করোনা বিপর্যয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি

আওয়ামী লীগের রাজনীতি - সংগৃহীত
আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের পরপর শুরু হওয়া মেয়াদোত্তীর্ণ শাখাগুলোর সম্মেলনের উদ্যোগ করোনা পরিস্থিতির কারণে তা থমকে গেছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাপী এ মহামারীতে থেমে গেছে দলটির সব রাজনৈতিক কার্যক্রম। দিবসকেন্দ্রিক কর্মসূচিও এখন আর পালিত হচ্ছে না। কেবলমাত্র ত্রাণ কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে ক্ষমতাসীন দলটির রাজনীতি। করোনা সচেতনতায় পাড়া-মহল্লায় প্রচার-প্রচারণা এবং জনসমাগম ঠেকাতে পাহারায় থাকতেও দেখা যাচ্ছে নেতাকর্মীদের। নিজ নিজ এলাকায় পরিচ্ছন্নতাসামগ্রী বিতরণও করছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত জনপ্রতিনিধিরা। তবে দরিদ্র ও অসহায়দের জন্য সরকারের বরাদ্দ করা ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে অনিয়ম আর অভিযোগের শেষ নেই অনেক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে। বিশেষ করে ১০ টাকা কেজি দরের চাল নিয়ে ব্যাপক চালাবাজি দেশজুড়ে। এসব ত্রাণ নিয়ে রয়েছে নয় ছয় আর দলবাজিরও অভিযোগ। এমন প্রেক্ষাপটে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। সরকারের ত্রাণ নিয়ে কোনো ধরনের অনিয়ম বরদাশত না করার হুঁশিয়ারি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বলেছেন, প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে তাৎক্ষণিক বিচার করা হবে এসব অসাধু জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্টদের।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীতে দলের সব রাজনৈতিক কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রয়েছে। দেশের জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করে মুজিববর্ষের নানা অনুষ্ঠানও বাতিল করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দিবসভিত্তিক নানা কর্মসূচিও প্রায় বন্ধ রয়েছে। আপাতত দেশের আপামর মানুষের স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়েই ব্যস্ত রয়েছে সরকার। সেজন্য স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি, পরিচ্ছন্নতা সামগ্রী বিতরণ এবং জনগণের খাদ্য নিরাপত্তায় অসহায় ও দরিদ্রদের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম নিয়েই ব্যস্ত আওয়ামী লীগ। সারা দেশে ব্যক্তিগত, দল ও সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ করা ত্রাণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে ব্যস্ত রয়েছেন তৃর্ণমূল নেতাকর্মীরা। মাঠ প্রশাসনের কাজে সার্বক্ষণিক সহযোগিতাও করে যাচ্ছেন দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া কোনো কর্মসূচি নিয়ে আপাতত কোনো চিন্তা নেই আওয়ামী লীগের। করোনা দুর্যোগের পর আবারো রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করবে আওয়ামী লীগ।
এ দিকে করোনা দুর্যোগে বিপাকে পড়া দরিদ্র, অসহায়দের জন্য বরাদ্দ করা ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রকৃত দুস্থদের না দিয়ে এসব ত্রান চলে যাচ্ছে অনেক নেতা ও জনপ্রতিনিধির নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে। বিশেষ করে গরিবের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া চালের বস্তা শোভা পাচ্ছে অনেক জনপ্রতিনিধির খাটের নিচে মাটির গর্তে। কোথাও কোথাও বাগান থেকে উদ্ধার হচ্ছে চালের বস্তা। গরিবের এসব চালের বস্তা পাওয়া যাচ্ছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর গুদামে। গত ১০ দিনে সারা দেশে প্রায় তিন হাজার বস্তা ত্রাণের চাল চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। চাল চুরির দায়ে ইতোমধ্যে ডিলার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় অনেক নেতার জেল জরিমানারও খবর পাওয়া গেছে। আবার অনেকেই রয়েছেন পলাতক। অনেক স্থানে কিছু ত্রাণ ধরিয়ে দিয়ে ক্যামেরা, ভিডিও এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন অনেক জনপ্রতিনিধি। ত্রাণ নিয়ে ছবি তুলতে না চাইলে নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে অভাবী মানুষের ওপর। এমন অভিযোগে গতকাল রোববার কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের এক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মুখ দেখে দেখে ত্রাণ বিতরণ করায় ক্ষুব্ধ দুস্থদের ত্রাণ লুটের ঘটনাও ঘটেছে।
গত ৯ দিনে প্রায় আড়াই হাজার বস্তা ত্রাণের চাল চুরির অভিযোগ তুলে ধরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীকে বাদ দিয়ে সেনাবাহিনী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। ২০ দলীয় জোটের শরিক লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সভাপতি কর্নেল (অব:) ড. অলি আহমদ বলেছেন, জাতির এই ক্রান্তিকালে যারা গরিবের হক মেরে খায় তারা দেশ ও মানবতার শত্রু। তাদের প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া উচিত। করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যে সরকারের ত্রাণ সহায়তায় অনিয়মের অভিযোগ এনেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এক বিবৃতিতে অভিযোগ করে বলেন, প্রভাবশালীরা পছন্দের লোকদের ত্রাণের জন্য তালিকাভুক্ত করছে। এ সমস্যা নিরসনের জন্য ওয়ার্ডভিত্তিক নয়, সদস্যদের একটি ত্রাণ বিতরণের কমিটি করে দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে দলটি।
ত্রাণের চাল চুরির ঘটনা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলছে। বিভিন্ন মিডিয়া এবং ফেসবুকসহ সামাজিক গণমাধ্যমে এসব খবর আসছে প্রতিনিয়ত। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালও ( টিআইবি) ত্রাণ বিতরণে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এমন প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল রোববার বরিশাল ও খুলনা বিভাগের জেলাগুলোর প্রশাসনের সাথে ভিডিও কনফারেন্স করে ত্রাণ বিতরণে স্বচ্ছতার ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ দেন। এ সময় ত্রাণ নিয়ে অনিয়ম বা লুটপাটকারীদের প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে তাৎক্ষণিক সাজা দেয়ার হুঁশিয়ারি দেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ত্রাণ বিতরণে কোনো ধরনের অনিয়ম সহ্য করা হবে না। খেটে খাওয়া মানুষের ত্রাণ নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলবে তারা যেই হোক তাদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে।
দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, করোনাভাইরাসের চলমান এই দুর্যোগে অসহায় মানুষের ত্রাণ যারা আত্মসাৎ করে তাদের মানুষ বলা যায় না; এরা মানুষরূপী জানোয়ার। তিনি এদের প্রতি ঘৃণা জানিয়ে ত্রাণ আত্মসাৎকারী জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কঠোর ব্যবস্থা নিতে সব জেলা প্রশাসকের প্রতি আহ্বান জানান।
আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী বলেন, ত্রাণ বিতরণে কোনো অনিয়ম সহ্য করবে না দল। এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে হাইকমান্ড। ত্রাণ বিতরণে যেন কোনো ধরনের দলবাজিও না হয় সে ব্যাপারে দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন।