সিঙ্গাপুরে ভাইরাস ছড়াল যেভাবে
সিঙ্গাপুরে ভাইরাস ছড়াল যেভাবে - সংগৃহীত
করোনাভাইরাস ঠেকাতে সিঙ্গাপুর বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর একটি হলো, বিদেশ থেকে ভাইরাস শরীরে বয়ে এনে ছড়ানো ঠেকাতে, বিদেশ ফেরত সমস্ত লোকজনকে এখন পরিবারে না রেখে সরকারি কোয়ারেন্টিন কেন্দ্রে রাখা হচ্ছে। এখন অবশ্য খুব কম মানুষই সিঙ্গাপুরে ঢুকছে, ফলে সরাসরি তাদের মাধ্যমে সংক্রমণের সংখ্যাও এখন দ্রুত পড়ে গেছে।
মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরে নতুন একটি আইন জারি করা হয়েছে যার অর্থ, মুখে না বললেও, দেশব্যাপী আংশিক লকডাউন। জরুরি কাজ ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে গেলে ১০,০০০ সিঙ্গাপুর ডলার পর্যন্ত জরিমানা বা ছয় মাসের জেল হতে পারে।
অধ্যাপক টিও এই ব্যবস্থাকে সমর্থন করেন, এবং বলেন তারপরও সামনের দিনগুলোতে হয়ত সংক্রমণের সংখ্যা বেশি হতে পারে, কিন্তু এটা কাজে দেবে।
কিন্তু গত সপ্তাহে যে হারে সংক্রমণ সিঙ্গাপুরে বেড়েছে তার সিংহভাগ শিকার হয়েছে সেখান অভিবাসী শ্রমিকরা। লাখ লাখ এসব শ্রমিক সেখানকার নির্মাণ শিল্প, শিপিং এবং রক্ষনাবেক্ষণে কাজ করে। অর্থনীতি সচল রাখতে সিঙ্গাপুরকে এদের ওপর নির্ভর করতেই হবে।
কিন্তু যেসব জায়গায় এই অভিবাসী শ্রমিকরা কাজ করে বা থাকে, তাদের পক্ষে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব।আইন অনুয়ায়ী এই শ্রমিকদের সুনির্দিষ্ট কিছু হস্টেল বা ডরমিটরিতে থাকতে হয়।
বেসরকারিভাবে পরিচালিত এসব অনেক ডরমিটরিতে এক ঘরে ১২ জন পর্যন্ত শ্রমিক থাকে। এরা বাথরুম, রান্নাঘর এবং আরো অনেক কিছু শেয়ার করে।
ফলে, এসব শ্রমিক ডরমিটরি যে করেনাভাইরাসের ক্লাস্টারে পরিণত হবে, তা বলাই বাহুল্য, এবং হয়েছেও তাই।প্রায় পাঁচশ কোভিড-১৯ কেস পাওয়া গেছে এরকম কয়েকটি শ্রমিক ডরমিটরিতে।
সিঙ্গাপুরে এখন পর্যন্ত যত রোগী শনাক্ত হয়েছে তার ১৫ শতাংশই এসেছে এরকম একটি মাত্র ডরমিটরি থেকে।অনেক শ্রমিক উপসর্গ নিয়েও কাজ করতে গেছে।আর এ কারণে আশঙ্কা করা হচ্ছে আগামি সপ্তাহে বা তারপর সিঙ্গাপুরে সংক্রমণের সংখ্যা অনেক বাড়বে, অনেক নতুন রোগী তৈরি হবে।
অন্যান্য দেশের জন্য শিক্ষা
প্রফেসর টিও বলেন, “সিঙ্গাপুরে শ্রমিক ডরমিটরিতে যা হয়েছে, সেটা অন্যান্য অনেক দেশেও ঘটতে পারে।, বিশেষ করে স্বল্পোন্নত বা মধ্যমাপের অর্থনীতির দেশগুলোতে।
“দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে এমন সব জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা ডরমিটরির জীবনের মতো গাদাগাদি করে বসবাস করে।“
তিনি বলেন, গাদাগাদি করে বসবাস করার কারণে নিয়ন্ত্রণহীন সংক্রমণ ঠেকাতে কী করা যেতে পারে সে ব্যাপারে সরকারগুলোকে দ্রুত স্বচ্ছতার সাথে ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রফেসর টিও‘র সহকর্মী প্রফেসর লি ওয়াং সু বলেন, সিঙ্গাপুরের ঘটনা সামজিক এবং শ্রেনী বৈষম্যের বাস্তবতাকে নগ্ন করে দিয়েছে যেটা সরকারগুলোর জন্য আরেকটি শিক্ষা হতে পারে।
“এই ভাইরাস আমাদের সমাজের দুর্বল দিকগুলো খুব পরিষ্কার করে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে - অভিবাসী শ্রমিকদের পরিস্থিতি তারই একটি জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ।“
প্রফেসর সু বলেন, সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করেই এইসব ডরমিটরি তৈরি করেছে, কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি প্রমাণ করেছে সেসব মান যথেষ্ট নয়।
সিঙ্গাপুরের শ্রমশক্তি বিষয়ক মন্ত্রী জোসেফিন টিও এসব শ্রমিক ডরমিটরির মান বাড়ানোর অঙ্গিকার করেছেন। তিনি বলেন, “এটি করা সঠিক।“
সিঙ্গাপুর কি প্রমাণ করছে যে এই ভাইরাস আটকানো সম্ভব নয়?
যদিও এখন সমালোচনা হচ্ছে যে সিঙ্গাপুর এমনকী আংশিক লকডাউন জারি করতেও সময় নিয়েছে, কিন্তু প্রফেসর ফিশার বলছেন, অন্য দেশগুলোর তুলনায় সিঙ্গাপুর অনেক আগেই ব্যবস্থা নিয়েছে। যখন প্রতিদিন নতুন সংক্রমণের সংখ্যা একশরও নীচে, তখনই তারা আংশিক লকডাউনের পথে গেছে।
কিন্তু ঐ বিশেষজ্ঞ বলেন, লকডাউন কার্যকরি করতে হলে তিনটি বিষয় ঘটতে হবে - প্রথমত, সংক্রমণ বন্ধ করতে সব মানুষকে ঘরে থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত: স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সচল রাখতে তাদেরকে সময় দিতে হবে, নতুন রোগীদের জন্য বেড প্রস্তুত করতে এবং ডাক্তার-নার্সদের বিশ্রাম নেওয়ার সময় দিতে হবে।
এবং তৃতীয়ত সমস্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখতে হবে - আইসোলেশনের স্থান, আইন, সংক্রমিত লোকদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়া।
“আপনি যদি একটি বা দুটি কাজ নিশ্চিত করেন আর অন্যটি অবজ্ঞা করেন, দুর্যোগ নতুন করে ফরে আসবে।“
তবে ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় সিঙ্গাপুরের পরিস্থিতি অনেক ভালো। তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রোগীর চাপে ভেঙ্গে পড়ছে না। সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপ নেই, মিডিয়ারও চাপ নেই।
কিন্তু প্রফেসর ডেল বলেন, যদিও সেখানে সরকারের ওপর মানুষের আস্থা রয়েছে এবং সরকার যথেষ্ট তথ্য মানুষকে দিচ্ছে, তারপরও “সাধারণ জনগণের সবাই তাদের নিজস্ব ভূমিকা এবং দায়িত্ববোধ নিয়ে সমানভাবে সচেতন নয়।“
“তারা হয়ত ভাবছে - হ্যাঁ সিঙ্গাপুরের এটা করা উচিৎ, কিন্তু আমি আমার মাকে দেখতে যাবো।“
একারণে লকডাউন জারির পর প্রথম দুই দিনেই সিঙ্গাপুরে নির্দেশ লঙ্ঘনের জন্য ১০ হাজার মানুষকে হুঁশিয়ার করা হয়েছে।
সিঙ্গাপুরের মত এত ছোট, স্থিতিশীল এবং উন্নত দেশের পরিস্থিতিও যেখানে এমন, সেখানে বড় এবং অনেক জটিল দেশগুলোর পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া অনেক কঠিণ হবে। ফল পেতে তাদের কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস লেগে যেতে পারে।
অনেক দেশই আশাবাদী হওয়ার লক্ষণ দেখছে. কিন্তু সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা পরিষ্কার বলে দিচ্ছে - আত্মপ্রসাদের বিন্দুমাত্র জায়গা এখনও নেই। বরঞ্চ করোনাভাইরাসের দ্বিতীয়, তৃতীয়, এমনকী চতুর্থ দফার সংক্রমনের জন্য প্রতিটি দেশের প্রস্তুত থাকা উচিৎ।
সূত্র : বিবিসি