করোনা নিয়ে ব্রিটেনে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ ষড়যন্ত্র
করোনা নিয়ে ব্রিটেনে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ ষড়যন্ত্র - সংগৃহীত
ব্রিটেনে মুসলিমরা মসজিদ খোলা রেখে করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে বলে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে দেশটির ডানপন্থী চরমপন্থীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো ওই মিথ্যা অভিযোগের প্রেক্ষাপটে চরমপন্থীরা জানিয়েছে করোনা ভয় কেটে গেলে তারা মসজিদগুলোতে হামলা করে গুঁড়িয়ে দিবে। আর ওই গুজবের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে মুসলিম নারীদের উপর হামলা ও হেইট ক্রাইমের খবর পাওয়া গেছে।
ব্রিটেনের মসজিদ ও মুসলিমদের নিয়ে সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমে ছাড়নো মিথ্যা অভিযোগ বিষয়ে জানা যায় বার্মিংহাম সিটি ইউনিভার্সিটির এক তদন্ত প্রতিবেদনে। ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ইমরান আওয়ান, রোক্সানা খান ও উইলিয়ামস দেশটির এন্টি মুসলিম হেটারড ওয়ার্কিং গ্রুপের এক রিপোর্টের প্র তদন্ত শুরু করে। তাদের তদন্তে জানা যায়, চরমপন্থীরা হোয়াটসআপ, ফেসবুক, টেলিগ্রাম ও টুইটারসহ অন্যান্য মাধ্যমে মসজিদে নামাজ পড়ার পুরোনো ভিডিও প্রচার করছে। ওসব ছড়িয়ে সাধারণ লোকজনকে বলা হচ্ছে, মুসলিমদের কারণে ব্রিটেনে করোনা ছড়াচ্ছে। আর তাদের গুজবে বিশ্বাস করে অনেকেই পুলিশের কাছে বারবার অভিযোগ করছে মসজিদ বন্ধ করার জন্য। অথচ ব্রিটেনে ৩৭৫টি মসজিদ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে লকডাউনের আগেই, আর বাকিগুলো সরকারের ঘোষণার সাথে সাথেই।
ডানপন্থী চরমপন্থীদের নেতা কর্মীরা মুসলিমদের কারণে করোনা ছড়াচ্ছে বলে মিথ্যা গুজব ছড়ানোতে প্রধান ভূমিকা রাখছে। এদের মধ্যে তাদের নেতা কেটি হপকিন্স, টমি রবিনসন্স (যার প্রকৃত নাম স্টিফেন ইয়াক্সলি লেনন), গেরার্ড ব্যাটেন মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
সম্প্রতি ইংলিশ ডিফেন্স লীগের প্রতিষ্ঠাতা টমি রবিনসন্স টেলিগ্রামে একটি পুরোনো ভিডিও প্রচার করে যাতে দেখানো হয় বার্মিংহামের একটি মসজিদ থেকে মুসল্লিরা নামাজ পড়ে বের হচ্ছে। মানুষ ওই ভিডিও প্রায় ১০ হাজার বার দেখে। ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে ওয়েস্ট মিডল্যান্ড পুলিশের কাছে অভিযোগের করা হয় মুসলিমদের কারনে করোনা ছড়িয়ে পড়ছে।
পরে পুলিশি তদন্তে জানা যায়, স্মলহিথ এলাকার যে মসজিদের ছবি দেখিয়ে তা খোলা বলে প্রচার করা হচ্ছে তা বন্ধ আছে এমনটি তা লকডাউনের পর কখনো খোলা হয়নি। একই ধরনের অভিযোগ করা হয় লন্ডন, লিডস, শ্রিউসবারী শহরসহ বিভিন্ন এলাকার মসজিদ বিষয়ে। এছাড়া কেটি হপকিন্স তার ফেসবুকে ভারতের মসজিদের একটি ভিডিও শেয়ার করে তা হাম্বারসাইড পুলিশকে টেগ করে। সেখানে সে লিখে, করোনার সময় ভারতের পুলিশ মসজিদের মানুষ জড়ো হওয়ায় তাড়িয়ে দিচ্ছে, তোমরা করবে না? আর গেরার্ড ব্যাটেন তার টুইটে লিখেন, মসজিদগুলো খোলা রাখা হোক। কারণ সরকার এদেশে মসজিদ বন্ধ করতে ভয় পায়। শুধু মুসলিমদের বিষয়ে অভিযোগ করেই ক্ষান্ত হয়নি চরমপন্থীরা। তারা সরকারের কাছে অভিযোগ করছে, দেশের জাতিগত সংখ্যালঘু বিশেষকরে মুসলিমদের অপরাধ দেখেও চোখ বন্ধ করে রাখে পুলিশ। আর একারণেই দেশে অপরাধ ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের মতে বর্তমানে দেশে ছড়িয়ে পড়া করোনার এক চতুর্থাংশের কারণ হচ্ছে মুসলিমরা।
