প্রসঙ্গ করোনাভাইরাস : মৃত্যু নিয়ে আমি ভীত নই, তবে মরার জন্য তাড়াও নেই আমার
করোনাভাইরাস - সংগৃহীত
মৃত্যু নিয়ে আমি ভীত নই, কিন্তু মরার জন্য তাড়াও নেই আমার, তার আগে করার মতো অনেক কিছু আছে আমার : স্টিফেন হকিং
পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং আজ যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে বিশ্ববাসীকে মৃত্যু নিয়ে আতঙ্কিত হতে নিষেধ করতেন এবং সাহস দিতেন বেঁচে থাকার জন্য, বেঁচে থেকে জীবনের অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করার জন্য। বিশ্ব আজ মহাদুর্যোগের মুখোমুখি। গত বছর আমরা পৃথিবীর ফুসফুস জ্বালিয়েছি। কী অদ্ভুত! এই বছর আমাদের ফুসফুস আক্রান্ত হচ্ছে। কোবিড-১৯ যা করোনাভাইরাস ডিজিস নামে পরিচিত।
সিভিয়ার এ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম করোনাভাইরাস ২ (সার্স-কোভ-২) কোবিড-১৯ -এর কারণে শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে রোগটি আমাদের ফুসফুসে হয়ে থাকে। মানব ইতিহাসে করোনাভাইরাস নতুন নয়, অনেক পুরাতন। মানব করোনাভাইরাস ওসি৪৩-এর এমআরসিএ ১৯৫০-এর দিকে উৎপত্তি লাভ করে। সার্স-কোভ-২ এর পূর্বে পৃথিবীতে আরো ৬টি করোনা ভাইরাস ছিল। ২০০২ সালে সার্স ভাইরাস পৃথিবীতে তান্ডব চালিয়ে ছিল।
করোনাভাইরাস সারাবিশ্বে একটি মহামারি রূপে আবির্ভূত হয়েছে, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিশ্বে প্রায় ২০ লাখেরও বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে, সোয়া ১ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ দিতে হয়েছে। এটি একটি ভয়ঙ্কর রোগ যা ফুসফুসকে অচল করে দেয়। ভাইরাসটির কিছু অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে।
এক, ভাইরাসটি তার অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে যাকে মিউটেশন বলে। দ্বিতীয়, এটি মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। একজন মানুষের দেহে প্রবেশ করার পর বেশ কয়েক দিন তার লক্ষণ বা উপসর্গ প্রকাশ করে না (এটাকে ইনকিউবেশন টাইম বলে)। লক্ষণ বা উপসর্গ প্রকাশ করতে অনেকের বেলায় ১৪ দিন সময় লাগে। কিছু কিছু বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন যে, এর লক্ষণ প্রকাশ পেতে ২৪ দিনেরও মতো সময় লাগতে পারে। বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম কোরোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং গত ১৪ ই এপ্রিল শনাক্তকৃত রোগীর সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে এবং আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিশ্চিত করেছেন যে কোবিড-১৯ বাংলাদেশ কমিউনিটি পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে অর্থাৎ এটি এখন দেশের সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। যা মোকাবেলা করা বেশ কঠিন।
কোরোনাভাইরাসকে মোকাবেলা করতে হলে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এই ভাইরাসকে ভয় না পেয়ে সঠিক পরিকল্পনা এবং কর্মকৌশলের মাধ্যমে একে আমরা জয় করতে পারব। একটা জিনিস আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের এই লড়াই একটি অদৃশ্য শক্তির শত্রুর সাথে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুপক্ষকে পরাজিত করে জয়লাভ করেছি। এবার আমাদের জয়লাভ করতে হবে করোনাভাইরাস বিরুদ্ধে। যেহেতু এই শত্রু অদৃশ্য, তাই সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একে আমরা পরাজিত করব।
আমাদের দেশের প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ জনগোষ্ঠী অতি দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে, যাদের কাছে করোনাভাইরাস থেকে ক্ষুধার যন্ত্রণা অনেক বেশি এবং এই বিশাল জনগোষ্ঠী যারা দিন আনে দিন খায়। তাদেরকে প্রতি দিন কাজের জন্য বের হতে হয় এবং খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হয়। গত ২৬ মার্চ থেকে মূলত দেশে অচল অবস্থা বিরাজ করছে। যারা দিনে আনে দিনে খায় তাদের আয় কমে গেছে বা নেই এবং ঘরে খাবারেরও যোগান নেই। খাবার না পেলে এই জনগোষ্ঠী ঘরে থাকবে না। তাদের যদি আগামী এক থেকে দুই মাস পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্যের যোগান দিয়ে বাসায় রাখা যায়। আমি বিশ্বাস করি, তবেই করোনাভাইরাসকে প্রতিহত করা সম্ভব হবে।
আমাদের দেশে বিশাল এক জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা রোগবালাই সম্পর্কে সচেতন নয়। যেকোনো মানুষ যেকোনো রোগের চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছানোর পর ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। শেষ মুহূর্তে ডাক্তারের কাছে গিয়ে তখন আর শেষ রক্ষা হয় না। এটার মূল কারণ হচ্ছে মানুষের অজ্ঞতা ও রোগে প্রতি অবহেলা। এই বিশাল সংখ্যক মানুষ করোনাভাইরাস সম্পর্কে এখনো সম্পূর্ণরূপে সচেতন নয়। তাদের কোবিড-১৯ হলে কিভাবে টেস্ট করতে হয় সেটিও অজানা। এই বিশাল জনগোষ্ঠী আক্রান্ত কিনা সেটি বোঝার জন্য আমাদেরকে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো প্রতিটি জেলা শহরের রাস্তায় রাস্তায় বসে স্যাম্পল কালেকশন করে পরীক্ষা করতে হবে। অন্যথায় এটিকে কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। টেলিফোন কল করে টেস্টের জন্য কোথাও যাওয়া এই বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর পক্ষে চিন্তা করাও সম্ভব নয় বা টেস্টের জন্য যাওয়ার আগে অনেক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে (দেরি করার কারণে)। সুতরাং, এটি আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট। কোরোনা প্রতিরোধে টেস্টের বিকল্প নেই। এন্টিবডি টেস্ট পদ্ধতি চালু করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে এবং এটি অসুস্থ ও সুস্থ রোগী শনাক্ত করতে খুবই সহায়ক হবে। সুস্থ মানুষ ফ্রন্ট লাইনে কাজ করতে পারবে। আমাদের এখন সুস্থ রোগীর সংখ্যা বেশি দরকার। করোনাভাইরাস বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে ডাক্তার, পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে- এর জন্য পর্যাপ্ত প্রটেকটিভ গিয়ার নিশ্চিত করা জরুরি। আমাদেরকে বর্তমানে আমেরিকার দিকে নজর রেখে প্রস্তুতি নিতে হবে।
মনে রাখতে হবে, আমেরিকার মতো আমাদেরও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে পারে এবং মৃত ব্যক্তির সংখ্যাও বাড়তে পারে। বিশাল সংখ্যক আক্রান্ত রোগী এবং মৃত ব্যক্তির ব্যবস্থাপনা করার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়া দরকার সেটির এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে । এক মুহূর্ত দেরি করলে, আমাদের জন্য একটি বিশাল ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এই অবস্থায় সাহস, ধৈর্য এবং সহনশীলতার নিয়ে সবার একসাথে কাজ করা উচিত।
