আজব গুজব তাজ্জব
আজব গুজব তাজ্জব - সংগৃহীত
নোয়াম চমস্কি বিশ্বখ্যাত বুদ্ধিজীবী। তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের সাথে আমেরিকার পরিচয় নতুন নয়। কয়েক বছর আগেই এই রোগজীবাণুর ওষুধ উদ্ভাবনের কাজ শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু মার্কিন সরকারের ভুলনীতিপ্রসূত উদাসীনতা ও বিলম্বের দরুণ করোনা মোকাবেলার প্রস্তুতি ছিল না কর্তৃপক্ষের। এর পরিণামে করোনায় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যুর শিকার হচ্ছে দুনিয়ার সর্বাপেক্ষা দাম্ভিক রাষ্ট্রটি। পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে গণ্য এ দেশের শক্তিহীনতা ও অসহায়ত্ব এখন প্রকট ও প্রমাণিত।
২০১৭ সালের একটি বিজ্ঞান সাময়িকী পড়ছিলাম এবার। ঢাকা থেকে বাংলায় প্রকাশিত ওই সাময়িকীতে করোনাভাইরাসের কথাও ছিল। অর্থাৎ এই ভাইরাস আমাদের জন্যও একেবারে নতুন নয়। তিন বছর আগের এ পত্রিকার কথা বাদ দিলেও বলতে হয়, গত জানুয়ারি থেকে দুই মাসের বেশি সময় পেয়েও আমরা কি এ বিপর্যয় মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়েছি অথবা এ জন্য কি আমাদের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা পর্যাপ্ত ছিল? অথচ দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা লকডাউন করা জেলা ও এলাকার সংখ্যা কেবলই বাড়ছে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এ মহাবিপদ থেকে আমরা কি শিক্ষা নিচ্ছি? ‘এক মাঘে শীত যায় না।’ আর যে অপরিসীম করুণা এখন জাতির একমাত্র ভরসা। তা করোনা নয়, একমাত্র পরম করুণাময়ের। আন্তরিকভাবে ঐশী ক্ষমা প্রার্থনা করে কেবল তাঁর কাছেই সাহায্য চাইতে হবে। তাঁর দয়া বা রহমতই এই শাস্তি বা পরীক্ষা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়।
পাশের দেশ ভারতের অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে ভালো নয়। শুক্রবার পর্যন্ত প্রায় ৪৫০ জন মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন কয়েক হাজার। ভারতের টিভি চ্যানেলে যতই বিজ্ঞাপনে প্রচার করা হোক, ‘করোনাভাইরাসকে ভয় পাবেন না এবং ফান ভাইরাস’ অনুষ্ঠান উপভোগ করুন। বাস্তবে পরিস্থিতি ভীতিপ্রদ এবং এ অবস্থায় ‘ফান’ বা কৌতুক উপভোগ করা কঠিন।
বাংলাদেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের শেষ নেই। কোনোটা হিন্দি, কোনোটা ইংরেজি, কোনোটা বাংলা। আবার হিন্দি চ্যানেলে বাংলায় ডাবিং করে প্রচারের নজিরও রয়েছে। কিছু আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেল ভারতীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে ওই দেশের অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। এ জন্য ভারতভিত্তিক চ্যানেল খুলেছেন তারা। তাদের হিন্দি-ইংরেজি মেশানো ভাষার মনোহর বিজ্ঞাপন আর রকমারি অনুষ্ঠান দেখে বাংলাদেশের একশ্রেণীর দর্শক সাময়িক আনন্দ পেলেও কোভিডের হানা মোকাবেলার মওকা পাচ্ছে না ভারতের মোদি