নীল নদের পানি রক্তবর্ণ হয়েছিল যে কারণে
নীল নদ - সংগৃহীত
প্রাচীন মিসরে ফেরাউনের কিবতি লোকজনই ছিল সেরা মানুষ ও কৌলীন। এ জন্য তারা ইসরাইলিদের দাস হিসেবে ব্যবহার ও নির্যাতন করত। ১৯৯০ সালে ভূতত্ত্ববিদরা খুঁড়াখুঁড়ি করে দুটি শহরের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন, প্রিতম ও রেমসিস। প্রিতমের চেয়ে রেমসিস অনেক বড় নগর। এগুলো বতর্মান নীল নদের ডেল্টায় অবস্থিত। নানা যন্ত্রপাতির সাথে তারা সিজিয়াম মেগনেটোমিটারও ব্যবহার করে। মাটির পাঁচ মিটার নিচে এই যন্ত্রের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা বিল্ডিয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পান। এই যন্ত্রটি অনেকটা এক্স-রে মেশিনের মতো কাজ করে। মাটির নিচের বিল্ডিং ও অবকাঠামোর ছবিও তুলতে পারে। ছবি দেখে ভূতত্ত্ববিদরা অবাক হন, নতুন এক শহর, শ্রমিকদের থাকার ছোট কুঠুরি, বড় গ্রাউন্ড, অ্যাভিনিউ, নানা কিছু। অনেক বড় শহর ৩০ বর্গকিলোমিটার। নীল নদ তখন ওই শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যেত। বিজ্ঞানীরা তার ছবিও এঁকেছেন। পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের কাছেও নগরটি সুপরিচিত ছিল। বিশ্রামখানা, হোটেল নানা রকম ফলমূল, মদ ও রুটির জন্য বিখ্যাত ছিল মিসরের রেমসিস নগর। কোনো অভাব ছিল না, দুঃখ-কষ্ট ছিল না। শহরকে বলা হতো প্যরাডাইজ।
হঠাৎ নেমে আসে দুর্যোগ। বাইবেল বলে, মূসা আ:-এর লাঠির এক ছোঁয়ায় নীল নদের পানি রক্তাত হয়ে যায়। মিসরের মানুষের জন্য এটাই প্রথম প্লেগ বা ‘তাউন’। রক্তাক্ত পানি জীবনের পরিবর্তে জীবনহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চারদিকে মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। মরতে থাকে পশু, মাছ ও মানুষ। জেরুসালেম টেম্পল স্কুল ‘রক্ত পানি’ নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে। বার্লিনের ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার ইকোলজি ও ইনল্যান্ড ফিশারিও গবেষণা করেছে।
এখানের বিজ্ঞানীরা মনে করেন, নীল নদের পানি রক্তবর্ণের জন্য বিষাক্ত ব্লু আলজি দায়ী। বিজ্ঞানীরা বারগেন্ডি ব্লাড আলজি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এটি আসলে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া। এই আলজি তিন হাজার বছর আগেই দেখা গিয়েছিল। এটি খুবই বিষাক্ত ও রক্তবর্ণের। বায়োলজিস্ট ফ্লুন বিবলিকাল এই রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, নীল নদের রক্ত লাল হয়েছিল বারগেন্ডি ব্লাড আলজির কারণে। এটি বিষাক্ত রক্তের মতো লাল ও দোদুল্যমান থাকে। এটি দেখতে অতি সুন্দর সায়ানো ব্যাকটেরিয়ার একটি প্রজাতি। আস্তে আস্তে প্রবাহিত খুব হাল্কা কুসুম গরম পানিতে অতি দ্রুত বংশবিস্তার করতে সক্ষম। শুধু নীল নদ নয়, পশ্চিম ফ্লোরিডার সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায়ও বিজ্ঞানীরা একই জিনিসের সাক্ষাৎ পান। বিপজ্জনক লাল আলজি সেখানে ফুটে উঠতে দেখেছেন যা বংশবিস্তার করলে মারাত্মক পরিণতি আনতে পারে, এই ব্লাড আলজি ফেরাউনের সভ্যতাকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল।
এখন বোঝা যাচ্ছে, নীল নদে বংশবিস্তারের সময় আশপাশের পানিতেও এটি বংশবিস্তার করেছিল। বিষাক্ত এই প্রবাহকে বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘লাল ঢেউ’। আলজি গভীর জলে দেখা যায় না। গভীর পানিতে এটি বর্ণহীন থাকে।
প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানের অভাবেও এটি বিস্তার লাভ করে না। পক্ষান্তরে নির্দিষ্ট খাদ্য উপাদান পেলে আরো রক্ত লাল ও জীবন বিধ্বংসী হয়ে উঠে। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন গভীরতায় ও বিভিন্ন স্থান থেকে ব্লাড আলজির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছেন- কিভাবে এই ভয়ঙ্কর ব্যাকটেরিয়া ছড়ায়। আলেন চেন বেল্লা বিশ্বের প্রথম সারির একজন বিষাক্ত আলজি গবেষক। তিনি বলেছেন, আলজি কোনো কোনো সময় পানির ওপরে লাল কভার সৃষ্টি করে, এতেও পানি লাল দেখায়। অনেক সময় পানিতেই ঘোরাফেরা করে কোনো রঙ বা কভার সৃষ্টি না করে। করোনিয়া ব্রেভিস নামে এক ধরনের আলজি আছে- যেগুলো এক মিলিমিটারের ১০০ ভাগের এক ভাগের চেয়ে ছোট। এগুলোও বিষাক্ত ও আক্রমণকারী আলজি যারা নার্ভ গ্যাস নিঃসরণ করে।
এক লিটার পানিতে বিজ্ঞানীরা কয়েক মিলিয়ন আলজির অস্তিত্ব পেয়েছেন। এই করোনিয়া ফোটার পর সপ্তাহ, মাস বা প্রকারভেদে বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। সমুদ্র, হ্রদ ও নদীতে আজ পর্যন্ত ৬০ ধরনের বিষাক্ত আলজি খুঁজে পাওয়া গেছে। তবে, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস কোটি কোটি রকমের। এগুলোকে ধ্বংস করা মানুষের আয়ত্তের ভেতর নেই। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব আলজি হাজার-লাখ বছর আগেও জন্ম নিতে পারে বা নিয়েছে। আলজির কারণে প্লেগ বা মহামারী যেকোনো সময় হতে পারে। মিসরের নীল নদেও এমনি এক ভয়াবহ বিপর্যয় হয়েছিল। প্রথম বিবলিকাল প্লেগ সাত দিন পর শেষ হয়। মিসরীয়রা নীল নদের হেপি দেবীর পূঁজা করত, যাতে নীল নদ তাদের রক্ষা করে। আলেকজান্দ্রিয়ায় সমুদ্র উপকূলে হেপির মূর্তি খুঁজে পাওয়া যায়। আলেকজান্দ্রিয়ার জাদুঘরে এসব রক্ষিত আছে। বিষাক্ত লাল রক্ত পানি প্রমাণ করল নীল নদের দেবীর কোনো ক্ষমতা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, ফেরাউন যে ক্ষমতাহীন সেটিও প্রথম এই প্লেগের মাধ্যমে মানুষ বুঝতে সক্ষম হয়। এর মাধ্যমে মূসা আ:-এর যে বার্তা- আল্লাহই শক্তিশালী সেটিরও প্রমাণ হয়ে যায়।