প্যাকেট করা লাশ খুলে মাতম : নারায়ণগঞ্জ যেভাবে করোনার ক্লাস্টার নগরী
প্যাকেট করা লাশ খুলে মাতম : নারায়ণগঞ্জ যেভাবে করোনার ক্লাস্টার নগরী - সংগৃহীত
সোমবার সকালে নারায়ণগঞ্জ স্বাস্থ্য বিভাগের দেয়া তথ্যমতে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসে মারা গেছে ৩০ জন। আক্রান্ত হয়েছে ৪১১ জন। তবে দিন দিন বেড়েই চলছে করোনা ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা। পাশাপাশি বাড়ছে নতুন নতুন আক্রান্ত রোগী। কে কখন আক্রান্ত হবে তা যেমন বলা মুশকিল। তেমনি করোনার কারণে পুরোপুরি বিপর্যস্ত বাণিজ্যিক নগরী।
উদ্বেগ-উৎকন্ঠা পুরো জেলা জুড়ে। শুধু তাইনয় সারা দেশের কাছে নারায়ণগঞ্জ জেলা এখন আতঙ্ক। বিভিন্ন জেলা প্রশাসন থেকে কঠোর নজরদারি আর সতর্কতা জারি করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ থেকে আগন্তুক মানুষের প্রবেশের বিষয়ে
কারণ মারণঘাতী করোনাভাইরাসের হটস্পট এখন নারায়ণগঞ্জ। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়ানোর কেন্দ্র (এপিসেন্টার) এই নারায়ণগঞ্জে একদিকে যেমন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে অন্যদিকে এ জেলা থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। সারাদেশের অন্তত ১৫/২০ জেলায় সংক্রমিত প্রথম ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জ ফেরত।
এছাড়া নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়ি পালাচ্ছে বিভিন্ন জেলার মানুষ। আবার প্রতিরাতেই পালাতে গিয়ে পুলিশের হাতে আটকও হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার মানুষ আটক হয়েছে পালিয়ে যাওয়ার সময়।
নারায়ণগঞ্জে এমন পরিস্থিতি কেনো? সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত কিছু বলা না হলেও এর নেপথ্যে রয়েছে নানা কারণ। এরমধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে, ঘনবসতি ও শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকা, বিদেশ ফেরত বিশেষ করে ইতালি ফেরত প্রবাসীদের অবস্থান পুরোপুরি চিহ্নিত করতে না পারা, করোনায় প্রথম মৃত নারীর লাশ কুর্মিটোলা থেকে প্যাকেটবন্দি করে দেয়ার পর সেই প্যাকেট খুলে লাশের গোসল দেয়া, আক্রান্ত ব্যক্তির অবাধ বিচরণ, গত ৪ এপ্রিল লাখো গার্মেন্টস শ্রমিকের নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ, লকডাউনে বিলম্ব এবং প্রশাসনের উদাসীনতা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে. মূলত ৫ কারণে করোনার হট স্পট নারায়ণগঞ্জ।
শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রসিদ্ধ নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন জেলার মানুষের বসবাস। সব মিলিয়ে প্রায় ৯০ লাখ মানুষের আবাসস্থল নারায়ণগঞ্জ। অল্প জায়গায় বিশেষ করে শিল্পাঞ্চল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলায় মানুষ গিজগিজ করে। তবে শহরের কলকারখানার একটি বড় অংশ আবার শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড় বন্দরে থাকে। ৭ এপ্রিল নারায়গঞ্জকে হটস্পট ঘোষনা করা হয়।
কয়েকজন চিকিৎসক জানান, বিদেশ থেকে যারা এসেছেন, তাদের কোয়ারেন্টিন ঠিকভাবে নিশ্চিত করা যায়নি। এমনকি অনেকের নাম ঠিকানাও ঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যায়নি। প্রথমেই আমরা সেই সুযোগটা মিস করেছি। এছাড়া ‘টেস্ট করার সক্ষমতা থাকার পরও এতোদিন পরে টেস্ট বাড়ানো হয়েছে। প্রথম থেকে যদি সেটা করা হতো, তাহলে পরিস্থিতি আরো ভালোভাবে ধরা যেতো, ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হতো। কিন্তু সেটাও ঠিক সময়ে করা হয়নি।’
তারা বলেন, ‘যাদের শনাক্ত করা হয়েছে, তাদের কন্টাক্ট ট্রেসিংও ঠিকভাবে হয়নি। তিনি কোথায় কোথায় গিয়েছেন, কাদের সঙ্গে মিশেছেন, কী করেছেন, সব বিশ্লেষণ করা উচিত ছিল। তাহলে ঝুঁকি অনেক কমতো। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি-সবাইকে নিয়ে সমন্বিতভাবে সেটা করা উচিত ছিল।
আইইসিডিআরের তথ্যমতে, দেশে প্রথম ২ পুরুষ ও এক নারী করোনা শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। পুরুষ দুজন ইতালি প্রবাসী। স্বামীর সংস্পর্শে এসে ওই নারী সংক্রামিত হয়। তারা তিনজনই নারায়ণগঞ্জ শহরের ব্যস্ততম ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র টানবাজার এলাকায় আল জয়নাল প্লাজায় থাকতেন। যদিও পরে তারা সুস্থ হয়েছেন। প্রবাসী এই ব্যক্তি বিদেশ থেকে আসার ৫ দিন পর তার করোনা পজেটিভ আসে। এই ৫ দিন সে তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিশেছে। হোটেল-রেস্তোরাঁয় গিয়েছেন। শহর ঘুরে বেড়িয়েছেন। শপিংয়ে গেছেন স্ত্রীকে নিয়ে। মোটকথা যত জায়গায় ওই ৫ দিন সে গিয়েছে সব জায়গায় সে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে। কিন্তু কোথায় কোথায় এবং কার কার মধ্যে এটা ছড়িয়েছে তা চিহ্নিত করা হয়নি।
গত ৩০ এপ্রিল করোনার উপসর্গ নিয়ে কুর্মিটোলা হাসপাতালে প্রথম মারা যায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বন্দরে ২৩নং ওয়ার্ডের রসুলবাগে পুতুল (৫০) নামে এক নারী। ২ এপ্রিল তার নমুনা পরীক্ষায় করোনা পজেটিভ আসে। কিন্তু এই নারী অসুস্থ থাকা অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টরিয়া) হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। সেখানে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। হাসপাতালের সেবা প্রদানকারী চিকিৎসক, নার্স, এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার, প্রাইভেট ল্যাবের টেকনিশিয়ান, এক্সরে টেকনিশিয়ান, আয়া ও চেম্বার এসিস্ট্যান্ট আক্রান্ত হয়েছেন। অসুস্থ অবস্থায় তিনি শহরের পাইকপাড়ায় তার বাপের বাড়িতেও গিয়েছেন। সেখানে যারাই তার সংস্পর্শে এসেছে তারা সবাই সংক্রামিত হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। কুর্মিটোলায় মারা যাওয়ার পর ওই নারীর লাশ সেখান থেকে প্যাকেটবন্দি করে বলে দেয়া হয় প্যাকেট যাতে না খোলা হয়। এবং প্যাকেটবন্দি অবস্থায় দাফন করার জন্য নির্দেশনা দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু স্বজনরা বাড়িতে লাশ আনার পর প্যাকেট থেকে লাশ বের করে ফেলে। এসময় স্বজননা লাশ স্পর্শ করে কান্নাকাটি করে। প্রতিবেশীরা লাশ দেখেতে বাড়িতে আসে।
গত ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষনা করে। এতে করে বাংলাদেশ নিট ওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারাস অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) ও বিজেএমইএ গত ২৯ মার্চ জরুরি সভা করে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত গার্মেন্টস বন্ধ ঘোষণা করে। ছুটি বাড়ানোর ঘোষণা না দেওয়ায় কর্মস্থলে যোগ দিতে করোনার ঝুঁকি মাথায় নিয়েই পায়ে হেঁটে, রিকশা-ভ্যান ও পণ্যবাহী ট্রাকে চড়ে হাজার হাজার শ্রমিক নারায়ণগঞ্জ চলে আসেন। হাজারো শ্রমিকের সমাগমে অনেকেই সংক্রামিত হয়। যার প্রমাণ বিভিন্ন জেলায় আক্রান্ত হওয়া প্রথম ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জ ফেরত।
নারায়ণগঞ্জের প্রশাসনের উদাসীনতা। কারণ ৬ হাজার ২১ জন প্রবাসী শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলায় প্রবেশ করে। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন মাত্র ১ হাজার ২৫৯ জনের নাম ঠিকানা ও অবস্থান চিহ্নিত করতে পেরেছে। এবং তাদের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করেন। কিন্তু বিপুল সংখ্যক প্রবাসী হোম কোয়ারেন্টাইনের বাইরে রয়ে যায়। তাদের অবাধ বিচরণ বিভিন্ন এলাকার মানুষকে সংক্রামিত করেছে।
সরকারের সাধারণ ছুটির পরও জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ফ্যাক্টরী চালু ছিল, এখনো আছে। ওই সব ফ্যাক্টরীতে হাজারো শ্রমিকের মধ্যে কোন প্রকার সামাজিক দুরুত্ব বজায় রাখা হয়নি। ফলে একজন শ্রমিক সংক্রামিত হয়ে থাকলে সে আরো অনেককেই সংক্রামিত করেছে। এছাড়া কাচাবাজারে বিপুল পরিমান ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম নিয়ন্ত্রনে প্রশাসন থেকে কার্যকরী কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আবার ত্রাণ বিতরণ করার সময়ও ত্রাণদাতারা অসংখ্য মানুষের সমাগম ঘটিয়েছে লকডাউনের আগে। তখন একে অপরের সংস্পর্শে এসে অনেকেই সংক্রামিত হয়েছে। লকডাউন ঘোষণার ক্ষেত্রেও বিলম্ব হয়েছে। লকডাউন ঘোষণা করা হলেও অনেকে তা মানছেন না।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. ইমতিয়াজ জানান, দেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত শহরের জয়নাল প্লাজায় দুই ইতালি প্রবাসী। তারা দুজন দেশে আসার পর অন্তত ৫ দিন জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরেছেন। শহরের পপুলার হাসপাতালে জ্বর নিয়ে চিকিৎসা নিতে গিয়েই প্রথম চিকিৎসককে বলেন, তারা ইতালি থেকে এসেছেন। এর পর ওই চিকিৎসক তাদের কুর্মিটোলা হাসপাতালে পাঠালে সেখানে করোনা ধরা পড়ে। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের মাধ্যমেই এ জেলায় করানো ছড়িয়েছে।
এ ছাড়া করোনায় জেলায় প্রথম মৃত্যু হওয়া বন্দরের গৃহবধূর লাশ কুর্মিটোলা থেকে প্যাকেট করে দেয়া হয়। কিন্তু সেটি খুলে পরিবার স্বাভাবিকভাবেই জানাজা দেয়। এমনকি লাশকে গোসল করায় সিদ্ধিরগঞ্জের একটি পরিবারের লোকজন। অসুস্থ ওই নারীকে নিয়ে বাপের বাড়িও গিয়েছিলেন তারা।
সিভিল সার্জন ইমতিয়াজ আরো জানান, নারায়ণগঞ্জে গার্মেন্টস শ্রমিকরা ভাসমান। ঘোষিত ছুটি প্রত্যাহারের পর ৫ এপ্রিল দলে দলে নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ করেন তারা। এ ছাড়া জেলার লোকজনকে কিছুতেই লকডাউন মানানো যাচ্ছে না। আর এ কারণেই নারায়ণগঞ্জে এত দ্রুত করোনা ছড়াতে পারে বলে তার মত।