মহামারী মোকাবেলা : ইসলাম কী বলে
মহামারী মোকাবেলা : ইসলাম কী বলে - সংগৃহীত
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষে, আজকের পৃথিবী এক মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন। খ্রিষ্টাব্দ ১৬৫ থেকে শুরু করে ২০১২ সাল পর্যন্ত ১০টি মহামারীর কথা জানা যায়। ১৬৫ সালে ‘অ্যান্টোনিন প্লেগ’ রোগে পাঁচ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। ৫৪১-৫৪২ সালের ‘জাস্টিনিয়ান প্লেগে’ মারা যায় ২৫ মিলিয়ন মানুষ।
এরপর ১৩৪৬ থেকে ১৩৫৩ সালের মধ্যে কালাজ্বরে প্রায় ২০০ মিলিয়ন, ‘তৃতীয় কলেরা’ রোগে ১৮৫২ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত এক মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। আবার ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা’ জ্বরে ১৮৮৯-৯০ সালে এক মিলিয়ন, ১৯১৮ সালে প্রায় ৫০ মিলিয়ন, ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে দুই মিলিয়ন এবং ১৯৬৮ সালে মারা যায় এক মিলিয়ন বনি আদম। এর মাঝে ১৯১০-১১ সালে ‘কলেরা’ মহামারীতে আরো প্রায় আট লাখেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। ‘এইডস’ রোগে ২০০৫ থেকে ২০১২ সাল নাগাদ ৩৬ মিলিয়ন মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। তবে ‘করোনাভাইরাস’ দ্বারা সৃষ্ট চলমান মহামারী বিগত ১০টি মহামারীর চেয়েও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বলে আশঙ্ক করা হচ্ছে। গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে শুরু হয়ে ৩১ মার্চ পর্যন্ত মাত্র তিন মাসে এই মহামারীতে ৪০ হাজার ৬৩৬ জন মানুষ ১৭৮টি দেশে মৃত্যুবরণ করেছে এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৮ লাখ, ২৩ হাজার ৪৭৯। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের একদল গবেষক গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে গবেষণা করে অনুমান করছেন, এই মহামারীতে চলতি বছর প্রায় দুই কোটি মানুষ মারা যেতে পারে। তবে প্রতিরোধমূলক সামাজিক দূরত্বের নীতিমালা মেনে না চললে মৃতের সংখ্যা এমন কি, চার কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সর্বগ্রাসী যে মহামারী বিশ্বজুড়ে থাবা মেলেছে তার কারণ করোনাভাইরাস ডিজিজ-১৯। এই রোগের উৎস হলো ‘করোনাভাইরাস’। এই ভাইরাসটি কিভাবে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হলো তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। গবেষক থেকে রাজনীতিবিদ সবাই এই বিতর্কে অংশীদার। ইরান ও চীন বলছে, এই ভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাগারে তৈরি হয়েছে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, এটা ‘চাইনিজ’ ভাইরাস। কোনো কোনো গবেষক বলেছেন, চীনের উহান শহরে পশু-পাখির একটি মার্কেট থেকে এই ভাইরাস মানুষের গায়ে এসেছে। আবার কারো মতে, এই ভাইরাস আগে থেকেই মানুষের শরীরে ছিল, এবার সেটি জীবনচক্র পরিবর্তন করে নতুনভাবে প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে মানুষকে আক্রমণ করছে। উৎস যাই হোক, এটি যে আমরা মানব জাতি ‘নিজ হাতে অর্জন’ করেছি তাতে সন্দেহ নেই। কারণ মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা যা অর্জন করে তার প্রাপ্য অংশ তাদেরই। আল্লাহ হিসাব গ্রহণে অত্যন্ত তৎপর’ (সূরা বাকারা ২ : ২০২)। আর পৃথিবীতে অশান্তি ছড়ানোর ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের জন্য জলে-স্থলে ফ্যাসাদ ছড়িয়ে পড়ে; তাই ওদের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি ওদেরকে আস্বাদন করানো হয় যাতে ওরা সৎপথে ফিরে আসে’ (সূরা রুম ৩০ : ৪১)। আল্লাহ পাক আরো বলেন, ‘তোমাদের যে বিপদাপদ ঘটে তা তো তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল, আর তোমাদের অনেক অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন’ (সূরা শুরা ৪২ : ৩০)।
আলোচিত আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান, এই মহামারী আমাদেরই অপকর্মের ফল। হয়তো এই করোনাভাইরাস মরণাস্ত্র হিসেবে তৈরি করতে গিয়ে দুর্ঘটনার দ্বারা গবেষণাগারের বাইরে চলে এসেছে অথবা আল্লাহর দেয়া বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে সব ধরনের পশু-পাখি, জীব-জন্তু নির্বিচারে খাওয়ার ফলে খেতে গিয়ে এই ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করেছে। এ ছাড়া মহান আল্লাহ তায়ালা পথভ্রষ্ট মানব জাতিকে সতর্ক করে দেয়ার জন্য মাঝে মধ্যেই এ ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন করে থাকেন।
এ দিকে, দেশে দেশে চলছে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার। সম্পদ ও ভূমি দখলের উদ্দেশ্যে এবং অন্যায় কর্তৃত্ব বলবৎ রাখার জন্য আজকের পৃথিবীতে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ নামে লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে যাদের মধ্যে শিশু ও নারী রয়েছে অনেক। নির্লজ্জতার চরমে উঠে পুরুষে-পুরুষে বিয়েকে বিভিন্ন দেশে বৈধতা দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নির্যাতন, ক্ষমতার মসনদে বসে ঔদ্ধত্য ও অহঙ্কারের প্রদর্শনী, সম্পদের পূজা, ব্যক্তিস্বার্থের আরাধনা, সুদের বোঝা চাপিয়ে দেয়া, নারীদেহকে পণ্য বানিয়ে তা বাজারজাত করা ইত্যাদি সব ধরনের অনাচার ও অপরাধের সাথে আজকের মানুষ জড়িত হয়ে পড়েছে। এভাবেই আমরা আল্লাহর ক্রোধ এবং সতর্কবার্তার নিদর্শন হিসেবে সম্মুখীন হয়েছি। এভাবে আমরা সীমা লঙ্ঘনের একেবারে শেষ সীমানায় চলে এসেছি। পরম ক্ষমতাধর আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ওদের প্রত্যেককেই আমি তার অপরাধের শাস্তি দিয়েছিলাম। ওদের কারো ওপর পাঠিয়েছিলাম কঙ্কর ঝড়, কাউকে আঘাত করেছিল মহাগর্জন, কাউকে মাটির নিচে মিলিয়ে দিয়েছিলাম আর কাউকে মেরেছিলাম ডুবিয়ে। আল্লাহ তাদের ওপর কোনো জুলুম করেননি। তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছিল’ (সূরা আনকাবুত ২৯ : ৪০)।
মানব জাতির অংশীদার হিসেবে আমরা বাংলাদেশীরাও এই মহামারীর আওতাভুক্ত। আমরাও সীমা লঙ্ঘনের কার্যকলাপে কম-বেশি জড়িত। জুলুম, নির্যাতন, কালোবাজারি, মদ, জুয়া, বেহায়াপনা, বিশেষত গরিবের ওপর সুদের বোঝা চাপানো, অশ্লীলতা ইত্যাদি পাপ কার্যে লিপ্ত হয়ে আমরাও নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। তবুও আমরা নিজেদেরকে মুসলমান হিসেবে দাবি করে থাকি। আমাদের সামনে দু’টি উপায় রয়েছে। প্রথমত, আমাদের পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করতে হবে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে। তাঁর কাছে হৃদয়-মন দিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে। তাওবা করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘কিন্তু যারা তাওবা করে আর নিজেদের সংশোধন করে এবং আল্লাহর আয়াতকে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে, এরাই তো তারা যাদের আমি ক্ষমা করি, আর আমি ক্ষমাকারী পরম দয়ালু’ (সূরা বাকারা ২ : ১৬০)। দ্বিতীয়ত, আমাদেরকে সাধ্যমতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে প্রধান পদক্ষেপ হলো আইসোলেশন বা বিচ্ছিন্নতা। আমাদের সম্পদ সীমিত, স্বাস্থ্য অবকাঠামো দুর্বল, জনবসতি খুবই ঘন, সচেতনতা অত্যন্ত অপ্রতুল। অন্য দিকে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষেধক ওষুধ আবিষ্কার হয়নি করোনার। কাজেই প্রধান দায়িত্ব হতে হবে ‘বিচ্ছিন্নতা’মূলক প্রতিরোধ। সে বিচ্ছিন্নতার কথা আজ থেকে ১৪০০ বছর আগেই প্রিয় নবী সা: বলে গিয়েছিলেন, ‘যখন তোমরা শোন যে, কোনো জায়গায় মহামারীর প্রাদুর্ভাব হয়েছে, তোমরা সেখানে যেও না। আর কোনো জায়গায় এর প্রাদুর্ভাব ঘটলে এবং তোমরা সেখানে থাকলে সেখান থেকে পালিয়ে যেও না’ (সহিহ বুখারি, কিতাবুত তিব্ব, হাদিস : ৫৩১০)। আমরা আজকে যে ‘লকডাউন’-এর কথা আলোচনা করছি, তা অনেক আগেই নবীজী সা: শিখিয়ে গেছেন। এবার জুমার খুৎবায় বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মুফতি মেন্ক বলেছেন, ‘হজরত আয়েশা রা:-এর সূত্রে বুখারি শরিফের একটি হাদিসে রয়েছে, নবী করিম সা: বলেছেন, ‘যদি তুমি সতর্কতার জন্য বাড়িতে অবস্থান করো এবং ধৈর্য ধরো, তবে আল্লাহ পাক অবশ্যই তার জন্য পুরস্কৃত করবেন’ (নয়া দিগন্ত, ২৯ মার্চ ২০২০)।
একজন সাহাবি এ প্রসঙ্গে মহানবী সা:কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রোগ-শোক, দুর্যোগ থেকে আমরা কিভাবে রক্ষা পাবো? উত্তরে নবীজী সা: তিনটি বিষয় উল্লেখ করেন : ১. মুখের কথাকে সংযত করো। তুমি কী বলছ তা নিয়ে সচেতন থাকো। অর্থাৎ যা শুনি বা পড়ি তাই প্রচার করা যাবে না। সেটা গুজব হতে পারে। ২. নিজ বাড়িতে থাকতে হবে এবং ৩. আল্লাহর ওপর বিশ্বাস থাকতে হবে’ (প্রাগুক্ত)। এই হাদিসগুলো যদি প্রথম থেকেই বিভিন্ন মিডিয়ায় এবং মসজিদগুলোয় ইমাম সাহেবদের মাধ্যমে ভালোভাবে প্রচার করা হতো, তা হলে আমাদের দেশের ৯০ শতাংশ ধর্মপ্রাণ মানুষকে সহজেই সচেতন করা সম্ভব হতো। কিন্তু আমরা সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছি। গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহানে প্রথম ‘কোভিড-১৯’ রোগী শনাক্ত হওয়ার পর আমরা প্রায় তিন মাস সময় পেয়েছি। গত ৩০ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই করোনা সংক্রমণকে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা হিসেবে ঘোষণা করে। গত ৮ মার্চ আমাদের দেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত করা হয়। আর গত ১১ মার্চ কোভিড-১৯ রোগের প্রাদুর্ভাবকে ‘বৈশ্বিক মহামারী’ হিসেবে ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
এত সতর্কবার্তা পাওয়ার পরও আমরা জোরালো প্রস্তুতি নিতে ব্যর্থ হয়েছি। তখন আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এমনকি এর মাঝেই আমরা অর্থ ও সময় ক্ষয় করেছি। মন্ত্রীরা বারবার জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন যে, ‘সব নিয়ন্ত্রণে আছে, পরিপূর্ণ প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।’ তবে কেন যেন আমরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছি। বিচিত্র আমাদের দেশ! সব কাজ কেন সরকারপ্রধানকেই করতে হয়। সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত তাকেই দিতে হবে কেন? বড় নেতা-নেত্রীরা পরিস্থিতির ভয়াবহতা প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর পরিবর্তে অতিকথন, বড় বড় বক্তব্য, মন্তব্য ও স্তুতিবাক্যে সময় ক্ষেপণ করেছেন। সিদ্ধান্তহীনতার চরম প্রতিফলন ঘটে গণযাতায়াত ব্যবস্থা চালু রেখে লম্বা সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার মাধ্যমে।
এতে সামাজিক সংক্রমণের সব সম্ভাবনার দ্বার খুলে গিয়েছিল। অন্য দিকে তিন লক্ষাধিক প্রবাসী বা বিদেশফেরত বাংলাদেশী নামেমাত্র পরীক্ষা বা কোনো ধরনের প্রাথমিক পরীক্ষা ছাড়াই দেশে প্রবেশ করেন এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েন। অথচ চীনের উহান থেকে স্বদেশীদেরকে সরকার নিজস্ব বিমানে এনে কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে সবার মধ্যে আশার আলো জাগিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে তৎপর হওয়ার পরই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এভাবে টনক নড়ার পরই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সীমিত সম্পদ ও অবকাঠামো দিয়ে প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো প্রাইভেট সেক্টরের স্টেকহোল্ডাররাও এগিয়ে আসছেন। দেশের পুরো জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত হতে হবে। সরকারের একার পক্ষে মহামারী সামলানো সম্ভব নয়। পুরো জাতিকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে এই বিপদ মোকাবেলায়। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে। আল্লাহ যখন কোনো জাতির ওপর কোনো বিপদ আনার ইচ্ছা করেন, তখন তা রদ করার কেউ নেই, আর তিনি ছাড়া তাদের আর কোনো রক্ষাকর্তা বা অভিভাবক নেই’ (সূরা রাদ ১৩:১১)।
আতঙ্কের কারণ নেই। আমাদের সরকার কঠোরভাবে ও যতœসহকারে ‘কোভিড-১৯’ মোকাবেলায় প্রস্তুতি এবং প্রতিরোধের কাজ শুরু করেছে। ‘আইইডিসিআর’ নিয়মিত তথ্য প্রকাশ করছে। তবে জনগণের মাঝে এ তথ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে আস্থার সঙ্কট পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে আতঙ্ক কাটছে না। কিন্তু আমাদের আতঙ্কিত না হয়ে বরং আল্লাহর প্রতি পুরোপুরি আস্থা রাখতে হবে। কারণ তিনি বলেন, ‘আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া কোনো বিপদই আসে না, আর যে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস করে তিনি তার অন্তরকে সুপথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ তো সব বিষয়ই ভালো করে জানেন’ (সূরা তাগাবুন ৬৪ : ১১)।
এ ব্যাপারে রাসূল সা:-এর একটি প্রণিধানযোগ্য হাদিস রয়েছে। একবার হজরত আয়েশা রা: প্লেগ মহামারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে রাসূল সা: বলেন, ‘এর সূচনা হয়েছিল আজাবরূপে। আল্লাহ যাদের ওপর চান, তা পাঠান। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা একে ঈমানদারদের জন্য রহমতস্বরূপ বানিয়ে রেখেছেন। কোথাও যদি প্লেগ মহামারী ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখানকার কোনো বান্দা এ কথা জেনে বুঝেই ধৈর্যসহকারে সে শহরে অবস্থান করে, আল্লাহ তার ভাগ্যে যা লিখে দিয়েছেন সেই বিপদ ছাড়া আর কিছুই তার ওপর আসবে না, তবে সে শহীদের অনুরূপ সওয়াব পাবে’ (সহিহ বুখারি, কিতাবুত তিব্ব, হাদিস ৫৩১৪)। এই বিপদের সময় পবিত্র কুরআনের সূরা আল ইনশিরাহ্ খুবই প্রাসঙ্গিক। ওই সূরার ৫ ও ৬ নম্বর আয়াতে রয়েছে সুসংবাদ। আর ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে আমাদের করণীয় সম্পর্কে। ৫ ও ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে যে, কষ্ট-কাঠিন্যের পর অবশ্যই স্বস্তি রয়েছে। তাফসিরকারকরা এর ব্যাখ্যায় বিভিন্নরকম স্বস্তির কথা লিখেছেন। রাসূল সা: বলেন, ‘নিশ্চয়ই বিপদের সাথে মুক্তি আছে। আর নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে আছে স্বস্তি’ (মুসনাদ আহমদ : ১/১০৭)।
হজরত হাসান বসরি রহ: বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা: সাহাবায়ে কেরামকে এই আয়াত থেকে দুটো সুসংবাদ শুনিয়েছেন এবং বলেছেনÑ এক কষ্ট দুই স্বস্তির ওপর প্রবল হতে পারে না’। অন্য দিকে আমরা এ মুহূর্তে লকডাউন বা সাধারণ ছুটির যে অবসর পেয়েছি সেই অবসরে কী করণীয় তাও বলে দেয়া হয়েছে আলোচিত সূরার (৯৪ নং) ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতে। এখানে বলা হয়েছে, দ্বীনি বা দুনিয়াবি কাজের ফাঁকে যখনই অবসর হবে তখনই আল্লাহর ইবাদতে পরিশ্রম করতে হবে। ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত এই ইবাদত করতে হবে। আমরা জানি, ইবাদত অনেক ধরনের। নফল নামাজ থেকে শুরু করে যেকোনো ভালো কাজ যাতে আল্লাহ পাক সন্তুষ্ট হন, সেটাই আমরা করতে পারি। ফরজ ও নফল নামাজের পাশাপাশি এই অবসরে পবিত্র কুরআন নিয়ে বসতে পারি। কুরআন তিলাওয়াত এবং তা হৃদয়ঙ্গম করা ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ইবাদতে মশগুল হতে পারি। এ ছাড়া আমাদের আশপাশের গরিব মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে পারি। সর্বশেষ এবং ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, অবসর সময়ে সব সত্তাকে আল্লাহর দিকে নিবিষ্ট করতে হবে। নিজের অপরাধগুলো সম্পর্কে আল্লাহর কাছে বারবার ক্ষমা ও হেদায়েত চাইতে এবং আল্লাহর ভালোবাসায় নিজেকে সিক্ত করতে হবে।
সব মিলিয়ে আমাদেরকে ধৈর্যের সাথে ‘করোনা’ নামক মহাবিপদ মোকাবেলা করতে হবে। সরকার প্রতিরোধমূলক যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তা রাসূলুল্লাহ সা:-এর শিক্ষা হিসেবেই পালন করতে হবে। এর জন্য দরকার ধৈর্য। তাই রাসূল সা: তাগিদ দিয়েছেন ‘ধৈর্যের সাথে যার যার ঘরে অবস্থান করতে হবে’। সাথে সাথে আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস ও আস্থা আনতে হবে। অর্থাৎ প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সাথে সাথে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করতে হবে। কারণ, মহাশক্তিধর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা হতোদ্যম হয়ো না এবং চিন্তিত হয়ো না; তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন হও’ (সূরা আলে ইমরান ৩ : ১৩৯)।