ট্রাম্প-মোদির চালবাজি
ট্রাম্প-মোদি - সংগৃহীত
ম্যালেরিয়া মূলত এশিয়ায় বা আফ্রিকায় বেশি দেখা যায়। তাই দুনিয়ায় ম্যালেরিয়ার ওষুধ উৎপাদনে বড় দেশ হলো এশিয়ায়, বিশেষত বড় জনসংখ্যার বা বাজারের দেশ। ভারতের তিনটি কোম্পানি ভারতের বার্ষিক চাহিদার চেয়েও ১০ গুণ বেশি পর্যন্ত কাঁচামাল উৎপাদন ও তা থেকে এ ওষুধ পর্যন্ত উৎপাদন সক্ষম। তাই ট্রাম্প ভারতের মোদিকে ফোন করে হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন ওষুধ রফতানি-সরবরাহের অনুরোধ জানান। অর্থাৎ ওষুধের কার্যকারিতা প্রমাণিত হোক আর না হোক, ট্রাম্প আমেরিকার সরকারি স্টক হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইনের সরবরাহ দিয়ে ভরিয়ে ফেলতে চেয়েছেন। যেন ট্রাম্প একটা পাবলিক ইমেজও চাচ্ছিলেন যে, করোনার কথিত ওষুধ সংগ্রহে তিনি কত তৎপর। ওদিকে মোদিও দেখলেন এটা তারও ‘দেশপ্রেম’ দেখানোর এবং গলাবাজি একটা বিরাট সুযোগ। তিনি পাল্টা ট্রাম্পকে জানিয়ে দিলেন, নিজ দেশের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়ে তিনি সাপ্লাই করতে পারছেন না। আসলে এটাও একটা মিথ্যা কথা। কিন্তু মোদি আসলে নিজ দেশে দেখাতে চাইছিলেন, তিনি কতই না দেশপ্রেমিক। কারণ ভারতের বছরের চাহিদা সর্বোচ্চ ২২ মিলিয়ন পিস। আর উৎপাদন সক্ষমতা ২০০ মিলিয়ন। বড় কথাটা হলো, হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন করোনার পরীক্ষিত ওষুধও নয়। ভবিষ্যতে তা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। কারণ, ভাইরাসের প্রতিষেধক মূলত ভ্যাকসিন বা টিকা। হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইনের ব্যবহার বড়জোর যেন টোটকা। তাও হার্টের অসুখের রোগীর ক্ষেত্রে এর ব্যবহার মারাত্মক, সে রোগীকে মৃত্যুঝুঁকিতে ফেলার মতো হতে পারে।
তার মানে মোদি আর ট্রাম্প দু’জনই পাবলিককে বোকা বানাচ্ছেন আর দেশপ্রেম বেচছেন!
কিন্তু হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন ট্যাবলেট মোদি আমেরিকাকে সরবরাহের অপারগতা জানানোকে ট্রাম্প খুবই সিরিয়াসলি নিয়ে মোদিকে পাল্টা হুমকি দিয়ে বসেন। ট্রাম্প পাবলিকলি বলে দেন, হয় মোদি হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন সাপ্লাই করবেন, না হলে এর পরিণতি ভোগ করবেন। তামাশার কথা হলো, দুই চাপাবাজ এবার মুখোমুখি হয়ে যাওয়াতে শেষে মোদি দ্রুত সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এবার ‘উল্টো গান’ ধরেন। করোনাকালে দরকারের সময় তিনি মহান উদার সরবরাহদাতা সেজে গেলেন। এবার তিনি আমেরিকার ট্রাম্পকে তো বটেই; সার্কের পড়শিদের মধ্যে বাংলাদেশকেও নিজে থেকে তা সরবরাহের অঙ্গীকার ঘোষণা করলেন।
এদের বাস্তব কাণ্ডজ্ঞান আর সরকারপ্রধান হওয়ার যোগ্যতা কতটুকু তা এখানেই ধরা পড়ে যায়। যেমন- ওষুধ আর পাঁচটা পণ্য নয় যেটা যেকোনো ব্যবসায়ীই আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য নিজেই যথেষ্ট। কাজেই বাংলাদেশ হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইনের আমদানির অনুমতি দেবে কি না সেটি মোদি তো নয়ই, এমনকি এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ইস্যু বা এখতিয়ারই নয়। আমাদের ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের টেকনিক্যাল সম্মতি ও অনুমতি ছাড়া এই ওষুধ আমদানিযোগ্য নয়। বলাই বাহুল্য, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন ওষুধের প্রমাণিত কার্যকারিতার সার্টিফিকেট না পেলে সে প্রশাসন এই অনুমতি দিতে পারে না।
আসলে ওষুধের ব্যাপারে আমেরিকার ফুড ও ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) দুনিয়ায় আদর্শ স্থানীয়। এর নিজস্ব ল্যাবে প্রমাণিত ও অনুমোদিত না হলে আমেরিকার কোনো উৎপাদক তার খাদ্য বা ওষুধবিষয়ক পণ্য আমেরিকায় বাজারজাত করতে পারে না। কারণ নাগরিক ভোক্তার খাদ্য বা ওষুধবিষয়ক সঠিক ও অক্ষতিকর পণ্য ভোগের অধিকার রক্ষার্থেই এফডিএ প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিল। আর এটাকে আদর্শ মেনেই ১৯৮২ সালে এ অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের ১৯৮২ সালের বিখ্যাত ওষুধ নীতিতে বাংলাদেশেও ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর খোলা হয়েছিল। আমেরিকার এফডিএর সমতুল্য ইউরোপেরও প্রতিষ্ঠান আছে। তবে সুনাম ও স্ট্যান্ডার্ডের দিক থেকে এফডিএ দুনিয়ায় সেকালে অনুসরণযোগ্য মানা হতো।
কিন্তু এখন ট্রাম্পের আমলে এসে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকা শুধু তার গ্লোবাল নেতৃত্বের কৃতিত্ব ও গৌরবই হারায়নি, বহু বিশ্ব স্ট্যান্ডার্ডও ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছে। ব্যবসা ও মুনাফার স্বার্থের কাছে কোনটা ওষুধ কোনটা নয়, এর ভেদাভেদ গুণ বিচারও লুটিয়ে দিয়েছে। আর ট্রাম্প নাকি সবচেয়ে বড় ওষুধ বিশেষজ্ঞ! তাই নিউ ইয়র্ক টাইম বলেছে, ট্রাম্প যে মূলত একজন ব্যবসায়ী মূলত হাউজ বিল্ডিং ডেভেলপার, তার মানে যিনি ‘একজন সেলসম্যান তিনি প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছেন’, তিনিই এখন করোনা সংক্রমণে কোন ওষুধ খেতে হবে, এর বিশেষজ্ঞ বনে গেলেন!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক