আর কত দিন থাকবে করোনা!
মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা - সংগৃহীত
বিশ্বব্যাপী ২১০টি দেশে হানা দিয়ে নীরব ঘাতকের মতো ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস। দেশে দেশে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জনসমাগম, ব্যবসা-বাণিজ্য, হোটেল-রেস্তরাঁ, গণপরিবহন। তারপরও কিছুতেই রোখা সম্ভব হচ্ছে না মারণ ভাইরাসের সুনামি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি বৈশ্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় সব দেশকে ছাড়িয়ে গিয়ে সবচেয়ে বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্র। করোনা আক্রান্তদের ৮০ শতাংশই এখন ইউরোপ-আমেরিকায়। ইউরোপের ৪৬টি দেশে ছড়িয়েছে করোনা। যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, চীন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইরান, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক ও বেলজিয়ামেই আছে ৭৮ শতাংশ করোনা রোগী। করোনায় মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি ফ্রান্সে ১৫ দশমিক ৩২ শতাংশ, আর সবচেয়ে কম জার্মানিতে ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ইতালিতে ১২ দশমিক ৯৭ শতাংশ, ব্রিটেনে ১২ দশমিক ৯০ শতাংশ, স্পেনে মৃত্যুর হার ১০ দশমিক ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। বিশ্বজুড়ে চিহ্নিত রোগীর মাত্র ১ শতাংশ আছে আফ্রিকা মহাদেশের ৫০টি দেশে। ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১ লাখ ৪৭ হাজার ১০ জন, আক্রান্ত হয়েছে ২১ লাখ ৯০ হাজার ১০ জন। খবর এএফপি, আল জাজিরা, এনডিটিভি, সিএনএন, গার্ডিয়ান, সাউথ চায়না মনিটরিং পোস্ট, ইউএসএ টুডে, রয়টার্স, আরব নিউজ, এই সময়, বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য হিল, ব্লুমবার্গ ও ওয়ার্ল্ডোমিটারসের।
করোনা আরো ৪ বছর থাকার আশঙ্কা : করোনাভাইরাসের হানা আরো চার বছর স্থায়ী হতে পারে। ভাইরাসটির হুমকি ২০২৪ সাল পর্যন্ত থাকার সম্ভাবনা থাকায় করোনা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতির দিকে আরো নজর দেওয়া উচিত। ভাইরাসটি মোকাবিলায় ভ্যাকসিন কিংবা প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত অথবা আশঙ্কাজনক সেবা সক্ষমতা বৃদ্ধি না করা পর্যন্ত ২০২২ সাল নাগাদ সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হতে পারে। সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় এসব দাবি করেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএইচ চ্যান স্কুলের পাঁচজন গবেষক।
এ বছরেই টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা : করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারই মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে পারে। একটি টিকা বহু মানুষের জীবন ও বিশ্বকে অর্থনৈতিক ধসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমেই দ্রুত করোনাভাইরাসের টিকা তৈরি সম্ভব। সর্বোচ্চ চেষ্টা করলে হয়তো ২০২০ সালের শেষ নাগাদ টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের সদর দফতর থেকে আফ্রিকার ৫০টি দেশের সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আলাপকালে এসব কথা বলেন জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।
ধূমপায়ীদের ঝুঁকি ১৪ গুণ বেশি : করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে ধূমপায়ীদের ধূমপান ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন টার্কিশ গ্রিন ক্রিসেন্টের প্রধান অধ্যাপক মুকাহিত ওজতুর্ক। ওজতুর্ক বলেন, অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ১৪ গুণ বেশি। ধূমপান ও তামাকপণ্য ব্যবহারে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। ফলে ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে যেকোনো ধরনের আসক্তিমূলক পণ্য এড়িয়ে চলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
ভয়াবহ পরিণতির দিকে আফ্রিকা : আফ্রিকাতেও দ্রুত বাড়ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। এর ফলে সেখানকার দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোতে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থা রেড ক্রস। রেড ক্রসের আঞ্চলিক পরিচালক ড. সাইমন মিসিরি বলেন, আফ্রিকায় করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। তবে সেখানে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, এই মহামারি শেষ হয়েছে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার এখনই সময়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক ড. মাৎসিদিসো মোয়েতি বলেন, আফ্রিকায় ১৭ হাজারের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন ৯০০-এর বেশি। গত সপ্তাহ ধরে বেশ কয়েকটি দেশে দ্রুত বাড়ছে এর বিস্তার; যার পরিণতি হবে ভয়াবহ।
এখনো করোনা হুমকির মধ্যে ইউরোপ : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক নির্বাহী হানস ক্লুগে বলেন, আমরা করোনার সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রয়েছি। স্পেন, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডে কিছুটা ইতিবাচক লক্ষণ দেখা দিলেও ব্রিটেন, তুরস্ক, ইউক্রেন ও রাশিয়াতে সংক্রমণের মাত্রাতিরিক্ত অবস্থা বলছে, আমরা এখনো করোনার চোখ রাঙানির বাইরে নই। ব্রিটেন আরো ৩ সপ্তাহের লকডাউন জারি করেছে। নিউইয়র্ক ১৫ মে পর্যন্ত লকডাউন ঘোষণা করেছে। রাশিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের বার্ষিক মিলিটারি প্যারেড বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে।
চরম দরিদ্রতার ঝুঁকিতে সাড়ে ৬ কোটি শিশু : ‘দ্য পলিসি : ব্রিফ দ্য ইম্পেক্ট অব কোভিড-নাইনটিন’ নামের প্রতিবেদনে জাতিসঙ্ঘ জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে দুর্যোগে বিশ্বে ৪.২ কোটি থেকে ৬.৬ কোটি শিশু চরম দরিদ্রতায় ভুগতে পারে। শিশু মৃত্যুর হারও বেড়ে যেতে পারে। শিশুরা এই মহামারির ঝুঁকিতে রয়েছে। শিশুদের করোনাভাইরাস, ভাইরাস পরবর্তী আর্থসামাজিক প্রভাব এবং এর দীর্ঘমেয়াদির প্রভাবের চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়াই করতে হবে।
ব্রিটেনের ১৩ হাজার সেনা সেলফ আইসোলেশনে : করোনাভাইরাসের কারণে যুক্তরাজ্যের সশস্ত্র বাহিনীর ১৩ হাজার সদস্য দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। মূলত তারা সেলফ আইসোলেশনে বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দেখাশোনা করছেন। আর অনেককেই আবার বাসা থেকে কাজ করতে বলা হয়েছে। অনুপস্থিতির সংখ্যা সামরিক বাহিনীর ৯ দশমিক ১ শতাংশ। কমপক্ষে ১০০ জন সামরিক কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
যুক্তরাষ্ট্রে এক মাসে বেকার ২ কোটি ২০ লাখ : মার্কিন শ্রম অধিদফতর জানিয়েছে, ‘করোনাভাইরাস মহামারির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গত সাত দিনে চাকরি হারিয়েছেন আরো ৫২ লাখ মানুষ। এ নিয়ে গত চার সপ্তাহে দেশটিতে বেকারের সংখ্যা বাড়ল অন্তত ২ কোটি ২০ লাখ।’ ১৯৬৭ সালের পর থেকে এটাই যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বেকারত্ব বৃদ্ধির রেকর্ড।
পেন্টাগনের ৪৬৯৫ কর্মী আক্রান্ত : যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগনের এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৪ হাজার ৬৯৫ জনের শরীরে করোনার উপস্থিতি ধরা পড়েছে। সম্প্রতি মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস থিওডোর রুজভেল্টের এক নাবিক করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ২১০ জন এবং প্রাণহানি ঘটেছে ৩৪ হাজার ৬৪১ জনের। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৭২৫ জন এবং তাদের মধ্যে গুরুতর অবস্থায় রয়েছে ১৩ হাজার ৩৬৯ জন। এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেছে ৫৭ হাজার ৮৪৪ জন।
পুরো জাপানে জরুরি অবস্থা জারি : করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবার পুরো জাপানে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার পুরো দেশই জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। তিনি জানান, ৬ মে পর্যন্ত এই জরুরি অবস্থান বলবৎ থাকবে। এই পদক্ষেপের ফলে জাপানের আঞ্চলিক সরকারগুলো মানুষকে ঘরের ভেতর রাখতে চাপ প্রয়োগ করতে পারবে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জাপানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৯ হাজার ২৩১ জন। আর এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১৯০ জন।