সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার : বিপর্যয় আনবে আর্থিক খাতকে?
সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার - সংগৃহীত
সরকার দীর্ঘ দিন ধরে ঋণের সুদহার কমানোর জন্য বলে এলেও ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সময়ে সুদের হার কমানোর কথা বলে বলেও কোনোরকম কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। সুদের হার কমানোর চেষ্টা করেও কোনোরকম সুফল না পাওয়ায় সরকারের চাপের মুখে এক প্রকার বাধ্য হয়েই উৎপাদন খাতে ঋণের সুদহার কমিয়ে এক অঙ্কে, অর্থাৎ ১০ শতাংশের কম নির্ধারণ করতে যাচ্ছে ব্যাংকিং খাতের অভিভাবক হিসেবে খ্যাত বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে করোনা আতঙ্কে পুরো দেশ স্তব্ধ ও প্রায় অচল থাকলেও এরই মাঝে গত ১ এপ্রিল থেকে নতুন সুদহার কার্যকরের নির্দেশনা থাকছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি সব ধরনের ঋণের সুদের হার একমাত্র ক্রেডিট কার্ডের ঋণ ছাড়া কমানোর প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। নতুন এই সুদের হার কার্যকর হওয়ার ফলাফল কী হতে পারে এই মুহূর্তে কিছু বলতে না পারলেও ধারণা করা যায়, ব্যবসাবাণিজ্যসহ রাজস্ব আদায়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কাই বেশি। বিশেষ করে নিশ্চিত হয়েই বলা যায় যে, দেশের আর্থিক খাত তথা ব্যাংকগুলোর আয় ব্যাপকভাবে কমে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকের আয় কমে গেলে এর প্রভাব পড়বে দেশের শিল্পোন্নয়নসহ ব্যবসাবাণিজ্য, শেয়ারবাজার, রাজস্ব আদায় ও কর্মসংস্থানের ওপর। অপর দিকে ঋণের সুদহার কমানোর সাথে পাল্লা দিয়ে আমানতের সুদের হার কমাতে গিয়ে এক দিকে যেমন ব্যাংগুলো আমানত হারানোর শঙ্কাই দেখছে বেশি, অন্য দিকে আমানত হারালে ব্যাংকের ঋণ দেয়ার সক্ষমতাও কমে যাবে। এমতাবস্থায় দেশের ব্যাংক-বীমাসহ আর্থিক খাতে টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে বলে অর্থনীতিবিদদের অনেকে ধারণা।
দেশের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অঙ্কে বেঁধে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে বাড়তে পারে দেশের বেসরকারি বিনিয়োগ। তবে এসএমই বা ক্ষুদ্র বিনিয়োগ সঙ্কটে পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনলে বড় বড় ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন কিছু সম্ভাবনার আশা থাকলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের প্রান্তিক জনপদের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। কারণ বৃহৎ এবং ক্ষুদ্র ঋণ পরিচালনা অনেক পার্থক্য। ঋণ বিতরণে সিঙ্গেল ডিজিট কার্যকর হলে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।
সাধারণত দেশের আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো জনসাধারণের আমানতের টাকায় পরিচালিত হয়। নিজেদের বিনিয়োগের মাত্রা অনেক কম থাকলেও আমানত সংগ্রহের পর সাধারণত কস্ট অব ফান্ড বা পরিচালন ব্যয়ের সাথে ৫ থেকে ৭ শতাংশ সুদ যুক্ত করে ঋণ বিতরণ করে থাকে। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই ঋণ ও আমানতের সুদহারের এমন ব্যবধানই অনুসরণ করা হয়ে থাকে। এ অবস্থায় যেসব ব্যাংকের আমানতের সুদহার ৯ শতাংশ বা তারও বেশি রেখে মেয়াদি আমানত রেখেছে সেগুলো ঠিক কত শতাংশ সুদে কত দিন পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করতে পারবে সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই প্রজ্ঞাপনে। বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের সর্বোচ্চ গড় পরিচালন ব্যয় বা কস্ট অব ফান্ড পদ্মা ব্যাংক লিমিটেডের এবং সর্বনিম্ন ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, ব্যাংক ঋণের সুদহার বেঁধে দেয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। এই সিদ্ধান্তের পরিবর্তে ব্যাংকগুলোকে ঋণ ও আমানতের সুদ হারের পার্থক্য বা স্প্রেড কমিয়ে আনার নির্দেশনা দেয়া ভালো ছিল। এতে করে ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় আরো কমে আসত।
ব্যাংক ঋণের সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনলে উন্নয়ন সম্ভাবনার পরিবর্তে আর্থিক বিপর্যয়ের ব্যাপারকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ ৯ শতাংশে ঋণ বিতরণ করতে হলে কম করে হলেও ৫ শতাংশে আমানত পেতে হবে। কিন্তু ৫ বা ৪ শতাংশে আমানত পাওয়া যাবে কি না এটাও প্রশ্ন, সুতরাং বাজার বিশ্লেষণ না করে এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ চরম সঙ্কটে পড়ার আশঙ্কা বেশি।
দীর্ঘ চাকরি জীবন শেষে অবসরপ্রাপ্ত যেসব ব্যাংকার এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যাংকে টাকা জমা রেখেছেন তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হবে। হুট করে আমানতের সুদ হার কমিয়ে দিলে তারা সংসার চালাতে পারবেন না। এসব আমানতকারীর জন্য সঞ্চয়পত্রে বা যেকোনো বিনিয়োগে বিশেষ ব্যবস্থা রাখার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই পথও এখন বন্ধ। প্রকৃতপক্ষে ৯ শতাংশে ঋণ বিতরণের সিদ্ধান্ত অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট অনেকে।
দেশের আর্থিক খাত এবং বিনিয়োগ চাঙ্গা করতে হলে বেশ কয়েকটা দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ব্যাংক মালিকদের নিজের ব্যাংক বাদ দিয়ে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার মানসিকতা পরিহার করার পাশাপাশি অর্থপাচার ও অধিক মুনাফা অর্জনের আকাক্সক্ষা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দক্ষ ও দায়িত্ব¡পূর্ণ লোকবল নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে ব্যাংক পরিচালনা ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। আর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ আসলে ব্যাংকিং খাতের বিপর্যয়সহ অর্থনীতির জন্য অশনি সঙ্কেত, স্পর্শকাতর খাত মনে করে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। মোট কথা ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে অর্থনীতিবিদ অনেকে এমন মতামত দেন।
সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়ন নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তার নিজের কাজটা ঠিকমতো করতে পারছে না, এমনিতেই বেসরকারি বিনিয়োগ নি¤œমুখী, সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়ন হলে বেসরকারি বিনিয়োগ আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার ফলে কর্মসংস্থানের ওপরও নতুন করে চাপ তৈরি হবে। তা ছাড়া ব্যাংক ঋণের সুদ হার বেঁধে দেয়ার বিষয়টি মুক্তবাজার অর্থনীতির সাথে সাংঘর্ষিক।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের চাপে এবং পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে এক অঙ্কের সুদহার নির্ধারণ করে দেয়া হবে, যাতে একা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর দায় না আসে। তবে এর পরিণতি কী হবে, তা দেখতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে নাও হতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সবশেষ বলতে গেলে আমরা আশা করি, রাষ্ট্রের উন্নয়নের স্বার্থে, উৎপাদন, কর্মসংস্থানসহ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার কথা মাথায় রেখে সরকার ব্যাংক ঋণের এবং আমানতের সুদের হার নয়-ছয় করতে গিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যাতে নয়-ছয়ে পড়ে না যায় সে দিকে সম্পূর্ণ গুরুত্ব দিয়ে ভেবেচিন্তে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
লেখক : সম্পাদক, অর্থনীতির ৩০ দিন