যেভাবে আবিষ্কার করা হয় জীবাণুর টিকা
যেভাবে আবিষ্কার করা হয় জীবাণুর টিকা - সংগৃহীত
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) দ্বারা সংক্রমিত ব্যাধিটির প্রাদুর্ভাব গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান নগরীতে প্রথম শনাক্ত করা হয়। এরপর গত ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটিকে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বিশ্বে এই রোগে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং বহু লোক মৃত্যুবরণ করছে। যেহেতু কার্যকরী কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন এখনও আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি, তাই শিগগিরই এর সংক্রমণ রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। গবেষকদের মতে, একটি নতুন ওষুধ বা ভ্যাকসিন বানানো ও বাজারে আনা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রথম পর্যায় থেকে চতুর্থ পর্যায়ের তৃতীয় ধাপ পর্যন্ত অর্থাৎ ওষুধ আবিষ্কার থেকে তা মানুষের দেহে পরীক্ষায় সময় লাগে প্রায় ১০ বছর। চারটি পর্যায়ে একটি নতুন ড্রাগ বা ওষুধ মানবদেহে ব্যবহারের জন্য উপযোগী হয়। প্রথম পর্যায় : নতুন ওষুধ আবিষ্কারের জন্য গবেষণা। দ্বিতীয় পর্যায় (প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল) : ওষুধটি নিরাপদ কি না তা দেখার জন্য প্রাণীর দেহে পরীক্ষা।
সাধারণত ইঁদুর বা গিনিপিগ জাতীয় প্রাণির দেহে পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। তৃতীয় পর্যায় (ক্লিনিকাল ট্রায়াল) : ওষুধটি নিরাপদ কি না ও কার্যকারিতার জন্য মানবদেহে পরীক্ষা। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল তিনটি ধাপে হয়ে থাকে। প্রথম ধাপ : ২০ থেকে ১০০ জন রোগহীন মানুষের শরীরে পরীক্ষা করা হয়। এই ধাপে দেখা হয়, নতুন ওষুধের মাত্রা বা ডোজ সর্বোচ্চ কী পরিমাণে মানব শরীর নিতে পারে। দেখতে হয়, ওষুধের প্রতিক্রিয়া কতটা সময় থাকে শরীরে। ফলাফল আশাব্যঞ্জক হলে পরবর্তী ধাপ শুরু হয়। দ্বিতীয় ধাপে পরীক্ষা করা হয় রোগীদের শরীরে। রোগভেদে রোগীর সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০ বা এর বেশিও হতে পারে। রোগ নিরাময়ক্ষমতা দেখা হয় এই ধাপে, সেই সঙ্গে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। তৃতীয় ধাপে ওষুধটির কার্যকারিতা এবং অপ্রত্যাশিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা হয়। এখানে রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় হাজারে (প্রায় ৩০০-৩০০০ মানবদেহে পরীক্ষা)। একাধিক দেশে চালানো হয় এই পরীক্ষা। চতুর্থ পর্যায়ে মানবদেহে ব্যবহারের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে নতুন ওষুধ বাজারজাত করার আবেদন করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই আবেদন প্রথম করা হয় আমেরিকায়। তারপর ইউরোপ, জাপান, চীন ও অস্ট্রেলিয়ায়। আবেদন করা হলেই যে অনুমোদন দেয়া হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় এ পর্যন্ত যেসব ওষুধের ব্যবহার এবং কার্যকারিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেসব ওষুধের জেনেরিক হচ্ছে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, ক্লোরোকুইন, এজিথ্রোমাইসিন, ফেভিপিরাভির, রিবাভাইন, টোসিলিজুমাব, রেমডেসিভির ও লোপিনাভির-রিটোনাভির। ফ্রান্সের আইএইচইউ-মেডিটারানি ইনফেকশন এর একদল গবেষক দাবি করেছেন, এন্টিম্যালেরিয়াল ড্রাগ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন এবং অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগ এজিথ্রোমাইসিন একসাথে করোনা চিকিৎসায় কাজ করে। গবেষকরা তাদের প্রকাশিত (মার্চ, ২০২০) গবেষণাপত্র ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্টস’- এ ওষুধগুলো দ্বারা ল্যাবরেটরিতে করোনাভাইরাসকে ধ্বংস করতে সফল হয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। সম্প্রতি আমেরিকার জনপ্রিয় ফক্সনিউজ গবেষকদের এই সফলতার খবর ফলাও করে প্রচার করেছে।
আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এই ওষুধ দু’টিকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ছাড়ার অনুমতি না দিলেও আমেরিকার চিকিৎসকেরা ক্ষেত্র বিশেষে জরুরি প্রয়োজনে প্রেসক্রাইব করার আগ্রহ জানিয়েছেন। সম্প্রতি কানাডাও এই ওষুধগুলো করোনা প্রতিষেধক এবং চিকিৎসায় আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার শুরু করেছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এ ওষুধের কার্যকারিতার কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই। বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোভিড-১৯-এর চিকিৎসায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া যেকোনো ওষুধ সেবন না করার জন্য সতর্কবাণী গণমাধ্যমের মাধ্যমে জনগণকে জানিয়েছে। গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত (১৮ মার্চ, ২০২০), ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য ব্যবহৃত জাপানের ফুজিফিল্মের সহযোগী প্রতিষ্ঠান তোইয়ামা কেমিক্যাল কোম্পানির ওষুধ ‘ফেভিপিরাভির’ করোনাভাইরাস নিরাময়ে কার্যকর বলে জানিয়েছে চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশের ওষধ প্রশাসনও আগ্রহী কোম্পানীগুলোকে (বেক্সিমকো, স্কয়ার, বিকন, রেনাটা, এসকেএফ ও ভেরিতাস) এ ধরনের ওষুধ উৎপাদনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে। মার্কিন বায়ো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি গিলিয়েড সায়েন্সেস চীনা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তৃতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় মানুষের শরীরে কার্যকরী রেমডিসিভির নামে ইবোলা চিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টি ভাইরাল ড্রাগের পরীক্ষা চালায়।
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে (এনইজেএম) প্রকাশিত (এপ্রিল, ২০২০) এক প্রতিবেদনে ড্রাগটির প্রয়োগ উৎসাহজনক ফল বলে উল্লেখ করেছে। চলতি মাসে প্রকাশিত জার্নাল অব বায়োলজিক্যাল কেমিস্ট্রিতে আমেরিকার আলবার্টা ইউনিভার্সিটির গবেষকরা প্রকাশ করেছেন যে, অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ রেমডেসিভিয়ার করোনভাইরাসের আরএনএ প্রতিলিপিতে বাধা দিয়ে মারাত্মক এবং তীব্র শ্বাসতন্ত্রের রোগসিন্ড্রোম প্রতিরোধ করে। চীনের বেইজিংয়ে ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে গিলিয়েড এ ওষুধটির তৃতীয় পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা চালাবে। যেহেতু নতুন ওষুধ আবিষ্কার থেকে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে বাজারে আনতে কয়েক বছরের প্রয়োজন, তাই বর্তমানে প্রচলিত ওষুধের কার্যকারিতা স্বল্প সময়ের মধ্যে পরীক্ষা করে শুধু মানবদেহে নিরাপদ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন ওষুধগুলোকেই বর্তমানে ব্যবহার করা যেতে পারে। আর এ জন্য সব দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে একসাথে কাজ করে যেতে হবে।
