হঠাৎ করেই ভারতের রাজনীতিতে উদয় হয়েছিল আন্না হজারের। প্রবীণ এই গান্ধীবাদী যখন লোকপালের দাবিতে দিল্লিতে অনশনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন প্রথম প্রথম তার পাশে হাফ শার্ট, ঢোলা প্যান্টের ছোটখাটো চেহারার ভদ্রলোককে অনেকেই নজর করতেন না। চোখে পড়ার মতো চেহারাও ছিল না। কিন্তু সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা হলেই অনুরোধ করতেন, লোকপাল বিলের নতুন খসড়াটা পড়ে দেখবেন! নামগুলো পালটে পালটে যেত, ‘ড্রাফট লোকপাল বিল ১.০’, তার পর ‘২.০’, ‘৩.০’।

অরবিন্দ কেজরিওয়াল এখন নিজেই ভোল পালটে ‘কেজরিওয়াল ৩.০’।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী। তার পর মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রশাসক। তৃতীয় বার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসে তিনি এখন এমন এক রাজনীতিক, যার কাছে ভোটের অঙ্কটাই শেষ কথা।

সিএএ-এনআরসি বিরোধী শাহিন বাগের মুসলিম মহিলারাই হোন বা উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে সহিংসতায় আক্রান্ত মুসলিম, ভোটের অঙ্ক কষেই কেজরিওয়াল এদের পাশে দাঁড়াননি বলে অভিযোগ উঠেছিল। তার পুরনো সতীর্থদের মতে, এ বার পশ্চিমবঙ্গ-বিহার-উত্তরপ্রদেশ থেকে দিল্লিতে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের প্রতি উদাসীনতা দেখিয়েও কেজরিওয়াল বুঝিয়ে দিলেন, ভোটের ফসল না দেখলে কেজরিওয়াল কাউকে নিয়ে মাথা ঘামান না।

অথচ গান্ধীর অনশনকে হাতিয়ার করে আন্না হাজারের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন থেকে উঠে এসেছিলেন সে দিনের তরুণ রাজনীতিক। খড়গপুরের আইআইটি-র সাবেক ছাত্র, রেভেনিউ সার্ভিসের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। নিজের হাতে আম আদমি পার্টি তৈরি করে রাজধানী দিল্লির বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী গদি ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। ভারতীয় রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার মতো ঘটনাই বটে। আম জনতা আম আদমি পার্টিকে দেখে নতুন আশায় বুক বেঁধেছিল। ইনি হয়তো হিন্দু-মুসলমান, জাতপাতের রাজনীতিতে ঢুকবেন না। কিন্তু আশা পূরণ হলো না। কেজরিওয়াল আর পাঁচজন রাজনীতিকের ছকেই পড়ে গেলেন।

দিল্লির তথাকথিত ‘খান মার্কেট গ্যাং’, অর্থাৎ দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তিত, শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী, যাঁরা খান মার্কেটের কাফেতে বসে উদারবাদী অর্থনীতির মধ্যেও গরিব মানুষের সুরাহার কথা ভাবেন, তাদের স্বপ্নভঙ্গের শুরু ১১ ফেব্রুয়ারি। তৃতীয় বারের জন্য দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর গদি পেয়েই কেজরীবাল কনট প্লেসের হনুমান মন্দিরে পূজা দিতে ছুটলেন। পুজো দিয়ে কেজরিওয়াল জানালেন, হনুমানজির আশীর্বাদেই তার জয়। এবার পাঁচ বছর হনুমানজিই তাকে পথ দেখাবেন। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরে ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি উঠল।

