করোনাভাইরাস ভারতের জন্য একটি সুযোগ!
করোনাভাইরাস ভারতের জন্য একটি সুযোগ! - সংগৃহীত
চীনের নিজস্ব নজরদারি মডেলের আলোকে ভারত একটি ব্যাপক বিস্তৃত নজরদারি ব্যবস্থা তৈরীর দিকে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারি শনাক্ত করার জন্য যে প্রযুক্তি তৈরী করা হয়েছে, সেটিকে ভারতে নজরদারি প্রযুক্তিতে ব্যবহার করার কাজ দ্রুততার সাথে চলছে।
ভারত সরকার আয়ুর্গ সেতু নামে নিজস্ব শনাক্তকরণ অ্যাপ চালু করেছে। ৬ এপ্রিল এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অ্যাপটি প্রচার করার জন্য স্থানীয় সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। এতে বলা হয়, লোকজনের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাফেরার বিষয়টি জানার জন্য এটি ‘ই-পাস’ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
গত ৮ এপ্রিল মোদি আবারো তার বক্তব্য পুনরাবৃত্তি করে বলেন, কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে এটি আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। প্রযুক্তি ব্যবহার করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে পারি। যত বেশি লোক এটি ব্যবহার করবে, এর কার্যকারিতা তত বাড়বে।
এই অ্যাপটি ব্যবহারকারীর স্মার্টফোনের মাধ্যমে তার চলাচল শনাক্ত করতে পারবে এবং অ্যাপটি ডাউনলোডকারী অন্য ব্যবহারকারীদের নৈকট্য সম্পর্কে তথ্য দেবে। অ্যাপটিতে স্মার্টফোনের জিপিএস অ্যাকসেসের পারমিশন ব্যবহার কর এবং ফোন ব্যবহারকারী ও এর কাছাকাছি থাকা অন্য ব্যবহারকারীদের সম্পর্কে তথ্য দিতে ব্লুটুথ প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
প্যারিসভিত্তিক সাইবার সিকিউরিটি কনসালটেন্সি ডিফেন্সিভ ল্যাভ এজেন্সি এই অ্যাপটির বিশ্লেষণ করেছে। তাদের মতে, এ দিয়ে শনাক্তকরণ ছাড়াও একে মাইক্রোফোনের মতো বিল্ট-ইন সেন্সরে পরিণত করা যাবে। স্মার্টফোনের ডাটা ও কন্টাক্টগুলোতেও যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে এর মাধ্যমে।
অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ স্টোর থেকে অ্যাপটি এক কোটিরও বেশি ব্যবহারকারী ডাউনলোড করেছেন।
এছাড়া সরকার সিটিজেন অ্যাপ প্রযুক্তি প্লাটফর্ম প্রস্তুত নিয়ে প্রধান প্রধান শিল্প নেতার সাথে বৈঠক করেছে। এই প্লাটফর্মটি ‘ই-পাস’ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ফলে ইনফরমাল খাতের শ্রমিকদের অবস্থান জানা সম্ভব হবে। ভারতের কিছু অংশে এর কাছাকাছি ধরনের মডেল ব্যবহৃত হয়।
ভারতের কোভিড-১৯ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থাটি বিদ্যমান সমন্বিত ডিজিজ সার্বেলেন্স প্রগ্রামের (আইডিএসপি) আওতায় আনা হয়েছে। আবার আইডিএসপি রয়েছে ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের নিয়ন্ত্রণে। আইডিএসপির হেলথ ইনফরমেশন প্লাটফর্মটি স্বাস্থ্য পরিচর্যা কর্মীদের জন্য্য নিজস্ব অ্যাড্রোয়েড অ্যাপে চালু করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য পরিচর্যা কর্মীর ব্যক্তিগত ভিজিটের সময় ভৌগোলিক অবস্থা জানার জন্য আইডিএসপি অ্যাপটি ব্যবহৃত হয়। সন্দেহজনক কোভিড-১৯ রোগীকে দেখতে গেলে স্বাস্থ্য পরিচর্যা কর্মীরা অ্যাপটি ব্যবহার করেন। এই অ্যাপের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকমীরা ব্যক্তির বয়স, জেন্ডার, জন্ম তারিখ ইত্যাদি সংগ্রহ করেন।
