‘মাই নেম ইজ খান, আমি করোনার বাহক নই’
‘মাই নেম ইজ খান, আমি করোনার বাহক নই’ - সংগৃহীত
২০১০ সালে করণ জোহর পরিচালিত শাহরুখ খানের ছবিটিতে একটি বাক্য মুখে মুখে প্রচারিত হচ্ছিল, ‘মাই নেম ইজ খান, আই অ্যাম নট আ টেররিস্ট’। এই ছবির দ্বিতীয় কিস্তি যদি নির্মিত হয়, তাহলে তার নাম অবশ্যই হবে ‘মাই নেম ইজ খান অ্যান্ড আই অ্যাম নট অ্যা করোনা ভাইরাস ক্যারিয়ার’।
মূল কথা হলো, নাম দেখেই মুসলিমদের চাবুক মারবেন না। এপ্রিলের শুরুর দিকে সিক্রির কৃষক ইরফান খানের নাম সংবাদ শিরোনামে আসে। ভরতপুরের জানানা হাসপাতাল তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী পারভিনকে ভর্তি না করে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরিত করে। পথেই ভাড়া করা অ্যাম্বুলেন্সে কন্যাসন্তান প্রসব করেন পারভিন এবং সেই দিনই সদ্যোজাতের মৃত্যু হয়। জয়পুরের হাসপাতালে পাঠানোর আগে ডাক্তার বারবার ইরফানদের নাম, ঠিকানা আওড়ে নিদান দেন যে, এই প্রসূতি এসেছেন সেই তবলিগি জামাতের যেখান থেকে আরো রোগী এসেছিল। ততদিনে ভারতের এক শ্রেণির মিডিয়া ও রাজনীতিবিদদের কাছে তবলিগি জামাত এবং কোভিড-১৯ সমার্থক হয়ে উঠেছিল। ডাক্তারের বক্তব্য, এই প্রসূতি ও তার স্বামী সেখান থেকেই এসেছেন। কাজেই...।
কিন্তু পরে ওই চিকিৎসকের বক্তব্যকে আড়াল করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান যে, ধর্মের ভিত্তিতে কোনো রকম ভেদাভেদ করা হয়নি।
এরপর এ রকম বহু ঘটনা সামনে এসেছে। ভারতে কোভিড-১৯’কে ঘিরে বিজেপি-আরএসএস ও এক শ্রেণির মিডিয়া যে ধরনের প্রচার কৌশল অবলম্বন করেছে, তা প্রাতিষ্ঠানিক জাতিবিদ্বেষ ছাড়া আর কী? এই অতিমারির মরশুমে মেডিক্যাল কেয়ার যখন হিন্দু রোগীকে মুসলিমদের থেকে আলাদা করে, তখন একে জাতিঘৃণা ছাড়া অন্য আর কী বলা যাবে?
গুজরাতেই ঘটেছে এমন ঘটনা। আহমদাবাদ সিভিল হাসপাতালের সুপার গুণবন্ত রাঠোরকে উদ্ধৃত করে এক খ্যাতনামা ইংরেজি দৈনিক ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ এই তথ্য দিয়েছে। হাসপাতাল কী করল? মানুষকে ভাইরাস থেকে বিচ্ছিন্ন করল, নাকি মানুষকে মানুষের কাছ থেকেই বহু দূরে ঠেলে দিলো?
গুজরাত সরকার পরে এই ঘটনাকে অস্বীকার করলেও এটি অর্থহীন। কেন-না এর দ্বারা সত্যকে অপ্রমাণিত করা যায় না। লিঙ্কডইনে মোদির ‘করোনা ভাইরাসের কোনো ধর্ম নেই’ লেখার মতোই অর্থহীন। দেশ-বিদেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর সম্পর্কে যে প্রবল জনমত গড়ে উঠছে, তারই চাপে হয়তো প্রধানমন্ত্রী লিঙ্কডইনে উপরোক্ত কথা বলেছেন। তাও প্রায় এক মাস চুপ থেকে মোদির এই বাণী এসেছে!
