ল্যাংড়া মশা এবং যুগে যুগে আল্লাহর মোজেজা
ল্যাংড়া মশা - সংগৃহীত
এটা এক ‘লেংড়া মশার’ কারসাজি। এ মশা প্রতিটি যুগে কোনো এক শক্তিধর শাসকের নাকের ভেতর ঢুকে যায়। নাকের পথ ধরে পৌঁছে যায় শাসকের মস্তিষ্কে। শাসক বিভ্রান্তিমূলক ফায়সালা করতে থাকে। এর ফলস্বরূপ শুধু ওই শাসকই নয়, তার পুরো জাতিকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আজ বিশ্বের সবচেয়ে আলো ঝলমলে শহর বিরান হয়ে যাচ্ছে। ‘করোনাভাইরাস’ নামের আন্তর্জাতিক মহামারীর ভয়ে সব কিছু বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কখনো ভাবিইনি যে, আমাদের জীবনে এমন একসময় আসবে, যখন ওলামায়ে কেরাম বলবেন, মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করার প্রয়োজন নেই; নামাজ ঘরে আদায় করুন। কখনো ভাবিনি গির্জা-মন্দিরসহ সব উপাসনালয়ের দরোজা বন্ধ হয়ে যাবে। লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুর ভয়ে নিজেই নিজেকে ঘরে বন্দী করে রাখবে। ভীতিকর এ পরিবেশের মধ্যে চিন্তাভাবনা করতে গিয়ে মস্তিষ্কের কিছু দরোজা খুলে যাচ্ছে। এমনটি নয় যে, করোনাভাইরাস হঠাৎ পুরো বিশ্বকে তার মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে। বিজ্ঞানীরা ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা কয়েক বছর ধরে সতর্ক করে আসছেন, এক আন্তর্জাতিক মহামারী বিশ্বকে ঘিরে ফেলবে।
ওই বিজ্ঞানীরা এ মহামারীকে দমন করার জন্য যে ফান্ড চেয়েছিলেন, তা শক্তিধর শাসকদের জন্য মাত্র কয়েকটি শস্যদানার সমান ছিল। কিন্তু তাদের মস্তিষ্কে ‘লেংড়া মশা’ ঢুকে গেছে। এ কারণে এ শাসকরা আন্তর্জাতিক মহামারীর পরিস্থিতি সামলানোর পরিবর্তে সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ দমনের নামে শুরু করা যুদ্ধে হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করে যাচ্ছেন। মিডিয়া বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, সন্ত্রাসবাদের চেয়ে বড় ভয়ঙ্কর বিশ্বব্যাপী কোনো মহামারী দেখা দিতে পারে। কিন্তু শক্তিধর শাসকরা টিভি চ্যানেল ও পত্রপত্রিকাকে ‘ফেক নিউজ’ বলে তাচ্ছিল্য করে সোশ্যাল মিডিয়ার ঘোড়ায় সওয়ার হয়েছিলেন এবং মহাউন্মাদনায় আক্রান্ত হয়ে বিভ্রান্তিমূলক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আজ ওই বিভ্রান্তিমূলক সিদ্ধান্তের খেসারত পুরো বিশ্বকে ভুগতে হচ্ছে। ২৫ মার্চ সকালে এক মার্কিন ম্যাগাজিন Clinical Microbiology Reviews-এর অক্টোবর-২০০৭ সংখ্যায় প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ পড়লাম। (আগ্রহীরা প্রবন্ধটি পড়তে এই লিংকে প্রবেশ করুন- https://cmr.asm.org/content/20/4/660?fbclid=IwAR25vv13xXrCO8tM4bHEW4uU2gr71bIgi61iica3gjDfTgxQgR3MHFUyqhs-অনুবাদক) ওই প্রবন্ধে পাঁচজন বিজ্ঞানী ১৩ বছর আগে বিশ্বকে করোনাভাইরাস সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। এ ম্যাগাজিন আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজির তত্ত¡াবধানে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। কয়েক বছর পর এক মার্কিন থিংকট্যাংক র্যান্ড করপোরেশন ২০১২ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সন্ত্রাসবাদ নয়, ভবিষ্যতে আমেরিকার জন্য বড় হুমকি হবে এক আন্তর্জাতিক মহামারী, যা পরিপূর্ণরূপে আমেরিকার জীবনধারা বদলে দেবে। ওবামার শাসনামলে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার লিজা মোনাকো এ ব্যাপারে মনোযোগ দেয়া শুরু করেন। কিন্তু ২০১৬ সালে ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেন।
মার্কিন বিজ্ঞানীরা ট্রাম্পের কাছে আবেদন জানান, আপনি সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছেন। আমাদেরকে একটা আন্তর্জাতিক মহামারী দমন প্রক্রিয়া অনুসন্ধানের জন্য বার্ষিক মাত্র এক বিলিয়ন ডলার দেয়া হচ্ছে। আমাদের আর মাত্র এক বিলিয়ন অতিরিক্ত ডলার বরাদ্দ করুন, যাতে আমরা শুধু আমেরিকা নয়, বরং পুরো বিশ্বকে এক নতুন মহামারী থেকে নিরাপদ রাখতে পারি, যে মহামারী চীন থেকে জন্ম নিতে পারে। ট্রাম্প এ আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। তার ধারণা ছিল, এ মহামারী চীনে জন্ম নিলে তা শুধু চীনকেই বিপর্যস্ত করবে। কিন্তু যখন মহামারী ছড়িয়ে পড়ল তখন আমেরিকাও বন্ধ হতে চলেছে। এখন ট্রাম্প আরো বেশি অর্থ বরাদ্দ করেছেন, কিন্তু এতে অনেক দেরি হয়ে গেল।
বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ওষুধ খুঁজে পাননি। সুতরাং কেউ এটাকে ‘আল্লাহর আজাব’ বলছেন, কেউ বলছেন ‘পরীক্ষা’। এমন মহামারী এই প্রথমবার আসেনি। কুরআন শরিফে এমন মহামারীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যার কারণে আত্মম্ভরী ও ভ্রষ্টজাতিগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। কুরআন শরিফে সূরা আরাফে প্লাবন, পঙ্গপাল ছাড়াও ব্যাঙের আধিক্য ও রক্তবৃষ্টিকেও আজাব হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ১৯৮১ সালে দক্ষিণ গ্রিসে আকাশ থেকে ব্যাঙের বৃষ্টি হলে বিজ্ঞানীরা অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। শ্রীলঙ্কায় ব্যাঙের সাথে আকাশ থেকে মাছও বর্ষণ করা হয়। ২০০১ সালে ভারতের কেরালা রাজ্যে রক্তবৃষ্টি হয়েছে। ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে আকাশ থেকে মাকড়শার বৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানীরা গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে এ কথা বলে সান্ত্বনা দেন যে, সম্ভবত ঘূর্ণিঝড় স্থল ও সমুদ্রের প্রাণী আকাশে নিয়ে গেছে এবং সেই প্রাণী বৃষ্টির মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে ফিরে এসেছে। কিন্তু এ ঘটনাবলির ইঙ্গিত অনেক আগেই কুরআন শরিফে দেয়া হয়েছে। কুরআন শরিফ স্বয়ং এক বিশাল মুজেজা।
এ কুরআন শরিফের মধ্যে এমন কয়েকটি মুজেজার উল্লেখ রয়েছে, যার সামনে বিজ্ঞান অসহায়। তবে বিজ্ঞান বারবার কুরআন শরিফের সত্যতা প্রমাণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। সূরা ইউনুসে ফেরাউনকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে, আমি তোর দেহকে রক্ষা করছি, যাতে তুই পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হতে পারিস। কুরআন শরিফ যখন নাজিল হচ্ছিল, তখন কারো জানা ছিল না, ফেরাউনের মরদেহ সংরক্ষিত