চিকিৎসায় গোপনে ব্লিচ দিয়ে তৈরি নকল ওষুধ বিক্রি হচ্ছে অনেক জায়গায় যা খেয়ে বমি-ডাইরিয়ার মত নানা সমস্যার অভিযোগ পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনস্ট্রেশন।
সূত্র : বিবিসি