সরকার। বরং শ্রমজীবীদের গায়ে স্প্র্রে করে বদনাম কুড়াচ্ছে। আমাদের দেশের অনেক নারী-পুরুষ এখন লকডাউনের মাঝে, ঘরবন্দী থেকে সময় কাটাতে ভারতীয় চ্যানেলের দিকে আরো বেশি করে ঝুঁকছেন। এই প্রেক্ষাপটে কোনো কোনো সচেতন নাগরিক ব্যঙ্গরসিকতা করে বলছেন, চার দিকে যত অন্যায়-অশান্তি, তাতে মন একটুও ভালো থাকার উপায় নেই। তাই মনে শান্তি পাওয়ার একমাত্র দাওয়াই ভারতীয় টিভি চ্যানেলের বর্ণাঢ্য সিরিয়াল দেখা। টয়লেট-বিরল দেশটার বাস্তবতার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এসব রঞ্জিত-অতিরঞ্জিত অনুষ্ঠানে গৃহবধূরা দিন-রাত সাজগোজ করা অবস্থায় থাকেন। কুসংস্কার আর গোঁড়ামি তাদের জীবনের অঙ্গ।
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল বা আইএমএফ বলেছে, ‘চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অনেক কমে মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। আগামী বছরেও পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকার সমূহ শঙ্কা। সারা বিশ্বের অর্থনীতি যে ভয়াবহ দুর্যোগের শিকার হতে যাচ্ছে, সে হুঁশিয়ারিও দিয়েছে আইএমএফ। বিশ্ব মহামন্দার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা বিশ্ব সংস্থা হিসেবে জাতিসঙ্ঘ ব্যক্ত করেছে। এই হুঁশিয়ারি তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। যা হোক, আমাদের অর্থমন্ত্রী প্রত্যাশিতভাবেই দ্বিমত পোষণ করেছেন আইএমএফের ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে। আগের অর্থমন্ত্রীও এ রকম ভূমিকা রাখতেন। এতে ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনীতির কোনো ফায়দা হবে কি না, জানা নেই। জাতীয় অর্থনীতির ক্ষতি না হওয়াই সবার কাম্য। এবার প্রথমে যখন আইএমএফের সতর্কবাণী প্রচারিত হলো মিডিয়ায়, তখন কোথাও বলা হলো, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্ধেকেরও বেশি কমে মাত্র ২-৩ শতাংশে নামতে পারে। আবার কোথাও বলা হয়েছে, দেশের প্রবৃদ্ধি বর্তমানের চেয়ে ২ শতাংশ কমতে পারে। অর্থাৎ বর্তমান ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের কাছে নামতে পারে। পরে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, আইএমএফের পূর্বাভাস হলো, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি মাত্র ২ শতাংশে নামতে পারে। প্রশ্ন হলো, টিভি চ্যানেলে আগে কেন ভুল প্রচারণার মাধ্যমে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল? এটা উদ্দেশ্যমূলক, না কি নেহায়েত অনুবাদের ভ্রান্তি?
মানুষ মানুষের জন্য
প্রখ্যাত ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী ড. ভূপেন হাজারিকার একটি বিখ্যাত গানের কয়েকটি কলি- “মানুষ মানুষের জন্য/জীবন জীবনের জন্য/ও বন্ধু, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না? মানুষ যদি সে না হয় মানুষ/দানব কখনও হয় না মানুষ? যদি দানব কখনও বা হয় মানুষ/ লজ্জা কি তুমি পাবে না?”