আছে। প্রায় তিন হাজার বছর পর্যন্ত ফেরাউনের মরদেহ একটি কবরে পড়ে রয়েছিল। ১৮৯৮ সালে ফেরাউনের মমি করা মরদেহের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৯০৭ সালে এলিয়ট স্মিথ তার বৈজ্ঞানিক ময়নাতদন্ত করে বলেন, এটা সেই ফেরাউন, যে হজরত মূসা আ:-এর পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে লোহিত সাগরে ডুবে মরেছিল। ফেরাউনের মমি করা মরদেহ ১৮৬০ সালে মিসর থেকে চুরি হয়ে কানাডার একটি জাদুঘরে স্থান পায়। এরপর সেটা কানাডা থেকে আমেরিকার জাদুঘরে পৌঁছে। এরপর ২০০৩ সালে সেখান থেকে মিসরে ফিরে আসে। ২০০৯ সালে এ অধমেরও মিসরে ফেরাউনের মমি করা মরদেহ দেখার সুযোগ হয়েছে। মিসরের একটি জাদুঘরে পড়ে থাকা, এ মমি কুরআন শরিফের ভবিষ্যদ্বাণী ও তার সত্যতার প্রমাণ। কুরআন শরিফের তথ্যমতে, হজরত ঈসা আ:-কে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। হজরত ইউনুস আ: ৪০ দিন মাছের পেটে জীবিত ছিলেন। ‘আসহাবে কাহাফ’ তাদের কুকুরসহ একটি গুহায় ৩০৯ বছর পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকার পর আবার জাগ্রত হয়েছিলেন। নমরুদ হজরত ইবরাহিম আ:-কে আগুনে নিক্ষেপ করে, কিন্তু আগুন তার কিছুই করতে পারেনি। কুরআন শরিফে বর্ণিত এ কাহিনীগুলোকে অমুসলিম কিছু বিজ্ঞানী স্বীকার করেন না। তবে তারা এ কথার উত্তর দিতে পারেন না যে, এ সব ঘটনা এমন এক রাসূল সা: কিভাবে জানলেন, যিনি লেখাপড়া জানতেন না, উম্মি বা নিরক্ষর ছিলেন?
এ অধমের আবেদন, কুরআন শরিফ আল্লাহর নাফরমান জাতির ধ্বংসের কাহিনীতে ভরপুর। ফেরাউন-নমরুদের মতো শাসকরা তাদের ঔদ্ধত্য ও বিভ্রান্তিমূলক ফায়সালার কারণে পুরো জাতির ধ্বংস ডেকে নিয়ে এসেছে। নমরুদ হজরত ইবরাহিম আ:-কে আগুনে নিক্ষেপ করেছিল, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁর বন্ধু বা খলিলকে উদ্ধার করেছেন। ইবরাহিম আ: আল্লাহর আদেশে মাতৃভ‚মি ত্যাগ করে হিজরত করেন। নমরুদের নাকের ভেতর একটি লেংড়া মশা ঢুকে পড়ে। ওই মশা মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। এ মশা যখনই তাকে জ্বালাতন করত, তখনই নমরুদ নির্দেশ দিত, আমার মাথায় জুতা মারো। সে সিংহাসনে বসে নিজের মাথায় জুতা পেটাত। জুতার আঘাত বন্ধ হতেই মশা আবার হুল ফোটাত। আর নিজে নিজেকে খোদা দাবিদার শাসক তার দরবারিদের বলত, আমাকে আবার জুতা মারো। অবশেষে এ নমরুদ জুতার বাড়ি খেতে খেতে জাহান্নামে পৌঁছে গেছে। তবে লেংড়া মশা কিন্তু এখনো জীবিত আছে। এটা সময়ের কোনো না কোনো নমরুদের নাকের পথ ধরে তাদের মস্তিষ্কে ঢুকে পড়ে এবং তাদের অহমিকাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। আমি কোনো আলেমও নই, বিজ্ঞানীও নই; এক সাধারণ সাংবাদিক। আমাকে বলতে দিন, করোনাভাইরাস আধুনিক যুগের নমরুদদের ভ্রষ্টনীতি ও বিভ্রান্তিমূলক সিদ্ধান্তের কুফল। পুরো বিশ্ব এর খেসারত ভুগছে। বর্তমানে লেংড়া মশা একাধিক শাসকদের মস্তিষ্কে ঢুকে বসে আছে। খুব দ্রুত আপনারা এ সব আত্মম্ভরী শাসকদের জুতার বাড়ি খেতে দেখবেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন। আমিন।
পাকিস্তানের দৈনিক জং ২৬ মার্চ,
২০২০ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক