করোনার বিরুদ্ধে লড়াই : এক বাংলাদেশী চিকিৎসকের মর্মস্পর্শ দিনলিপি
এক বাংলাদেশী চিকিৎসকের মর্মস্পর্শ দিনলিপি - সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের আবিংটন ল্যান্সডেল হসপিটালের ডাক্তার কাজী আলতাফ হোসেন এমডি। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এই ডাক্তার যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার ওই হাসপাতালে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে কাজ করছেন। কোভিড-১৯ মহামারীর এ সময়টিতে হাসপাতালে তিনি এবং তার সহকর্মীরা কিভাবে দিনাতিপাত করছেন, কিভাবে নিজেদেরকে মানিয়ে নিচ্ছেন, সে বিষয়টি ডিসকভার আইল্যান্ড নামের একটি নিউজ পোর্টালে তুলে ধরেছেন তিনি। তার নিজের কথাতেই বিষয়টি এখানে (ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করে) তুলে ধরা হলো।
হাসপাতালে যাওয়ার পথটি একেবারেই ফাঁকা। দিনের শুরুতে কর্মস্থলে যাওয়ার এই সময়টা আমার কাছে বড় প্রিয়। নিজের গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি গন্তব্যের দিকে। রাস্তার দুই ধারের পাহাড়ের ঢালুতে গাছে গাছে ফুল ফুটে আছে, ডুমুরের ফুলে ফুলে পাখিদের কলকাকলি ছাড়া বসন্তের এই ছিমছাম রাস্তায় আজ কোনো জনমানব নেই। কয়েকটি হরিণ শাবককে দেখছি খোলা প্রান্তরে খেলে বেড়াচ্ছে। অলসভঙ্গিতে ট্রাফিক লাইটগুলো আলোর রঙ পরিবর্তন করছে। রাস্তার দুই ধারের শপিংমলগুলো ফাঁকা, দোকানপাট বন্ধ। কেউ জানে না ওগুলো আবার কবে নাগাদ খুলবে।
আজ এপ্রিলের ১০ তারিখ। কোভিড-১৯ এর মরণ ছোবলে এ দেশে এ পর্যন্ত ১৮ হাজারেরও অধিক লোক মৃত্যুবরণ করেছে। আর সারা বিশ্বে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে লাখেরও ওপরে। ফিলাডেলফিয়ার মন্টগোমারি কাউন্টিতে আমার হাসপাতালটিতে কোভিড-১৯ সন্দেহে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক রোগী ভর্তি হয়েছে। প্রাথমিক পরীক্ষায় তাদের বেশির ভাগই কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ধরা পড়ছে। রোগের নমুনা পরীক্ষা করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রেজাল্ট দিতে হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, প্রাথমিকভাবে পরীক্ষায় নেগেটিভ ফল এলেও পরবর্তীতে টেস্টে আবার পজিটিভ রেজাল্ট পাওয়া যাচ্ছে; যার কারণে প্রাথমিক রেজাল্ট নেগেটিভ পাওয়া গেলেও নতুন করে নমুনা নিয়ে তাদের আবার টেস্ট করা হচ্ছে।
এ ঘটনাটি ভুলে যাওয়ার মতো নয় : এর আগের দিনের কথা। নব্বই উত্তীর্ণ আমার এক রোগী কোভিড-১৯ এ মারা যাচ্ছিলেন। তার লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলা হয়েছে। এখন তিনি অন্তিমযাত্রার জন্য ‘প্রস্তুতিকক্ষে’ রয়েছেন। কোভিড-১৯ তার স্পঞ্জের মতো ফুসফুসটাকে (লান্স) শক্ত কঠিন করে ফেলেছে। লান্সের ভেতরে এই রোগটি তরল ইনফ্লামেশন ও ইনফেকশন তৈরি করে রেখেছে। এখন তার লান্স তাকে আর জীবিত রাখার মতো অক্সিজেন এনে দিতে পারছে না।
ঠিক এ অবস্থায় ভেন্টিলেটর সাপোর্টে রাখা হয়েছে তাকে। আইসিইউর কিউবিকলের কাচের গ্লাসের অপর পাশ থেকে আমি তাকে দেখছি। জীবনের শেষ মুহূর্তের শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছেন তিনি। তাকে শেষ বিদায় জানানোর মতো আপনজন কেউ-ই কাছে নেই। শেষ বিদায়ের এই সময়টিতে তার হাত ধরে একটু বসে থাকবে, একটু সান্ত¡নার বাণী শোনাবেÑ পরিবারের এমন কোনো সদস্য এখন আর তার কাছে নেই। মৃত্যু শয্যায় ভালোবাসা জানানোর মতো কোনো ভিজিটরও কাছে কিনারে নেই; বরং এই সময়টাতে কেউ কাছে থাকুক এটা আমরাও চাই না। বড় রিস্কি এটা। এতে এই ডেডলি ভাইরাস হয়তো ওই ভিজিটরের শরীরেও ঢুকে যেতে পারে। জীবনের শেষ মুহূর্তে একটুখানি ভালোবাসা, একটুখানি আলিঙ্গন কিংবা শেষ বিদায়ের চুম্বন যেন মৃত্যুকেই চুম্বন করার নামান্তর। সেটি আর ভাগ্যে জুটছে না। এই বিশ্ব মহামারীর সময়ে জীবনটা এমনই হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও এ কথা বলতে পারছি যে, আমার এই বৃদ্ধ রোগীটির ভাগ্য ভালো। কারণ তার পরিবার তার লাশ নিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায়নি। এই বিপজ্জনক ভাইরাসের ভয়ে অনেক পরিবারই এখন এমনটি করছে। জানতে পেরেছি, নিউ ইয়র্কে এমন মৃত্যুতে অনেক পরিবারই তাদের প্রিয় জনের লাশ গণকবরে দাফন করার জন্য ফেলে রেখে যায়।
জীবনের লড়াইয়ে হেরে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে জেতা : আমার আরেক রোগীর কথা বলি। তিনি যুবক ও ক্রমান্বয়ে সেরে উঠছেন। তিনি ভর্তি হয়েছিলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট নিয়ে। মারাত্মক রকমের নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে তার কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়ে। রোগটির বিরুদ্ধে তার শ্বাসযন্ত্র (লান্স) বুঝি বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে আসার পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে তার। এখন আর অক্সিজেন দিয়ে রাখা হচ্ছে না তাকে। নিজে নিজেই শ্বাস নিতে পারছেন। হয়তো তাকে রিলিজ দেয়ার সময় হয়ে উঠছে। তাকে রিলিজ দেয়া হলো এবং ডিনারের পর তিনি বাড়ি যাবেন। দিনের শেষ দিকে নার্স এসে আমাকে জানালেন, ওই যুবকটি চলে যেতে চান না। কেন চান না সেটা নার্সকে তিনি বলেননি, আমাকে জানাতে চান। কোভিড-১৯ রোগীর সাথে দূরত্ব বজায় রাখার কারণে আমি কথা বলার জন্য তার রুমে ফোন দিলাম। তিনি যা বললেন, তা অতি সাধারণ ঘটনা হলেও আমি শুনে অবাক হলাম। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বাস করেন তিনি। সেখানে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে চলা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তিনি সে বিষয়টিই জানালেন আমাকে।
যুবকটি বললেন, স্ত্রী ও তার ছোট্ট এক শিশুকে নিয়ে থাকেন তিনি। এক বেডরুমের অ্যাপার্টেমেন্ট বাসা। তখন আমি বুঝতে পারলাম তার সমস্যাটা কোথায়। কেন তিনি তার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যেতে চান না। তার স্ত্রী বা সন্তানটাকে তিনি সংক্রমিত করতে চান না। ছোট্ট ওই অ্যাপার্টেমেন্টে তিনি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে পারবেন না। এমনকি একই রুমে এবং একই বাথরুম ব্যবহার করে তিনি সবাইকে নিরাপদে রাখতে পারবেন না।
আসলে এ বিষয়ের সমাধান আমারও নেই। সামর্থ্যে যেটুকু কুলায় তার বেশি কিছুই করার নেই আমার। আমি তাকে হাসপাতালে আরো এক রাত রেখে দিলাম। পরের দিন সকালে তিনি হাসপাতাল ছাড়লেন এবং কোয়ারেন্টিন পালন করা পর্যন্ত তিনি একটি হোটেলে গিয়ে উঠলেন। যদিও হোটেলের ব্যয় বহন করার মতো সামর্থ্য তার নেই। হোটেল বিল পরিশোধ করবেন তার ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে, যা তিনি আগামী দিনগুলোতে উপার্জন করে পরিশোধ করবেন।
এ সময়ে আমরা কী-ই বা করতে পারি?