কেরালা রাজ্যের কোচি বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ থেকে ফেরা ব্যক্তিদেরকে আইবিএম-মালিকানাধীন অ্যাপ এমএএএস৩৬০ ডাউনলোড করার আহ্বান জানানো হচ্ছে। ১৪ দিনের জন্য সেল্ফ কোয়ান্টিনে থাকার সময় ব্যক্তির অবস্থান যাতে শনাক্ত করা যায়, সেজন্য এই ব্যবস্থা। তারা যেখানে কোয়ান্টিনে থাকছেন, সেখানে পুলিশ ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ব্যক্তিগতভাবে সফর করার সুযোগ পেতে পারেন এর মাধ্যমে।
কর্নাটক রাজ্য ‘কোয়ারিন্টিন ওয়াচ’ নামের একটি অ্যাপ ব্যবহার করছে। এতে ব্যক্তিকে সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা পরপর সেলফি তুলতে হয়। ফলে কোয়ারিন্টিনে থাকা ব্যক্তির রিয়াল-টাইম স্টাটাস জানা যায়।
অন্যান্য রাজ্যও বিভিন্ন ধরনের অ্যাপ ব্যবহার করছে। যারা সেলফ কোয়ারিন্টিনের শর্ত ভঙ্গ করেন, তাদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকতে হয়।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের নজরদারি মহামারিটি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় হলেও এটি সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে।
কোভিড-১৯-এর আগে ভারত বিদ্যমান বায়োমেট্রিক আইডেন্টিফাই কর্মসূচির (আধার) মাধ্যমে প্রতিটি ব্যক্তিকে শনাক্ত করার কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল। এর মাধ্যমে সব নাগরিকের তথ্য এক স্থানে সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
সরকার বলে আসছে যে দেশের সবচেয়ে গরিব নাগরিকদের কাছে যাতে সরকারের কল্যাণ কর্মসূচিগুলোর সুবিধা পৌঁছে দেয়া যায়, সেজন্য এই উদ্যোগ। কিন্তু এটি কেবল নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ নয়, আরো কিছু কারণে ব্যবহৃত হতে পারে।
হাফিংটন পোস্টের তদন্তে দেখা যায়, এর ফলে ব্যক্তির গোপনীয়তা বলতে কিছু থাকে না। কারণ এতে চাকরি বদল, বৈবাহিক অবস্থা, আর্থিক লেনদেন, অবস্থান বদলের মতো তথ্যও দিতে হয়।
ওই অনুসন্ধানে বলা হয়, এর মাধ্যমে ভারতের ১২০ কোটি মানুষের প্রত্যেকের জীবনের প্রতিটি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ভারত সরকার দ্রুততার সাথে দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচির ছদ্মাবরণে নজরদারি অবকাঠামো নির্মাণ করছে।
নাগরিকদের শনাক্ত করার ব্যাপারে ভারতের ক্রমবর্ধমান সক্ষমতাটি চীনের নিজস্ব সামাজিক ক্রেডিট সিস্টেমের মতো হতে পারে। চীনে ওই পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের নাগরিকদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও আচরণের মান নির্ধারণ করা হয়।
ভারত অনেক বছর ধরে নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তুলছে বলে হাফিংটন পোস্টের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়। কোভিড-১৯ সঙ্কট সরকারকে তার নাগরিকদের পরীক্ষামূলকভাবে শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে যেতে পেরেছে এবং রাষ্ট্রীয় নজরদারি ব্যবস্থা নাগরিকদের অভ্যস্ত হওয়ার মতো করে গড়ে তুলছে।
ভারতের বিশাল হতে থাকা ডিজিটাল রাষ্ট্রীয় নজরদারিব্যবস্থাকে পরীক্ষা করার একটি সুযোগ দিয়েছে কোভিড-১৯।
দি ডিপ্লোম্যাট