করোনাভাইরাসে জনগণের করণীয় সব থেকে বেশি। একজন সুনাগরিকের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালন করা। আজকের এই দুর্যোগময় মুহূর্তে প্রত্যেক নাগরিক রাষ্ট্রের জন্য বিশাল অবদান রাখার সুযোগ এসেছে। প্রত্যেকে দেশপ্রেমিক নাগরিক ঘরে থেকে দেশ, সমাজ ও পরিবারের অনেক বড় উপকার করতে পারে। বাইরে বের হওয়া হতে বিরত থাকা উচিত। বাইরে বের হলে মুখে মাস্ক, চোখে সান গ্লাস বা গগল্স ব্যবহার করা এবং প্রত্যেক ব্যক্তি থেকে কমপক্ষে ৬ ফুট থেকে ১৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা নিরাপদ (তাইওয়ান, ভিয়েতনাম ও হংকং মাস্ক ব্যবহার এবং শারিরীক দূরত্ব বজায় রাখায় তাদের অবস্থা এখন অনেক ভালো রয়েছে। বিশ্ব সংস্থা তাইওয়ানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ)। বাসায় ফিরে কোনো কিছুর স্পর্শ না করে, হাত সাবান দিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধোয়া উচিত। তারপরে সাবান দিয়ে নিজের মুখ ধোয়া করা উচিত। সাবান বা শাম্পু সাথে গরম পানি দিয়ে গোসল সেরে ফেলতে হবে। যেসব কাপড় পরিধান করে বাইরে যাবেন, সেসব কাপড় সাবান দিয়ে ধুয়ে দিন। বাসায় ফিরে বাইরে থেকে নিয়ে আসা সব কিছু জীবাণুমুক্ত করার চেষ্টা করুন। যেসব জিনিস সাবান পানিতে রাখা যায়, সেগুলোকে সাবান পানিতে ২ মিনিট রেখে পরিস্কার পানি দিয়ে ধৌত করা উচিত। মাছ, গোশত কাটার সময় এবং রান্না করার সময় যিনি রান্না করবেন, তিনি যেন নাক-মুখ স্পর্শ না করেন। মনে রাখুন, আপনি যত বেশি বাইরে যাবেন আপনার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে। সমাজে যারা বিত্তশালী আছেন অসহায় মানুষদের পাশে এগিয়ে আসুন। গরিব অসহায় মানুষদেরকে (যতজনকে পারা যায়) কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ দিনের খাবার দিয়ে সাহায্য করুন। নিজ নিজ গরিব স্বজনদের সাহায্য করুন। এখন মানব সেবা করার সুযোগ এসেছে, মানবিক হওয়ার সুযোগ এসেছে। কোরোনায় আক্রান্তদের প্রতি মানবিক আচরণ করুন, তাদের সখীপুরের জঙ্গলে ফেলে আসবেন না। মানুষের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হলে কোরোনা থেকে বিনা চিকিসায়ও ভালো হওয়ার নজির রয়েছে। কোরোনা রোগীর সাথে মানবিক আচরণ করুন। মনে রাখুন, আপনি আক্রান্ত হলে অন্যের কাছে কিরুপ আচরণ আশা করেন, ঠিক তেমন আচরণ করুন। এই সময় কম খান। রাজকীয় ভোজবিলাসের সময় এটা নয়। আপনি কম খেলে, আরেকজন খাওয়ার সুযোগ পাবে।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের সীমিত সম্পদ এবং লোকবল দিয়ে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। আমরা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এই যুদ্ধে জয়লাভ করবোই। প্রধানমন্ত্রী আমাদের সাহস দিয়ে বলেছেন মেঘের আড়ালে রোদ হাসে, অন্ধকারের পর আলো আসে। নতুন দিনের রোদ, নতুন দিনের আলোর। আসুন সবাই মিলে মৃত্যুকে প্রতিরোধ করি। আমেরিকা বা ইউরোপের মতো দেশটাকে মৃত্যু উপত্যকা বানাবেন না। আমার দেশকে মৃত্যুর উপত্যকা হিসেবে দেখতে চাই না।
লেখক : সামাজিক গবেষক
সাবেক গবেষক ইউএনডিপি, সাবেক রির্সাচ ফেলো, এ্যাকশন এইড