তালি বাজাতে ও দীপ জ্বালাতে বলার সময় প্রধানমন্ত্রী মোদি ভারতীয় টেলিভিশনে সুললিত হিন্দির আশ্রয় নেন। আর যখন বলেন ‘কোভিডের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে’ তখন তিনি আশ্রয় নেন ইংরেজির। আর এটা তার মুখ নিঃসৃত নয়। তিনি ইংরেজিতে এই বাক্যাবলী লেখেন। কোথায় লেখেন? এমন এক জায়গায় লেখেন যে প্ল্যাটফর্ম সম্পর্কে অধিকাংশ ভারতীয়ই ওয়াকিফহাল নন। এই জরুরি কথাগুলো বলা হয় আড়ালে, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর কথা বলা বা লেখার ছবি ওই প্ল্যাটফর্মে আসেনি। তিনি কেবলমাত্র লিখিত বাক্য রাখেন। কখন, কীভাবে, কাদের জন্য এ উচ্চারণ, তা অনুমেয়। এ এক কৌশলগত অবস্থান।
এক সময় মুসলিম মাত্রই ছিল ‘আল কায়দা’ ‘আইএসআইএস’ বা ‘জিহাদি’। এখন তারা সবাই তবলিগি। তবে উভয়ের মধ্যে পার্থক্যটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রণিধানযোগ্যও। আল কায়দা বা আইএসআইএস 'জঙ্গি' সংগঠন, অন্যদিকে তবলিগ একটা আধ্যাত্মিকতা চর্চাকারী গোষ্ঠী। তাদের বিশ্বাসে অসূয়া বা সহিংসতার কোনো স্থান নেই। ধর্মের নামে আরো যে সব দল আছে অন্যান্য সম্প্রদায়ে তাদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এই শান্তিকামী দলের ধ্যান-ধারণা।
অথচ ভ্রান্ত প্রচারণা ও মিথ্যাচার এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে সাধারণ মুসলিমও নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রেখে বলতে বাধ্য হয় আমার সঙ্গে তবলিগের কোনো সম্পর্ক নেই বা আমি কখনো মারকাজে যাইনি। যেন এ এক নিকৃষ্টতম পাপ। গুনাহ।
করোনাকালে কিছু শব্দাবলী মিডিয়া জনগণমনে সেঁধিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। যেমন বিশেষ অঞ্চলই হটস্পট, বিশেষ সম্প্রদায়ই জীবাণুর বাহক ও একমাত্র উৎস। এই সবই হয়ত একদিন ক্ষমা পেয়ে যাবে কিন্তু একটি সম্প্রদায়কে নিরন্তর দোষী সাব্যস্ত করে জাতিবিদ্বেষকে বৈধতা দেয়ার যে অপচেষ্টা মিডিয়া করে চলেছে তা মার্জনার অযোগ্য। এই বাক্যাবলীর মধ্যে সবচাইতে বিপজ্জনক ‘একক উৎস’-এর তত্ত্বটি। প্রিয় জন্মভূমিতে সংক্রমণের একমাত্র উৎস নাকি মুসলিমরাই। এমন চিন্তার ব্যঞ্জনা সুদূরপ্রসারী ও গভীর। মিডিয়ার এত আয়োজনের অভিমুখ কোন দিকে? কী প্রমাণ করতে উদ্গ্রীব তারা? এটাই যে মুসলিমরা কেবল অসুখের বাহক-ই নয়, তারা নিজেরাই মূর্তিমান ‘অসুখ’। কাজেই চিহ্নিত করো তাদের, বিচ্ছিন্ন করে দাও আর তারপরে ডিটেনশন ক্যাম্পে নির্বাসন দাও। নকশাটি স্পষ্ট।
বিজ্ঞানের যুক্তি ও মুক্তবুদ্ধি অনুসরণ করে চলে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সেখানে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অন্ধত্বের স্থান নেই। যদি থাকে তা নিঃসন্দেহে বৈষম্যমূলক। আর এমন জীবনমৃত্যুর দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে এই বৈষম্য এক অপরাধ। খবরে প্রকাশ, অনেক হাসপাতাল চিকিৎসকদের হিপোক্রেটিক শপথ, হু-র নির্দেশিকা ও সংবিধানের ১৫ নং ধারাকে লঙ্ঘন করেছে। যেমন, ভরতপুর জানানা হাসপাতাল। এই চিকিৎসালয় মুসলিম বলে এমন এক অন্তঃসত্ত্বাকে ভর্তি নিতে অস্বীকার করেছে যিনি প্রসব বেদনায় ছটফট করছিলেন।
আহমদাবাদ সিভিল হাসপাতাল। এরা আইসোলেশন ওয়ার্ডে ধর্মের ভিত্তিতে কোভিড-১৯ রোগীদের পৃথক পৃথক ভাবে রেখেছিল। মিরাটের ভ্যালেন্টিস ক্যানসার হাসপাতাল। ‘কোভিড নেগেটিভ’ এই সার্টিফিকেট না থাকলে মুসলিম রোগীদের প্রবেশে নিষেধ, এই মর্মে দৈনিক সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। জামশেদপুরের এমজিএম হাসপাতাল। করোনা ছড়ানোর অভিযোগে এই হাসপাতাল মুসলিম এক অন্তঃসত্ত্বাকে ভর্তি নেয়নি এবং এর ফলস্বরূপ ওই মহিলা তাঁর সন্তানকে হারান।
তেলেঙ্গানার করিমনগর জেলারশিশুদের এক হাসপাতাল। অভিযোগ, এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তাররা মুসলিমদের চিকিৎসা করতে অস্বীকার করেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি শুধু হাসপাতালগুলোকে দোষ দিতে পারি যেখানে স্বয়ং সরকার এই বৈষম্যকে নিরন্তর উৎসাহিত করে চলেছে! হু (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) সরকারকে এভাবে মুসলিমদের প্রোফাইলিং বা চিত্রিত করতে নিষেধ করার দু’দিন পর, ৮ এপ্রিল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এক নির্দেশিকা জারি করে হু-র আদেশ পালন করতে বলে। কিন্তু এ শুধু কথার কথা। কেন-না এই মন্ত্রণালয়েরই যুগ্ম সেক্রেটারি লব আগারওয়াল তার প্রাত্যহিক মিডিয়া বিবৃতিতে ধারাবাহিকভাবে নির্দিষ্ট কোনো রোগী কোথা থেকে করোনা আক্রান্ত হয়েছে তাতে ‘তবলিগি ফ্যাক্টর’কে উল্লেখ করে গেলেন। আর কোনো ফ্যাক্টর যেন দায়ী নয়!
দিল্লির কেজরিওয়াল সরকারও এর ব্যতিক্রম নয়। ১১ এপ্রিল পর্যন্ত দিল্লি সরকারের করোনা আপডেটের ওয়েবসাইটে একটি বিশেষ বিভাগ ছিল। বিভাগটিতে নিয়মিত সংখ্যা দেয়া হচ্ছিল নিজামুদ্দিনে ওই জমায়েতের মাধ্যমে কতজন করোনা আক্রান্ত হলো। দিল্লির সংখ্যালঘু কমিশন তীব্র ভাষায় চিঠি দেয়ার দু’দিন পর এই বিশেষ বিভাগটি সরিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। বিভিন্ন হাসপাতালগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই নির্দেশগুলোই অনুসরণ করে চলেছে।
ভারতজুড়ে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা সুপারহিরোসুলভ যে ভূমিকা পালন করে চলেছেন, কিছু হাসপাতাল এই আলোক উজ্জ্বলতাকে খানিকটা হলেও বিবর্ণ করে দিলো। খাটো হলো চিকিৎসক সমাজের মাহাত্ম্য। তবে এখনো বেশিরভাগ হাসপাতাল মানবিক দায়িত্বপালনে সদাজাগ্রত।
তাই আশা জাগে। আশা জাগে যখন জেলা মুখ্য মেডিক্যাল কর্মকর্তা ও পুলিশ মিরাটের ভ্যালেন্টিস ক্যানসার হাসপাতালের অমানবিক বিজ্ঞাপন ও আচরণের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেন। ক্ষমাপ্রার্থনা না করলে হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল করা হবে, এই কথা বলেন যখন সিএমও, তখন আশা জাগে। হয়তো এখনো সব শেষ হয়ে যায়নি।
ভারতের যারা স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার নিয়ামক, তাদের সকলের সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। চিকিৎসক সমাজে যে নেতারা রয়েছেন, আজ এই ধ্বংসকালীন সময়ে তাদের দরকার কেবল দৈহিক স্বাস্থ্য নয়, মানবিকতা ও মানসিকতার সুস্বাস্থের সপক্ষে স্বর তোলা। দরকার সার্বিক শ্রুশ্রূষার। এ এমন এক সময় যখন গোটা মানবজাতি জীবনমৃত্যুর সূক্ষ্ম সেতু পার হয়ে যাচ্ছে। এই স্পর্শকাতর সময়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা যদি ওই সমস্ত ঘটনাগুলো থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকে, তাহলে আগামী প্রজন্ম এক নয়া মড়কের জন্য তাদের সমালোচনা করবে আর সেটা হলো প্রাতিষ্ঠানিক জাতিবিদ্বেষ।
অন্যান্য পাবলিক ক্ষেত্রেও তাদের অনুসরণ করে বলতে পারে দোকানে, গণপরিবহণে মুসলিমদের কোভিড-মুক্তির শংসাপত্র ছাড়া প্রবেশ নিষেধ। আর আমাদের প্রিয় দেশ স্বাস্থ্য, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সংকট থেকে ত্রাণ পেলেও তা খুব সুখকর হবে না। করোনা ভাইরাস যাবে। থেকে যাবে গভীর মানবিক ও নৈতিক লকডাউন।
তরজমা ও তথ্য সম্পাদনা : জিয়াউল হক
সূত্র : পূবের কলম