বার্মিংহাম সিটি ইউনিভার্সিটির তদন্ত প্রতিবেদনে ধারণা করা হচ্ছে , চরমপন্থীরা রমজানের সময় মুসলিমদের বিষয়ে আরো অভিযোগ নিয়ে গুজব ছড়াবে। কারন রমজানে সাধারনত মুসলিমরা মসজিদে বেশি নামাজ পড়ে আর তারা ইফতারে একে অপরের বাসায় খাবার নিয়ে যায়। এছাড়াও মুসলিমদের খবর নিয়ে কাজ করা সংগঠন দ্যা সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং ধারনা করছে, আগামী সপ্তাহে শুরু হওয়া রমজানের সময় মুসলিমদের প্রতি বেশি অভিযোগ করা হবে। কারণ রমজানে মুসলমানরা একে অপরের সাথে বেশি সাক্ষাত করে যার কারনে করোনা ছড়িয়ে পড়ার বেশি আশঙ্কা থাকে। তবে তাদের ধারণা ঠিক হবে না বলে নিশ্চিত করেছে মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেন। তারা জানিয়েছে, চরমপন্থীদের অভিযোগ ভয়ঙ্কর এবং মিথ্যা। আর সংস্থার পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে সবাইকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে রমজানে বাসায় নামাজ পড়ার জন্য। এছাড়া অন্যান্য ইবাদতে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করার জন্য।
চরমপন্থীরা মুসলিমদের বিষয়ে ঘৃণা ছড়িয়েই ক্ষান্ত হয়নি। তারা ঘোষণা দিয়েছে লকডাউন উঠে গেলে মসজিদে হামলা করে তা গুড়িয়ে দিবে। এছাড়া তারা লকডাউন চলাকালীন বিভিন্নস্থানে মুসলিমদের উপর নানা ধরনের খারাপ আচরণ করছে। জানা যায়, একটি সুপারমার্কেটে হিজাব পরা এক মহিলা তার স্বামীকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় অপরিচিত এক লোক ওই দম্পত্তিকে দেখিয়ে তার বন্ধুকে বলছে, ঐ যে দেখ বোমা যাচ্ছে। হিজাব পরা মহিলাকে যে বোমা বলা হচ্ছে তা ওই দম্পত্তির বুঝতে সমস্যা হয়নি। পরে তারা ওই বিষয়টি পুলিশের কাছে রিপোর্ট করে। মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা আরেক ঘটনায় জানা যায়, এক সাদা ব্যক্তি হিজাব পরা এক নারীর মুখের কাছে এসে জোরে কাশি দেয়। পরে ওই ব্যক্তি নিজেকে করোনায় আক্রান্ত বলে দাবি করে। এরকম শত শত মুসলিম বিদ্বেষী ঘটনা ঘটছে ব্রিটেনে। যার জন্য অধিকাংশ দায়ী ডানপন্থী চরমপন্থীরা।
ব্রিটেনে চরমপন্থীদের মুসলিমবিদ্বেষী কাজের বিষয়ে রোক্সানা খান জানান, এর আগেও ডানপন্থী চরমপন্থীরা এখানকার মুসলিমদের উপর হামলা করতে উদ্যত হয়েছিল। আর তাদের গুজবের কারণে অনেকে ইসলামবিদ্বেষী নয় কিন্তু ওসব মিথ্যা সংবাদ দেখছে এবং সত্য বলে গ্রহণ করছে। যা পরে ইসলামবিদ্বেষে কাজ করতে পারে। মুসলিমদের প্রতি এই মিথ্যা প্রচারণা এখনই তেমন প্রভাব না পড়লেও ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর পরিণাম হতে পারে।
এদিকে ব্রিটেনে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় সংগঠন মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেন আগেই এক ঘোষণায় জানিয়েছে, করোনার সময় শুক্রবারের জুমার নামাজ সবাইকে বাসায় পড়ার অনুরোধ করা হয়েছে। আর মুসলিমরা তাই করছে। রমজানের চেয়ে শুক্রবারে মসজিদে বেশি মুসল্লি জমায়েত হয়। শুক্রবারের নামাজ যেহেতু মুসলমানরা বাসায় আদায় করছে তাই বলা যায় রমজানে তারা মসজিদে আদায় করার চিন্তা করবে না।
এদিকে অন্য এক প্রতিবেদনে জানা যায়, মুসলিমদের প্রতি করোনা ছড়ানোর অভিযোগ ছাড়াও চীনের নাগরিক এবং দক্ষিণ এশিয়ার বংশোদ্ভুত নাগরিকদের অভিযোগ করা হচ্ছে। এছাড়া জাতিসঙ্ঘের এক প্রতিবেদনে ব্রিটেনে করোনার সময় ইহুদিবিদ্বেষী মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইহুদিবিদ্বেষীরা প্রচার করছে, ইহুদি ও অন্য সংখ্যালঘুদের কারণে ব্রিটেনে করোনা বেশি ছড়িয়ে পড়ছে।