দুই জেনারেলের মৃত্যুর পর করোনা চিনতে পারল মিসর!

মো: বজলুর রশীদ | Apr 21, 2020 09:04 pm
করোনা

করোনা - সংগৃহীত

 

তিন হাজার বছর আগে যে মহামারী মিসরে দেখা দিয়েছিল, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মিসরের কিবতিরা। মূসা আ:-এর অনুসারীরা ঘরের ভেতর অবস্থান বা ‘লকডাউন’ করে অবস্থান করত। এটি আল্লাহপাকের নির্দেশ ছিল। সেই কিবতিরা এখনো মিসরে রয়েছে। তাদের অনেকে হতদরিদ্র ও কোথাও কোথাও উপজাতি মর্যাদা পেয়ে থাকে। মাছ ধরা, পশুপালন, মৃতশিল্প এসব এখন তাদের পেশা।

আজ নতুন করে করোনাভাইরাস আরেক বিশ্ব মহামারীর রূপ নিয়ে মিসরে আক্রমণ চালিয়েছে। বিশ্বে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লেও মিসরের সরকার প্রথম দিকে করোনাজনিত মৃত্যু অস্বীকার করে এবং মিসরে কোনো সংক্রমণ হয়নি, এসব নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যু বলে প্রচার করে। যারা স্কুল-কলেজ বন্ধ ও কারফিউ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল সরকার, এসব প্রচার তাদের কারসাজি এবং এর পেছনে আইএস জড়িত বলে প্রচার করে। জানুয়ারিতে যখন করোনা প্রথম আঘাত করে তখন আইএসের মুখপত্র নাবাতে, কুরআন শরিফের সূরা আন নাবার নামানুসারে তাদের পত্রিকার এই নাম রাখা হয়েছে, প্রকাশ করা হয়- এই ভাইরাস মানুষের অসৎ কাজের প্রতিফল হিসেবে পাঠানো হয়েছে। ‘জাহিল সমাজে সৃষ্টিকর্তার রোষানল’ বলেও পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়। এই দল মহামারী থেকে বাঁচার জন্য অনুশোচনা বা তাওবা করার এবং আইএসে যোগদান করার আহ্বান জানায়।

সারা বিশ্ব যখন বিমানবন্দর ও পর্যটন বন্ধ করে দিয়েছে, তখন আয়ের পথ রুদ্ধ হওয়ার ভয়ে মিসর তা করেনি। ফলে ইতালির এক পর্যটক লুক্সরে যে জাহাজে নীল নদে ভ্রমণ করছিলেন, তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় একাই জাহাজে থাকা ৪০ জনকে সংক্রমিত করেন। এই সংবাদটি গার্ডিয়ানে প্রকাশ হলে সিসি সরকারের মাথা গুলে যায়।

সরকার পত্রিকার স্থানীয় অফিস বন্ধ করে দেয় এবং সংবাদদাতাকে মিসর থেকে বহিষ্কার করে। তা ছাড়া মিসর চীনের এক পর্যটন দলকেও পর্যটনের দরজা খুলে দেয়, তারাও দেশে ভাইরাস ছড়ায়। সরকারি বিভিন্ন প্রচারপত্রে বলা হয়েছিল ‘আমরা আক্রান্ত হবো না। আমরা মিসরীয়।’ সাধারণ মানুষকে ভয় না পাওয়ার জন্য এমন সব বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হয়। কিছু মিডিয়ার লোক জড়াজড়ি করে পোজ দেয়া ছবিও পোস্ট করে, ভাবখানা এমন- ‘আমরা করোনাভাইরাসের চেয়েও শক্তিশালী’। এটা তো ফেরাউনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আসেনি যে ধর্ম, জাতীয়তা ভেদে আক্রমণ করবে। এই ভাইরাস পুরুষ ও মহিলাকে বোঝে না, ধনী এবং দরিদ্রকেও। তাই এবার মিসরীয়দের বা কিবতিদের জন্য কোনো সুসংবাদ নেই। যদি মিসরে ব্যাপকভাবে হানা দেয় তবে মৃত্যু সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যাবে। কেননা, মিসরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নাজুক। তা ছাড়া স্বাস্থ্য অব্যবস্থা ও সুচিকিৎসার অভাবে এ দেশে কিডনি বিকল, লিভারজনিত ব্যাধি ও ক্যান্সারের রোগী বেশি। এরা আক্রান্ত হলে জীবন রক্ষা সম্ভব নাও হতে পারে।

মিসর এমন ভান করলেও করোনার আঘাতে দুইজন সেনাবাহিনীর জেনারেল মৃত্যুবরণ করেন। তখন সরকার মুহূর্তেই মত পাল্টায় এবং মিডিয়া বাস্তবে ফিরে আসে। স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেয়। জনসমাবেশে নিষেধাজ্ঞা আসে এমনকি রমজানের তারাবিহর নামাজও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সিনেমা, ক্লাব, খেলাধুলা এসবও বন্ধ করে দেয়া হয়। সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ দেয়া হয়। ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। হঠাৎ করে এই পদক্ষেপে লোকজন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য কেনা শুরু করে এবং বাজারদর লাফিয়ে উঠে। কেউ গুজব ছড়ালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

পেছনে তাকালে দেখা যাবে, বার্ড ফ্লু ও সোয়াইন ফ্লুর সময় দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণেও অনেক মানুষ মারা পড়ে। জনসাধারণ হাসপাতালে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য সহকারীদের অবহেলার অভিযোগ তুলছেন সবখানে। করোনাভাইরাস ঠেকানোর মতো কোনো প্রস্তুতি হাসপাতালগুলোতে নেই। হাসপাতালে মেডিক্যাল সাপ্লাই অপ্রতুল ও টেস্টিং কিট পাওয়া যাচ্ছে না। সাধারণ বাজারে কিটের প্রচুর দাম। সুরক্ষা সরঞ্জামের অভাব বেশি। এতে ডাক্তাররাও কাজে অনীহা প্রকাশ করেছেন। জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের ১৫ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এখন ক্যান্সার চিকিৎসাও এক প্রকার বন্ধ।

করোনার ব্যাপকতা নিবারণে সেনাবাহিনী বিশেষ দায়িত্ব নিয়েছে। এটি প্রশংসনীয়। সেনাবাহিনী নিজস্ব কারখানায় বহুল ব্যবহৃত মেডিক্যাল মাস্ক উৎপাদন ও সাশ্রয়ী মূল্যে বিক্রি করছে। সেনাবাহিনী বড় বড় সার্ভিস ভেহিক্যালের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে মোবাইল স্টোরের আদলে এসব ১২ মিসরীয় পাউন্ডে (এক মিসরি পাউন্ড=৫.৩৫ টাকা) বিক্রি করছে, অথচ দোকানে এগোলো ৭০ মিসরীয় পাউন্ডে বিক্রি হচ্ছিল। সেনাবাহিনী বিভিন্ন স্থানে খাদ্যগুদামও গড়ে তুলছে। এসব একটি গুদামের খাবার ৩০ দিন পর্যন্ত ২০ হাজার লোককে খাদ্য সরবরাহ করতে পারবে। মিসরে গত মার্চ মাসে ফরেন রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৪৫.৫ বিলিয়ন। করোনাভাইরাসের আক্রমণে অর্থনীতিতে বড় আঘাত এখনই শুরু হয়েছে। মিসরের দিকে দৃষ্টিপাত দিলে দেখা যাবে, মিসরের জনগণ অনেক কষ্ট-যন্ত্রণা পেয়েছে, শুধু রোগ-বালাই থেকে নয়, তাদের শাসকদের কাছ থেকেও।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us