যেকোনো সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় সবচেয়ে কার্যকরী হচ্ছে ভ্যাকসিন। কিন্তু জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত রোগটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা না থাকলে এবং রোগটির ভ্যাকসিন বিদ্যমান না থাকলে নতুন করে সংক্রমিত রোগের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন উৎপাদন থেকে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যন্ত অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। যেকোনো সংক্রামক জীবাণুর দ্বারা তৈরি রোগের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে জীবাণুটি কিভাবে রোগের উৎপত্তি ঘটায় এবং ভ্যাকসিন উদ্ভাবন সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান এবং ধারণা থাকা প্রয়োজন। এই বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্য সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
ভ্যাকসিন হচ্ছে একটি এজেন্ট বা রাসায়নিক যৌগ যা জৈবিক প্রস্ততির মাধ্যমে তৈরি করা হয়, যা একটি বিশেষ সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে ইম্যুনিটি (নিরাপত্তা) প্রদান করে থাকে। ভ্যাকসিনে সাধারণত যে এজেন্ট থাকে তা একটি রোগজনিত অণুজীবের অনুরূপ এবং এটি প্রায়ই জীবাণু, তার টক্সিন বা তার পৃষ্ঠতল প্রোটিনগুলোর দুর্বল বা নিহত ফর্ম থেকে তৈরি করা হয়। ভ্যাকসিন মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উদ্দীপিত করার মাধ্যমে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার মতো রোগজীবাণুগুলো শনাক্ত করতে এবং লড়াই করতে সহায়তা করে, যা পরে তাদের সৃষ্ট রোগ থেকে আমাদের রক্ষা করে। ভ্যাকসিনগুলো প্রোফিল্যাকটিক (কোনো প্রাকৃতিক বা ‘বন্য’ জীবাণু দ্বারা ভবিষ্যতে সংক্রমণের প্রভাবগুলো রোধ বা প্রশমিত করতে পারা) বা থেরাপিউটিক (জীবাণু দ্বারা কোনো রোগ সৃষ্টি হলে তার চিকিৎসা করতে পারা যেমন, ক্যান্সারের বিরুদ্ধে টিকা) হতে পারে। ভ্যাকসিনেশন বা টিকাদান রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে ভ্যাকসিনগুলো ২৫টিরও অধিক দূষিত বা প্রাণঘাতী রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। যার মধ্যে হাম, পোলিও, টিটেনাস, ডিপথেরিয়া, মেনিনজাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টিটেনাস, টাইফয়েড ও জরায়ুর ক্যান্সার রয়েছে।
ভ্যাকসিনগুলোতে মৃত বা নিষ্ক্রিয় অণুজীব বা এগুলো থেকে উৎপন্ন বিশুদ্ধ উপাদান থাকে। বেশির ভাগ ভ্যাকসিনগুলো অণুজীব থেকে নিষ্ক্রিয় বা সংশ্লেষযুক্ত যৌগগুলো ব্যবহার করে তৈরি করা হয়, সিনথেটিক ভ্যাকসিনগুলো মূলত বা সম্পূর্ণ সিনথেটিক পেপটাইড, কার্বোহাইড্রেট বা অ্যান্টিজেন সমন্বিত থাকে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হচ্ছে। (১) অক্রিয়াশীল (ইনঅ্যাকটিভেটেড) ভ্যাকসিন : এ ধরনের ভ্যাকসিনে নিষ্ক্রিয় জীবাণু থাকে। মারাত্মক ক্ষতিকর জীবাণুগুলোর রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষমতা বিশেষ প্রক্রিয়ার (রাসায়নিক, তাপ বা বিকিরণ) মাধ্যমে ধ্বংস করে এন্টিজেন গুণাগুণ অক্ষুণ্ন রেখে এই ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়।
উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে :
ব্যাকটেরিয়াল-টাইফয়েড, কলেরা, পারটুসিস; ভাইরাল-রেবিস, হেপাটাইটিস-বি, কিছু ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন। (২) ক্ষয়িত (অ্যাটিনুয়েটেড) ভ্যাকসিন : ভ্যাকসিনে জীবন্ত ক্ষয়িত অণুজীব থাকে। এই ভ্যাকসিনগুলোতে সক্রিয় ভাইরাস বিদ্যমান থাকে কিন্তু তাদের ভাইরাসজনিত বৈশিষ্ট্যগুলোকে একটি বিশেষ অবস্থার মাধ্যমে অক্ষম করে রাখা হয় অথবা জীবাণুর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত তবে কম বিপজ্জনক জীবাণু ব্যবহার করে বিস্তৃত প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করা হয়। উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে : ব্যাকটেরিয়াজাত - বি সি জি, প্লেগ, টাইফয়েড ওরাল; ভাইরাসজাত ও মুখে সেব্য - পোলিও, হাম, পীতজ্বর; রিকেটসিয়াল - এপিডেমিক টাইফাস। (৩) টক্সয়েড ভ্যাকসিন : টক্সয়েড ভ্যাকসিনগুলো অণুজীব থেকে উৎপন্ন রোগসৃষ্টিকারী বিষাক্ত যৌগকে নিষ্ক্রিয়করণের মাধ্যমে তৈরি করা হয়।
উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে : টিটেনাস ও ডিপথেরিয়া। (৪) সাবইউনিট ভ্যাকসিন : প্রোটিন সাবইউনিট- দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাতে একটি নিষ্ক্রিয় বা এটেনুয়েটেড অণুজীবের পরিবর্তে, এর একটি খণ্ড প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারে। উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে : হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের বিরুদ্ধে সাব ইউনিট ভ্যাকসিন, যা কেবল ভাইরাসের পৃষ্ঠতলের প্রোটিনের সমন্বয়ে গঠিত; হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের (এইচপিভি) বিরুদ্ধে ভাইরাস জাতীয় কণা (ভিএলপি) ভ্যাকসিন, যা ভাইরাল মেজর ক্যাপসিড প্রোটিন দ্বারা গঠিত এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ভ্যাকসিন হচ্ছে হিমাগ্লুটিনিন ও নিউরামিনিডেস সাবইউনিট। সাবইউনিট ভ্যাকসিন প্লেগ টিকাদানের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। (৫) অণুবন্ধী (কনজুগেট) ভ্যাকসিন : কিছু ব্যাকটেরিয়ার বাইরের কোট হিসেবে পলিস্যাকারাইড থাকে, যা খুব কম ইমিউনোজেনিক।
(৬) পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন : বেশ কয়েকটি উদ্ভাবনী ভ্যাকসিনের বিকাশ এবং ব্যবহারেও রয়েছে : (ক) ডেনড্রিটিক সেল ভ্যাকসিন - ডেন্ড্রিটিক কোষগুলোকে অ্যান্টিজেনের সাথে যুক্ত করে অ্যান্টিজেনকে দেহের অণুচক্রিয়া রক্ত কোষে এমনভাবে উপস্থাপন করে, যাতে দেহের ইম্যুনিটি (নিরাপত্তা) বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত সাধন করতে পারে। এই ভ্যাকসিনগুলো মস্তিষ্কের টিউমারগুলোর চিকিৎসার জন্য কিছু ইতিবাচক প্রাথমিক ফলাফল দেখিয়েছে এবং ম্যালিগন্যান্ট মেলানোমাতেও পরীক্ষা করা হয়। (খ) ডিএনএ ভ্যাকসিনেশন, যা একটি বিকল্প এবং পরীক্ষামূলক পদ্ধতি যেখানে সংক্রামক রোগীর ডিএনএ থেকে ডিএনএ ভ্যাকসিন তৈরি করার চেষ্টা চলছে। প্রস্তাবিত প্রক্রিয়াটি হলো ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ মানব বা প্রাণীর কোষগুলোতে সন্নিবেশ করা হয়। (গ) রিকম্বিন্যান্ট ভেক্টর- একটি জীবাণুর দেহের ভেতরে অন্যটির ডিএনএ সংমিশ্রণ করার মাধ্যমে জটিল সংক্রমণ দ্বারা তৈরি রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করা যেতে পারে। এর একটি উদাহরণ হল মার্কের জন্য লাইসেন্সভুক্ত আরভিএসভি-জেবোভ ভ্যাকসিন, যা ২০১৮ সালে কঙ্গোর ইবোলা মোকাবেলায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। (ঘ) আরএনএ ভ্যাকসিন- একটি অভিনব ধরনের ভ্যাকসিন, যা নিউক্লিক অ্যাসিড আরএনএ দ্বারা গঠিত যা লিপিড ন্যানো পার্টিকেলের মতো ভেক্টরের মধ্যে গাঁটবন্দী করা হয়।
ভ্যাকসিন উৎপাদনের সময় রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাটিকে নষ্ট করে দিয়ে অ্যান্টিবডি তৈরি ঠিক রাখা হয়। ফলে ভ্যাকসিন দেহে প্রবেশ করানোর পরে দেহে রোগের কারণ হয় না, উল্টো রোগটি যেন না হয় তার জন্য বিশেষ অ্যান্টিবডি তৈরি করতে থাকে। আরেকটি সুবিধা হলো এই জীবাণুগুলো মেমরি সেল গঠন করে ফলে পরবর্তীতে একই জীবাণু আবার প্রবেশ করলে সহজে শনাক্ত করতে পারে। ভ্যাকসিন উৎপাদন বিভিন্ন পর্যায়ে হয়ে থাকে এবং প্রতিটি পর্যায়ে সঠিক মাননিয়ন্ত্রণ কঠোরভাবে সুরক্ষা করতে হয়। প্রথমত, অ্যান্টিজেনগুলো কাঁচামাল ব্যবহার করে তৈরি করা হয়।
ভাইরাসকে জন্মানো হয় মুরগির ডিমের মতো প্রাথমিক কোষগুলোতে (উদাহরণ, ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য) অথবা অবিচ্ছিন্ন সেল লাইনে যেমন কৃত্রিমভাবে তৈরি মানব কোষে (যেমন, হেপাটাইটিস এ)। ব্যাকটেরিয়া বায়োরিয়েক্টরগুলোতে জন্মানো হয় (উদা: হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি)। তেমনি ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া থেকে প্রাপ্ত রিকম্বিনেন্ট প্রোটিন উৎপন্ন হতে পারে ইস্ট, ব্যাকটেরিয়া বা কৃত্রিমভাবে তৈরি কোষ থেকে। অ্যান্টিজেন তৈরি হওয়ার পরে, এটি তৈরির জন্য ব্যবহৃত কোষ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ভৌত ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অ্যান্টিজেন থেকে দূষিত পদার্থগুলোকে সরানো হয়। ইমিউনোলজিকাল বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার সময় রোগজীবাণু দমন করা হয়। সক্রিয় অ্যান্টিজেনিক পদার্থগুলোকে একসাথে একত্রিত করা হয়। সব উপাদানকে একসাথে করে গলানো হয়। অতঃপর ভ্যাকসিনটি একটি ভায়াল বা একটি সিরিঞ্জে পূর্ণ করা হয়। পরিশেষে ভ্যাকসিনটি প্রয়োজন অনুসারে সংযোজক, স্ট্যাবিলাইজার ও প্রিজারভেটিভ যুক্ত করে তৈরি করা হয়।
উপরের আলোচনা থেকে এটি পরিষ্কার বোঝা যায়, সংক্রমণজনিত রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কার একটু জটিল। এতে যেমন চ্যালেঞ্জ আছে, ঠিক তেমনি ভ্যাকসিন উৎপাদনের পরে পর্যাপ্ত রোগীর ওপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দেয়া এবং বিশ্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে অনুমোদন পাওয়া এবং সবশেষে এর বিপণন ও মুনাফা অর্জনও এক কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। সংক্রমণজনিত রোগের ভ্যাকসিন তৈরির প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে ২০১৭ সালে বিভিন্ন দেশ এবং বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে অসলোভিত্তিক ‘দ্য কোয়ালিশন ফর প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস’ (সিইপিআই) নামের একটি সংস্থার জন্ম হয়। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, নরওয়ে, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের মতো দেশের সাথে আছে বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন; আছে কিছু ওষুধ কোম্পানি। সিইপিআই এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ভবিষ্যতে বিভিন্ন রোগের কথা চিন্তা করে প্রস্তুতি নেয়া এবং এ ধরনের রোগের মহামারী ঠেকানো। সিইপিআই নতুন করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিতে চীনের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি), যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (এনআইএইচ), অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডভিত্তিক ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নোভাভ্যাক্স ও পেনসালভানিয়ার বায়োটেক ফার্ম ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যালসকে সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী সারা বিশ্বে ৭০টি করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কাজ অতি দ্রুততার সাথে এগিয়ে চলছে। তিনটি ওষুধ কোম্পানি যথা চীনের তিয়ানজিনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ক্যানসিনো বায়োলজিকস, মার্কিন ড্রাগ প্রস্তুতকারক মোদারনা ইনক এবং ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যালস ইনক মানুষের মধ্যে ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালার্জি ও সংক্রামক রোগসংক্রান্ত জাতীয় সংস্থা (এনআইএআইডি) মোদারনা কোম্পানির সাথে মিলে সিয়াটল নগরীতে ৪৫ জন স্বাস্থ্যবান পূর্ণবয়স্ক মানুষের ওপর আরএনএ (mRNA-১২৭৩) নামের একটি ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রথম ধাপের পরীক্ষা শুরু করেছে। চীনের তিয়ানজিন নগরীতে অবস্থিত ক্যানসিনো বায়োলজিক্স ইনকরপোরেটেড প্রতিষ্ঠানটি একটি এডি৫-এনসিওভি (Ad5-nCoV) নামের ভ্যাকসিনের প্রথম ধাপের সুরক্ষামূলক পরীক্ষা (সেফটি ট্রায়াল) চীনের উহান নগরীতে ১০৮ জন স্বাস্থ্যবান পূর্ণবয়স্ক মানুষের ওপর শুরু করেছে।
এ পরীক্ষা ২০২০ সালের শেষ পর্যন্ত চলতে পারে। ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যালের প্রস্তুতকৃত ভ্যাকসিনের (কোড নেম INO-4800) ক্লিনিকাল ট্রায়াল যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া ও মিসৌরির কান্সাস সিটিতে শুরু হয়েছে। এ ছাড়াও আরো অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা ভ্যাকসিন আবিষ্কার এবং পরীক্ষার কাজ করে যাচ্ছে, এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিভিত্তিক ওষুধ কোম্পানি জনসন অ্যান্ড জনসন, চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মার্কিন বায়ো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি গিলিয়েড সায়েন্সেস নামের একটি প্রতিষ্ঠান, বেইজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি, চীনভিত্তিক ক্লোভার বায়োফার্মাসিউটিকালস, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশনের (সিএসআইআরো) নাম উল্লেখযোগ্য। এরই মধ্যে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মোকাবেলার জন্য এবং এর সঠিক ওষুধ ব্যবহারের জন্য ‘ন্যাশনাল গাইডলাইন অন ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট অব করোনাভাইরাস ডিজিসেস ২০১৯ (কোভিড-১৯)’ প্রণীত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছে।
উপরে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার গবেষণার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এটা প্রতীয়মান হয় যে, ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করে করোনা সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকরী কোনো ভ্যাকসিন আসতে কয়েক মাস থেকে এক বছরের বেশি সময় লেগে যেতে পারে। তাই আমাদেরকে করোনা ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত নিজেদেরকে সুরক্ষা ও সুস্থ সবল থাকতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী মেনে চলা একান্ত জরুরি।
প্রফেসর ড. মামুনুর রশীদ
ফার্মেসি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
mamun69jp@yahoo.com