এখন জুতা থেকেও ছড়াচ্ছে করোনাভাইরাস!
এখন জুতা থেকেও ছড়াচ্ছে করোনাভাইরাস! - সংগৃহীত
ভাইরাসটি এখনো তুলনামূলকভাবে নতুন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যত ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটেছে, তার মধ্যে এটিই বিশ্ববাসীর কাছে সবচেয়ে পরিচিত। সম্ভবত, পাগল আর শিশু ছাড়া পৃথিবীর সবাই ভাইরাসটির নাম জানে। কিন্তু তবুও তার স্বভাবচরিত্র বুঝে উঠতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা হিমশিম খাচ্ছেন। ক্ষণে ক্ষণে বদলাতে হচ্ছে ধারণা। প্রাথমিক গবেষণায় মনে হচ্ছিল, করোনাভাইরাসের কণিকা ভারী বলে বাতাসে ভেসে থাকতে পারে না। সরাসরি মাটিতে পড়ে। কিন্তু চীনের উহানে আক্রান্তদের চিকিৎসা হয়েছে এমন হাসাপাতালের ওয়ার্ডে বাতাসের নমুনা পরীক্ষা করে একটি নতুন গবেষণাপত্র জানিয়েছে, এই ভাইরাস ১৩ ফুট বা ৪ মিটার অবধি ছড়াতে পারে। জনসমক্ষে সংক্রমণ এড়াতে বর্তমানে যতটা দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হয়েছিল, তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ!
চীনা গবেষকদের এই গবেষণা প্রাথমিক ফলাফল ছাপা হয়েছে আমেরিকার ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশেন’–এর জার্নাল ‘এমার্জিং ইনফেকশাস ডিজিজেস’–এ। কীভাবে এই মহামারীর সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, তাই নিয়ে বিতর্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বেইজিংয়ের ‘আকাদেমি অফ মিলিটারি মেডিক্যাল সায়েন্সেস’-এর গবেষকদের এই নতুন গবেষণাপত্র। গবেষকেরা এ-ও জানিয়েছেন, ১৩ ফুট দূরত্বে অল্প পরিমাণ ভাইরাস মিললেও, তাতে সংক্রমণ ঘটবে এমন কোনো কথা নেই।
করোনাভাইরাসের মূল উৎপত্তিস্থল উহানের হুয়োশেনশান হাসপাতালের জেনারেল কোভিড ওয়ার্ড থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন গবেষকেরা। ওয়ার্ডে ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ ২৪ জন আক্রান্তের চিকিৎসা হয়। ওয়ার্ডের মেঝেতেই মূলত ভাইরাসের দেখা মিলেছে। তবে কম্পিউটারের মাউজ, ডাস্টবিন, বেড রেল এবং দরজার নবেও এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গবেষণাপত্রেও এ-ও লেখা হয়েছে, ‘আইসিইউ–তে কর্মরত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের জুতার শুকতলাতেও ভাইরাসের নমুনা পাওয়া গেছে। জুতাই ভাইরাসের অন্যতম বাহক।’
সেক্ষেত্রে হাওয়া থেকে সংক্রমণের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হয়েছে গবেষণাপত্রে। বলা হয়েছে ভাইরাস কণিকা এতই সূক্ষ্ম, যে তা বেশ কয়েক ঘণ্টা হাওয়া ভেসে থাকতে পারে। সাধারণ হাঁচি, কাশির জলীয় কণার ক্ষেত্রে যা হয় না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মাটিতে পড়ে। জানা গেছে, বায়ুবাহিত ভাইরাস রোগীদের কাছকাছি বা ১৩ ফুট নিচে নামতে নামতে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাসের পরিমাণ কম হলে ৮ ফুট অবধি ছড়ায়।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, উহানের যেই হাসপাতালের আক্রান্তদের ওয়ার্ডে কিন্তু কোনও কর্মীই আক্রান্ত হননি। গবেষকদের মতে, ‘সময়মতো যথাযথ সতর্কতার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে।’ মৃদু সংক্রমণের ক্ষেত্রে গৃহ পর্যবেক্ষণে করোনা সারে— এই বিশ্বাস নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে গবেষণায়। লেখা হয়েছে, বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের থেকে আলাদা থাকা এই রোগ নিয়ন্ত্রণের পক্ষে ভাল নয়। কারণ পরিবেশের দূষণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবশ্য এই বাতাসে ভাইরাস কণিকা ছড়িয়ে পড়ার তত্ত্বকে আমল দেয়নি। সুস্থ নাগরিকদেরও বাড়ির বাইরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছে আমেরিকা। কথা বলতে গিয়ে বা নিঃশ্বাস নিতে গেলেও ভাইরাস ছড়াতে পারে, এই আশঙ্কায়।
ঘন ঘন কোভিড পরীক্ষা হচ্ছে এখন আমেরিকায়। যদিও সেদেশের বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এতে নির্ভুল রিপোর্টের নিশ্চয়তা নেই। বহু মানুষের রিপোর্ট নেগেটিভ আসছে। রিপোর্ট নেগেটিভ এলেও, শরীরে সংক্রমণ থাকা সম্ভব। বিজ্ঞানীদের এই আশঙ্কা সত্যি হলে, বিপর্যয় বাড়বে আরও।
অধিকাংশ দেশ পিসিআর পরীক্ষা করছে। এতে লালারস সংগ্রহ করে পরীক্ষা হয়। তবে আমেরিকার মিনেসোটার মেয়ো ক্লিনিকের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. প্রিয়া সম্পতকুমার বলেছেন, ‘সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হাঁচি বা কাশি থেকে ঠিক কতটা ভাইরাস উগরে দিচ্ছেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া কীভাবে নমুনা সংগ্রহ হচ্ছে, সংগ্রহের পর কতক্ষণ পরে পরীক্ষা হচ্ছে, সেটাও প্রশ্ন।’
মাত্র ৪ মাস হলো, এই ভাইরাসের সন্ধান মিলেছে। সুতরাং এর পরীক্ষা–নিরীক্ষা এখনো প্রাথমিক ধাপেই। তাছাড়া দেশে দেশে বিভিন্ন সংস্থা একটু অন্যরকম করে পরীক্ষাও করছে। তাই স্পষ্ট চিত্র পাওয়া সম্ভব নয়। জানিয়েছেন প্রিয়া সম্পতকুমার। মেয়ো ক্লিনিক থেকে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে ডা. তিনি লিখেছেন, ‘মে–র মাঝামাঝি ক্যালিফোর্নিয়ায় ৫০ শতাংশের বেশি মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে পারে, এমন আশঙ্কা রয়েছে। ৪ কোটি বাসিন্দার ১ শতাংশেংরও যদি পরীক্ষা করা হয়, অন্তত ২০ হাজারের রিপোর্ট নেগেটিভ আসতে পারে।’ তাই রোগ নির্ণয় কঠিন হয়ে পড়বে,ডা. সম্পতকুমারের। তারওপর সংক্রামিত দেহে ভাইরাস ঠিক কোথায় থাকবে, সেটাও একটা প্রশ্ন। নমুনা সংগ্রহ করতে হবে নাকের পেছন থেকে গলার উঁচু অংশের যোগ যেখানে সেখান থেকে। অপটু হাতে তা সম্ভব নয়। তাছাড়া ঠিক করে ওই পরীক্ষা হলেও, রিপোর্ট নেগেটিভ আসতে পারে। কারণ রোগের প্রকোপ যত বাড়ে, ফুসফুসের ওপরের অংশ থেকে তা নীচে নামে। সেক্ষেত্রে রোগীকে কাশতে বলা যেতে পারে, এবং সেই নমুনা পরীক্ষা করা যেতে পারে।
ঠিক ঠিক রিপোর্ট করতে ব্রঙ্কোঅ্যালভিওলার ল্যাভেজ পরীক্ষার কথা বলছেন বাল্টিমোরের জন হপকিন্স হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ড্যানিয়েল ব্রেনার। তিনবার নাকের কফের নমুনা পরীক্ষা করে নেগেটিভ আসার পর এক রোগীর ব্রঙ্কোঅ্যালভিওলার পরীক্ষা করা হয়। এবং তাতে জানা যায়, যে তিনি কোভিড পজিটিভ। ওই রোগীর শ্বাসনালির নীচে একটি ক্যামেরা রেখে ফুসফুসের গতিবিধি দেখেন দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকেরা। শ্বাসনালিতে আটকে থাকা কফ পরীক্ষা করে জানা যায় রোগী কোভিড পজিটিভ।
সূত্র : আজকাল