সত্যিই পরস্পরের জন্য মায়া-মমতা, দয়া ও দরদ, সম্প্রীতি সহমর্মিতা প্রভৃতি না থাকলে কিসের মানুষ? এসব ছাড়া তো মানুষ পশুর চেয়েও অধম হয়ে যায়। এই করোনা সংক্রমণের সময়েও মানুষরূপী কিছু দ্বিপদ প্রাণী অসততা, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা, লুণ্ঠন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে নিজেদের মানবেতর জঘন্য স্বরূপ বহাল রেখেছে। অন্যদিকে অনেকেই প্রমাণ দিচ্ছেন যে, তারা আসলেই মানুষ। এ কারণেই তারা বিপন্ন মানবতার এই ক্রান্তিকালে মনুষ্যত্বের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। কেউ কেউ এই মহতী অভিযান ও সাধনায় জীবন উৎসর্গ করেছেন। যেমন, সিলেটের চিকিৎসক মঈন উদ্দিন। তাকে সরকারি উদ্যোগে নয়, নিজের খরচে ঢাকায় আসতে হয়েছিল চিকিৎসার জন্য।
হিন্দু অধ্যুষিত ভারতের বর্তমান সাম্প্রদায়িক শাসনামলে সংখ্যালঘু মুসলমানদের অবস্থা বেশি শোচনীয়, তা বলার দরকার পড়ে না। তবু তারাই হিন্দু করোনা রোগীর লাশ নিজেরা কাঁধে বহন করে সৎকারের ব্যবস্থা করেছেন। কারণ সে ব্যক্তির স্বধর্মী পরিজন-প্রতিবেশী আত্মীয় কেউ আসেননি রোগের ভয়ে। বাংলাদেশেও করোনা রোগীর লাশের গোসল দাফন নিয়ে বিরাট সমস্যা। এমন অনেকের মৃত্যুর পর তার আপনজনরা দূরে সরে গেছে আতঙ্কে। মায়ের করোনা রোগ দেখে ছেলেরা তাকে জঙ্গলে ফেলে এসেছে। করোনা রোগী সন্দেহে একজনের লাশের জন্য মসজিদের খাটিয়া দেয়া হলো না। অথচ বাংলাদেশের কয়েকজন আলেম মিলে করোনা রোগীর লাশের গোসল, কাফন পরানো এবং জানাজা, দাফনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এসব কিছ্ইু প্রমাণ করে- আজও কিছু মানুষ আছেন, যারা কেবল নামে নয়, কামেও মানুষ!
আজব-গুজব-তাজ্জব
বাংলাদেশের মানুষ ‘ঐতিহ্যগতভাবে’ হুজুগে মেতে ওঠে সহজেই। এ কারণে বলা হয়, ‘হুজুগে বাঙ্গাল/হেকমতে চীন।’ এ দেশের মানুষ প্রধানত গরিব ও অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত। সমাজটা শোষিত আর সরকার কাজের চেয়ে কথায় সুদক্ষ। অতএব মানুষ কার ওপর আস্থা রাখতে পারে? এ অবস্থায় বিপন্ন জনসাধারণ গুজবে বিশ্বাস করে বেশি এবং গভীর বিবেচনা কিংবা যুক্তি ও কাণ্ডজ্ঞানের তোয়াক্কা করে কম। এখন করোনা ক্রাইসিসের আমলেও তা দেখা যাচ্ছে।
একবার শোনা গেল, থানকুনি বা আদামনি পাতার রস ভর্তা করে খেলে করোনা রোগ হবে না। এতে মানুষ মাঠ-ঘাটের সব থানকুনি পাতা খেয়ে শেষ করে দেয়। আসলে থানকুনির রস কিডনির রোগের চিকিৎসায় সহায়ক বলে মনে করা হয়। কিডনি রোগীর করোনা ঝুঁকি বেশি জেনে মানুষ থানকুনিকে নির্বংশ করে ছেড়েছে। আবার প্রচারিত হলো, ভিটামিন সিযুক্ত খাবার খেলে করোনা কাৎ হয়ে যাবে। সুতরাং এ ধরনের ফলমূল কেনার ধুম পড়ে গেল। বিশেষ করে লেবু নিয়ে হলো সঙ্কট। এর যা আগুন দাম, সেটা কেনা উচ্চবিত্ত ছাড়া কারো পক্ষে সম্ভব হলো না। ফাঁকতালে কিছু লোকের ব্যবসায় জমলেও করোনা কমেনি। ভিটামিন ‘সি’র এমনিতেই অনেক উপকার। তবে এটা করোনার দাওয়াই নয়।
এখন শুরু হয়েছে মাথা ন্যাড়া করার মহোৎসব। কারা নাকি ছড়িয়েছে ‘ন্যাড়াদের করোনা হবে না।’ গত শুক্রবার একটি পত্রিকার প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কোনো কোনো জেলায় সর্বত্র ন্যাড়া হয়ে যাওয়ার হিড়িক পড়ে গেছে। অনেকে ন্যাড়া হয়ে নানান কায়দায় ছবি তুলে তা প্রচার করছেন ফেসবুকে এবং অন্যান্য সামাজিকমাধ্যমে। স্বাস্থ্য বিভাগ, তথা ডাক্তাররা বলেছেন, ন্যাড়া হলে করোনা হবে না এ কথাটা স্রেফ গুজব। তদপুরি চিকিৎসকদের কেউ কেউ হুঁশিয়ার করেছিলেন, ‘এতে করোনার সংক্রমণ বেশি হতে পারে। কেননা, ন্যাড়া হতে হলে আরেকজনের সাহায্য নিতে হয়। এভাবে ভয়াবহ রোগটা ছড়িয়ে পড়তে পারে।’
আসলে লকডাউনের কারণে এখন সব সেলুন বন্ধ। সবাই ঘরে আটকা পড়ে আছেন। ফলে চুল ছাঁটতে না পেরে অনেকেই মাথা কামিয়ে নিচ্ছেন। একটি পত্রিকায় জানানো হয়েছে, ভালো লাগা থেকেও অনেকে ন্যাড়া হচ্ছেন। অনেকে পরিচিতজনের ন্যাড়া হওয়া দেখে উৎসাহিত হয়ে এ পথে হাঁটছেন। তবে আসল ব্যাপার হলো, প্রতি বছর গরমের এ সময়ে অনেকেই ন্যাড়া মাথা হয়ে স্বস্তিবোধ করেন। এ দিকে কেউবা কোনো নাপিতকে বলছেন, তার বাড়িতে গিয়ে চুল কেটে দিতে। সুযোগ পেয়ে নাপিতরা এ জন্য চার্জ করছেন বেশি।
পাদটীকা : করোনা সঙ্কটের সূচনা হওয়ার পর থেকে প্রথমে কোলাকুলি, এরপর করমর্দন বন্ধ। তখন মিডিয়ায় দেখানো হলো, করমর্দনের বদলে পদমর্দন কিংবা একজনের হাতের মুঠোর পিঠের সাথে আরেকজনের মুঠোর পিঠের ঘষাঘষি করা যায়। অনেক আগেই শুনেছি- তিব্বতিরা নাকি পরস্পরকে জিহ্বা দেখিয়ে (এক ধরনের ভেংচি কাটা) স্বাগত জানান। এস্কিমোরা তা করে থাকেন নাকে নাক ঘষে। আমেরিকার মতো কোনো কোনো দেশে হাতের বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে এটা করা হয়। তবে বুড়ো আঙুল দেখালে অপমানিত বোধ করে বাংলাদেশসহ অনেক দেশের মানুষ সাঙ্ঘাতিক রাগ করতে পারেন।
যা হোক, কিছু দিন আগে পদমর্দনের বাস্তব নমুনা দেখেছি ঢাকায় একটি ব্যাংকে প্রধান কার্যালয়ে। এক যুবক মাস্ক পরে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। তার পরিচিত এক লোকের সাথে দেখা মাঝপথে। লোকটি হ্যান্ডশেকের জন্য হাসিমুখে হাত বাড়াতেই যুবকটি হাত পেছনে সরিয়ে তার পায়ের জুতাকে নিজের জুতা দিয়ে ঘষে দিলেন। লোকটি প্রথমে হতবাক হলেও একটু পরেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হেসে দিলেন। এ দেশে তৈলমর্দনের ঐতিহ্যের সাথে এভাবে পদমর্দনের প্রথা যোগ হলো।