চীন নিয়ে ভারতের কূটনীতি

চীন নিয়ে ভারতের কূটনীতি - সংগৃহীত
করোনাভাইরাসে ২০ এপ্রিল সন্ধ্যা নাগাদ বৈশ্বিক মৃত্যু দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৬৬ হাজারে, কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই মারা গেছে ৪০ হাজারের বেশি। বেইজিংয়ের কাছে ২০ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে একটি মামলা হয়েছে, জার্মানির একটি দৈনিক ১৫০ বিলিয়ন ইউরো দাবি করেছে। চীন আগ্রাসীভাবে আত্মরক্ষা করে বলছে যে তারা ভাইরাসটি দমন করতে নিজের সব মানুষকে বাজি রেখেও সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে যাতে বিশ্ব নিজেকে সুরক্ষিত করতে সময় পায়।
আরো কঠিন প্রতিক্রিয়াও শোনা যাচ্ছে।
গ্লোবাল টাইমসে (চীনের বেশির ভাগ মিডিয়ার মতো এটিই চীনা কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালনা করে) ‘চীনকে কলঙ্কিত করার প্রতিটি পদক্ষেপ আমাদেরকে ঐতিহাসিক স্মৃতি উস্কে দেয়’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে সাংবাদিক লি জিয়ামিং অভিযোগ করেছেন, পাশ্চাত্য বিশ্ব নির্লজ্জভাবে বিরূপ মন্তব্য করছে। তিনি ত্রয়োদশ শতকের ‘ওলফ অব ঝনশং’ কাহিনীটি (এতে যে লোক উপকার করে, তাকেই হত্যা করা হওয়ার গল্প বলা হয়েছে) নতুন করে বলেন।
চীন, সংক্ষুব্ধ পক্ষ
এখানে কল্পনার অবকাশ আছে সামান্যই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য বিশ্ব কোভিডকে অতিমারিতে পরিণত হওয়ার সুযোগ দেয়ার জন্য চীনকে পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। লি বলতে চেয়েছেন যে পাশ্চাত্য হলো রূপকথার গল্পের সেই দুষ্ট নেকড়ে আর তার শিকার হতে যাচ্ছে হতভাগা চীনা জনগণ।
এই সাংবাদিক আরেকটি ঐতিহাসিক তুলনাও সামনে এনেছেন। তিনি বলেছেন, চীনা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ২০২০ সালটি হলো ‘গেঞ্জি বছর।‘ এটি প্রতি ৬০ বছর পরপর আসে এবং এর দুটি সাইকেল আগে ছিল ১৯০০ সাল। ওই বছর আট জাতির জোট (ব্রিটেনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জারবাদী রাশিয়া, জাপান, জার্মানি, ইতালি ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য) বক্সার বিদ্রোহ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল লুটপাট, অগ্নিসংযোত ও ‘চীন আক্রমণের’ মাধ্যমে।
লি বলেন, এখন ১২০ বছর পর ওই আট জাতি জোটের কিছু বংশধর নির্লজ্জভাবে ক্ষতিপূরণ াচ্ছে, তারা আমাদের পর্যুদস্ত হওয়ার ঐতিহাসিক স্মৃতি উস্কে দিচ্ছে। তারা যদি চীনের কাছে ক্ষতিপূরণ চায়, তবে চীনেরও ১৮৪০ সালের আফিম যুদ্ধের শুরু থেকে তাদের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করা দরকার।
‘ভাই-ভাই’ থেকে সতর্ক সম্পর্ক
জওহেরলাল নেহরু-পরবর্তী যুগে বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশই চীনা বাগাড়ম্বড়ার কবলে পড়ে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তার প্রতি করা ঐতিহাসিক অবিচারের বিষয়টি চীনার গভীরভাবে অনুভব করে এবং ভারতসহ অন্য দেশগুলোর একই ধরনের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার ব্যাপারে একই ধরনের অনুভূতি ধারণ করে। ‘হিন্দি-চিনি’ ভাই ভাই ওই আবেগই প্রকাশ করে। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিচ্ছিন্ন তাইওয়ানকে বাদ দিয়ে চীনা জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধি হিসেবে চীনকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী আসন দেয়ার পদক্ষেপকে সমর্থন করেছিল ভারত।
এরপর বর্তমান সময় পর্যন্ত ভারত-চীন সীমান্ত সমস্যা, পাকিস্তান, মাসুদ আজহার ও কাশ্মিরসহ নানা জটিলতার কারণে আগের অবস্থা দৃশত বদলে গেছে। একইসাথে আবার ভারত-চীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক অনেক বেড়েছে এবং তা অনেকটাই চীনের অনুকূলে।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও চীন বিশেষজ্ঞ শ্যাম সরন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ‘বৈরী’ হিসেবে অভিহিত করলেও জানান যে এর মানে এই নয় যে করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে চীনকে দায়ী করা বা বলির পাঁঠা বানানোর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাল মেলাতে হবে ভারতকে।
চীনে ভাইরাসটির উৎপত্তি হয়েছে বলেই কিংবা ওই দেশেরই বাঁদুর থেকে মানবদেহে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে বলেই চীনকে দায়ী করা যায় না, তবে চীনকে অবশ্যই দোষ দেয়া যায় কয়েক সপ্তাহ ধরে তথ্য চেপে যাওয়ার কারণে। ওটা না করলে মহামারিটি প্রাথমিক স্তরেই দমন করা হয়তো সহজ হতো।
নীরবতা একটি বিবৃতি
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক চীন বিশেষজ্ঞ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করে নরেন্দ্র মোদি সরকার ঠিক কাজটিই করেছে। কারণ এখন ভারতের প্রয়োজন হাজার হাজার মাস্ক, সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম, ভেন্টিলেটর ইত্যাদি। কোভিড দমনের এসব উপকরণ আসতে পারে কেবল চীন থেকেই।
চীনে নিযুক্তি ভারতের রাষ্ট্রদূত বিক্রম মিস্রি বলেন, তিনি বর্তমান সঙ্কট নিয়েই পুরোপুরি ব্যস্ত।
তিনি বলেন, ভারত-চীন সম্পর্ক এখন এতটাই জটিল যে এখন প্রকাশ্যে কিছু বলার উপায় নেই। তার চেয়ে ভালো, অন্যরা তাদের কথা বলতে থাকুক।
তবে এর মধ্যেই ভারতে চীনা বিনিয়োগ কড়াকড়ি করার বিধান জারি করেছে ভারত। এতে চীন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।
তবে এই চীন বিশেষজ্ঞ বলেন, জিনকে আবার বোতলবন্দী করতে হলে সঙ্ঘাত নয়, প্রয়োজন সহযোগিতার।
দি প্রিন্ট