আক্ষরিক অর্থে পৃথিবীটা যেন থেমে আছে। লন্ডন, ব্রাসেলস ও লস অ্যাঞ্জেলেসের ভূকম্পন বিজ্ঞানীরা ভূকম্পন শব্দের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন। এর কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছেন, পৃথিবী নামক এই গ্রহে মোটরযান, গাড়িঘোড়া, কলকারখানা ও অন্যান্য যানবহান চলাচল একেবারেই কমে গেছে। কোনো উড়োজাহাজ উড়ছে না। কোনো শব্দের কম্পন হচ্ছে না, বুলডোজার্সের ভাঙনও থেমে গেছে। আকাশে তীক্ষè দৃষ্টিতে থাকা ভূ-উপগ্রহ পৃথিবীটাকে দেখতে পাচ্ছে আগের চেয়ে অনেক স্বচ্ছ ও নির্মল। পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডল হয়ে উঠছে পরিষ্কার ও অমলিন। আমাদের এই পৃথিবীটা যেন এখন নিঃশ্বাস নিতে পারছে। পৃথিবী পৃষ্ঠে মানুষের ব্যস্ততা থেমে যাওয়ার কারণে ভূকম্পন কমে গেছে।
এই ধরিত্রীকে মানুষ কত কষ্টই না দিয়েছে এত দিন!
সম্পদের প্রতি লোভ-লালসায় আমরা পৃথিবীকে চুষে চুষে খেয়েছি। আমাদের তৈরি যন্ত্রযানগুলো নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে বাতাসে বিষবাষ্প ছড়িয়েছে। পৃথিবীর আবহাওয়াকে প্রতিদিনই আরো বিষাক্ত ও উষ্ণ করে তুলেছে। আমাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিক দিয়ে ভরে ফেলেছি সাগর মহাসাগরকে। তাদের ভেতরের প্রাণী ও প্রকৃতিকে মেরে ফেলেছি। উষ্ণতায় পৃথিবীর বরফকে গলিয়ে ফেলছি।
আমরা এখন আইসোলেশনের ছ্ট্টো ঘরে বন্দী। মুখে মুখে এন-৯৫ মাস্ক পড়ে থাকি। আর সে কারণেই পৃথিবী সত্যিকার অর্থে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে। কোভিড-১৯ ভাইরাসের মাধ্যমে প্রকৃতি কী আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে, এই পৃথিবী নামক গ্রহটি আমাদেরকে আর তার প্রয়োজন মনে করছে না? আমরা কি পৃথিবীর জন্য কোভিড-১৯ ভাইরাসের মতো মারাত্মক হয়ে গেছি?
এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছি : দিনের শেষ সময়টা পর্যন্ত আমি যখন হাসপাতালে থাকি, আমার অবচেতন মন চলে যায় একটি তালিকার দিকে। নিজেকে রক্ষা করতে আজ কী কী করেছি আমি। নিজের মধ্যেও কি এই মরণ ভাইরাস বহন করে নিয়ে যাচ্ছি? নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এ এক মরণ যুদ্ধ যেন। আগামীকাল আরেকটি দিন আসবে। বেঁচে থাকার জন্য আরেকটি যুদ্ধ শুরু হবে তখন। হাসপাতালের দেয়ালে, করিডোরে ও অলিতে গলিতে শুভেচ্ছা বাণী চোখে পড়ছে। ডাক্তার ও নার্সদের জন্য পোস্টারে পোস্টারে লিখে রাখা হয়েছে, ‘তোমরাই আমাদের হিরো’, ‘আমরা আছি তোমাদের সাথে’, ‘তোমাদের প্রতি আমাদের অসীম ভালোবাসা’, ‘আমাদের প্রার্থনায় রয়েছো তোমরাও’ প্রভৃতি। হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় এলিভেটরের ভেতরে এসে যখন দাঁড়াই, ক্লান্তিতে ভরে যায় মন। অবসাদে এলিভেটরের দেয়ালে দেহটাকে এলিয়ে দিতে ইচ্ছা করে। আর ঠিক তখনই চকিত সচেতন হই। নিজের মনটাকে পরিবর্তন করে ফেলি। হয়তো এই এলিভেটরের দেয়ালেও লুকিয়ে রয়েছে অদৃশ্য সেই ঘাতক ভাইরাস! কে জানে কোন রোগীর হাতের স্পর্শ লেগেছে দেয়ালে। আমি চাই না সেই ভাইরাসের ছোঁয়া লাগুক আমার গায়ে আর আমি বহন করে নিয়ে যাই সেগুলোকে আমার বাসায়। কিছুতেই যে আমি তা হতে দিতে পারি না।