সে দিন বিজেপির হার সত্ত্বেও অলক্ষ্যে সঙ্ঘ পরিবারের নেতাদের মুখে হাসি ফুটেছিল। এটাই তো তারা বরাবর চেয়ে এসেছেন। ভারতের মূল স্রোতের রাজনীতিকরা প্রকাশ্যে নিজেদের হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পাবেন না। তাই রাহুল গান্ধীর মতো কেউ আচমকাই নিজেকে লোকসভা ভোটের আগে নিজেকে পৈতেধারী শিবভক্ত বলে তুলে ধরলে বা খড়্গপুরের আইআইটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে রাজনীতিতে আসা অরবিন্দ কেজরিওয়াল নিজেকে হনুমান-ভক্ত বলে পরিচয় দিলে, বিজেপি বা সঙ্ঘ-পরিবারের নেতারা খুশিই হন। রাজনীতির স্বার্থে হিন্দু ধর্মকে ধারণ করার অভিযোগ শুধু আর তাদের ঘাড়ে এসে পড়ে না। আরএসএস নেতা সুরেশ ভাইয়াজি জোশী তাই বলেছিলেন, “বিজেপি-র বিরোধিতা করার অর্থ হিন্দুদের বিরোধিতা করা নয়। রাজনৈতিক লড়াই চলবে। তার সঙ্গে হিন্দুত্বের কোনো সম্পর্ক নেই।”

আসলে বিজেপির বিরোধিতা করে কেজরিওয়ালের উত্থানও হয়নি। বরঞ্চ ২০১১-র আন্না হজারে-অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে বিজেপিরই লাভ হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদিরও। কারণ আন্দোলনের তীর ছিল দুর্নীতির অভিযোগে শরশয্যা নেয়া দ্বিতীয় ইউপিএ-সরকারের দিকে। কিন্তু ২০১৫-র পর ২০২০-তেও নরেন্দ্র মোদির বিজয়রথ কেজরিওয়াল থামিয়ে দিতে পারেন বলে কংগ্রেস, বাম মনোভাবাপন্ন, উদারমনস্ক. ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী মানুষ কেজরিওয়ালেই বাজি ধরেছিলেন। পরে আফশোস করেছেন। কিন্তু এ ছাড়া তাদের উপায় ছিল না।

যেমন উপায় ছিল না দিল্লির প্রায় ১৪ লাখ মুসলমানেরও। দিল্লির ভোটের আগেই তারা দেখছিলেন, শাহিন বাগে মুসলিম মহিলারা সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে বসেছেন। কিন্তু কেজরিওয়াল সে দিকে ঘুরেও দেখছেন না। মুখে দু’এক বার সিএএ-এনআরসিতে আপত্তি তুললেও এ নিয়ে মুখর হতে তিনি নারাজ। কিন্তু দিল্লির প্রায় ১৩ শতাংশ মুসলিমের আম আদমি পার্টিকে ভোট দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। কারণ কংগ্রেস লড়াইয়ের ময়দানেই ছিল না।

কেজরিওয়ালই জিতলেন। বিজেপির হারে কংগ্রেস, বামমনোভাবাপন্ন, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী মানুষের সঙ্গে মুসলিমরাও খুশি হলেন। ভাবলেন, কেজরিওয়াল নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহর বিজেপিকে উচত শিক্ষা দিয়েছেন। অচিরেই ভুল ভাঙল। সেই সিএএ-এনআরসি নিয়েই উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে সহিংসতার সৃষ্টি হলো। কিন্তু কেজরিওয়াল, তার সরকার, তার পার্টি কার্যত হাত গুটিয়ে বসে থাকল। উত্তর-পূর্ব দিল্লির পাঁচটি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার মানুষ আপ-কে ভোট দিয়েছিলেন। সেই সব এলাকাতেই যখন আগুন জ্বলছে, তখন কেজরিওয়াল একবারও মহল্লায় ছুটে গেলেন না। তার পার্টির কর্মীরা সহিংসতা রুখতে রাস্তায় নামলেন না। সর্বোপরি দিল্লির সহিংসতার জন্য তিনি এক বারও অমিত শাহ বা বিজেপির দিকে আঙুল তুললেন না।

ভোটের আগে কেজরিওয়ালের ৩৭০ ধারা রদের সমর্থন করা বা শাহিন বাগের পাশে না দাঁড়ানোর স্পষ্ট কারণ ছিল। বিজেপি তার বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণের অভিযোগ তুলত। কেজরিওয়াল উন্নয়নের প্রশ্নে ভোট চাইছিলেন। তিনি চাননি, বিজেপি মেরুকরণ করে বাজিমাত করুক। কিন্তু ভোটের পর?

এই স্বপ্নভঙ্গের উত্তর বোধহয় লুকিয়ে রয়েছে কেজরিওয়ালের নিজের স্বপ্নভঙ্গে। তার পুরনো সতীর্থরা জানেন, কেজরিওয়ালের আসল স্বপ্ন প্রধানমন্ত্রীর গদি। ২০১৫-য় দ্বিতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরই তিনি ২০১৯-এর লক্ষ্য স্থির করেছিলেন। তাই দিল্লি থেকে শুরু করে পাঞ্জাব, গুজরাত, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ডে আম আদমি পার্টির শিকড় ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন। সেই কারণেই নিজের বিক্ষোভকারী ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে সুশাসক-এর বর্মে নিজেকে ঘিরে ফেলেছেন। কিন্তু গত পাঁচ বছরে কোনো রাজ্যের বিধানসভাতেই তার দল ১ শতাংশ ভোটও পায়নি। দিল্লির মানুষও যে তার দলকে আঞ্চলিক দল হিসেবেই দেখে, তা-ও বুঝে গিয়েছেন কেজরিওয়াল। ২০১৫, ২০২০-এ তিনি বিপুল ভোটে বিধানসভায় জিতেছেন। কিন্তু দু’বারই তার আগের বছরের লোকসভায় দিল্লির একটি আসনও জিততে পারেননি।

কেজরিওয়াল জানেন, তাকে যারা ভালো কাজের জন্য বিধানসভায় ভোট দিয়েছেন, তারাই কয়েক মাস আগে নরেন্দ্র মোদিকে ভোট দিয়েছেন। তাই জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুত্বর প্রশ্নে কোনো ভুল চাল দিতে চাননি। মুসলিম তোষণের কোনো ছাপ্পা তিনি নিজের গায়ে লাগতে দিতে চান না। কারণ তিনি দিল্লির ৮০ শতাংশ হিন্দু ভোট হারাতে চান না। আর ১৩ শতাংশ মুসলিম ভোট? সে ভোট তো বিজেপি এমনিতেই পাবে না।

এই ভোটের হিসেব কষে চলার ফলেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয় ইনিংসে প্রথম কালির ছিটে দিল্লির সহিংসতায় ৫৩ জনের মৃত্যু। এ বার করোনাভাইরাসের মহামারির সময় দ্বিতীয় কালির ছিটে ভিন্‌রাজ্যের শ্রমিকরা। গোটা দেশ অবাক হয়ে দেখল, লকডাউনের মধ্যেই দিল্লির রাস্তায় সারা দিন, সারা রাত ধরে শ্রমিকরা স্ত্রী-পুত্র-কন্যার হাত ধরে পথ হাঁটছেন। ফিরতে চাইছেন উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবাঙ্গায়। কিন্তু মোদি সরকারের মতোই আপ সরকারও হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে। তাদের ঘরে ফেরানোর চেষ্টা না করে সরকারি বাসে গাদাগাদি করে তুলে উত্তরপ্রদেশ সীমান্তে পৌঁছে দিয়ে দায় সারছে।

কেন? ওরা দিল্লির ভোটার নন। ওদের থাকা, না থাকায় কেজরিওয়ালের কিছু যায় আসে না।

রাজনীতিতে এসে কেজরিওয়াল দেশের রাজনীতি বদলে দেবেন বলে আশা ছিল। আসলে রাজনীতি কেজরিওয়ালকেই বদলে দিয়েছে। এটি জন-আন্দোলনের নায়ক কেজরিওয়ালের আদি অবতার নয়। মুখ্যমন্ত্রী-সুশাসকের দ্বিতীয় অবতারও নয়। এটি কেজরিওয়ালের তৃতীয় অবতার। ‘কেজরিওয়াল ৩.০’।

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা