করোনা যে আশার আলো দেখাতে পারে

করোনা যে আশার আলো দেখাতে পারে - সংগৃহীত
আশঙ্কার সাথে নোয়াম চমস্কি আশার কথাও ব্যক্ত করেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, নয়া উদারতাবাদ অবশেষে আশার কারণ রয়েছে। করোনাভাইরাসের একটা ভালো দিক হলো- মানুষ এটা ভাবতে বাধ্য হবে যে, আমরা বসবাসের জন্য কী ধরনের পৃথিবী চাই? দীর্ঘ দিন ধরে ভাইরাসের আশঙ্কা করছিল পৃথিবী। ১৫ বছর আগে সার্স মহামারী এসেছিল।
এর প্রতিষেধকও আবিষ্কৃত হয়েছিল। পরবর্তী মহামারীর আশঙ্কা সত্ত্বেও পৃথিবীর গবেষণাগারগুলো এ ধরনের ভাইরাসকে প্রতিহত করার জন্য গবেষণায় লিপ্ত হয়নি। তার কারণ, বাজার অর্থনীতি। বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো ভাইরাস প্রতিষেধক আবিষ্কারে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা দেখেনি। এভাবে আমরা বেসরকারি স্বৈরাচারের কাছে নিজেদের সমর্পণ করেছি। এরই নাম বহুজাতিক করপোরেশন। এরা জনগণের কাছে জবাবদিহি করে না। এদের কাছে ভাইরাস প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেয়ে শরীরের জন্য নতুন ক্রিম আবিষ্কার অধিকতর লাভজনক। জনগণের ধ্বংসের চেয়ে মুনাফা তাদের জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে তিনি ১৯৫০ দশকের পোলিও মহামারীর কথা স্মরণ করেন। সে সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সলক’ প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারের ফলে জনগণ এই রোগ থেকে রক্ষা পায়। এবারো এ ধরনের ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু নয়া উদারতাবাদের ‘প্লেগ’ সরকারকে তা করতে দেয়নি। করোনাভাইরাস প্রতিহতকরণে ব্যবহৃত যুদ্ধকালীন ভাষা ও টার্ম ব্যবহার সম্পর্কে তার মতামত চাওয়া হলে তিনি এর যৌক্তিকতার পক্ষে মত দেন। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস করোনাভাইরাস সঙ্কটকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে অভিহিত করেছেন। নোয়াম চমস্কি তার সাথে একমত পোষণ করেন। তিনি করোনাভাইরাস পরবর্তী মন্তব্য করেন, চরম কর্তৃত্ববাদী নিষ্ঠুর রাষ্ট্রগুলো সমাজের আশু পুনর্গঠন এবং অধিকতর মানবিকতা প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। তিনি মন্তব্য করেন- আমাদের মনে রাখতে হবে, চরম কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলো কথিত নয়া উদারতাবাদের প্রতিরূপ।
নোয়াম চমস্কি করোনাভাইরাসের মতো মহামারীকে গরিব দেশ ও গরিব মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় সঙ্কট বলে মনে করেন। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী দেশের পক্ষে মহামারী পরবর্তী অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবেলা করা সম্ভব, কিন্তু যে সব দেশে সাধারণ মানুষ দারিদ্র্যসীমার মধ্যে বসবাস করে তাদের অবস্থা ভিন্নতর। টোটাল লকডাউন বা সর্বাত্মক বিচ্ছিন্নতার সময়ে গরিব মানুষ খুবই অসহায় হয়ে পড়ে। এ সময়ে তাদের সাহায্যের জন্য ধনী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আর ধনী রাষ্ট্রগুলোর উচিত, বিশ^সভ্যতার এই পর্যায়ে গরিব দেশগুলোর জন্য অনৈতিক অবরোধ এবং সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার পরিবর্তে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করা। এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য মানুষকে সম্ভাব্য সব উপায়ে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, বর্তমান গণমাধ্যম ব্যক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেয়ে বিচ্ছিন্নকরণে সক্রিয় রয়েছে। তিনি এ ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির চরম বিকাশকে দায়ী করেন।
তিনি উল্লেখ করেন, মোবাইল ফোন বিশেষত নতুন প্রজন্মকে অধিকতর বিচ্ছিন্ন করে তুলছে। এ প্রসঙ্গে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে স্বআরোপিত সংস্কৃতির সমালোচনা করেন। তিনি সামাজিক বন্ধন জোরদার করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, বর্তমান ভাইরাসজনিত বিচ্ছিন্নতার চেয়ে প্রযুক্তিগত বিচ্ছিন্নতা হচ্ছে প্রকৃত বিচ্ছিন্নতা। যেভাবেই হোক- সাংগঠনিক পরিধি বাড়িয়ে, সমাজের গতিশীলতা বৃদ্ধি করে, কর্মের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করে এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে- ‘মানুষকে একীভূত করতে হবে’। মানুষ যে সমস্যা মোকাবেলা করছে- পরামর্শ দিয়ে, সহায়তা দিয়ে এবং কাজের মধ্যেমে মানুষকে উজ্জীবিত করতে হবে।
নোয়াম চমস্কির ভাষায়, উপর্যুক্ত আলোচনা বর্তমান সময়ে ও সভ্যতার যথার্থ চিত্র তুলে ধরে। অপ্রিয় সত্য কথা বলার জন্য তার জুড়ি নেই। গোটা পৃথিবীর নাগরিক সাধারণ্যে রয়েছে তার আকাশছোঁয়া গ্রহণযোগ্যতা। করোনাভাইরাসের এই সময়ে এবং ভাইরাস উত্তীর্ণ পর্যায়ে তার কথা ও পরামর্শ আমাদের আলোকবর্তিকা স্বরূপ- এই আমাদের ব্রত হোক।