ভাইরাসের রাজনৈতিক পরিবচয়
ভাইরাসের রাজনৈতিক পরিবচয় - সংগৃহীত
অনেকে মনে করেন, এই সময়ে এ ধরনের ঘটনা যেকোনো আশা-ভরসা ধ্বংস করে দিতে পারে। এখন আমরা ভালো কিছু করতে পারি। তবে আমার মতো আফ্রিকান লোকেরাÑ যারা এ ধরনের রোগকে জাতীয়তার ভিত্তিতে বা গোষ্ঠীগতভাবে সম্পৃক্ত করার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি তাদের জন্য এটা কোনো দুঃখের বিষয় নয়। অধিকন্তু, ভাইরাস নিজেই কেবল একটি নোভেল বা নতুন ও অভিনব জিনিস। এখন এটা শুধু আফ্রিকা নয়, এশিয়া এবং গোটা বিশ্বে এর বিষাক্ত ছোবল ছড়িয়ে পড়েছে।
আফ্রিকার লোকেরা এটা সহ্য করতে পারে যে, তাদের মহাদেশকে ভাইরাল রোগের দেশ হিসেবে অভিহিত বা ডাকা হয়ে থাকে। এমনকি কয়েক দশক ধরে আমাদের নিজেদের শরীরকেও এভাবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এসব মারাত্মক রোগের মধ্যে ইবোলা হচ্ছে অত্যন্ত অপরিচিত একটি রোগ। সামষ্টিকভাবে এই রোগকে ‘আফ্রিকান রোগ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ইবোলার প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে। আমেরিকার বেশির ভাগ মানুষ মনে করেছিল, ওটা দূরের একটি উদ্বেগজনক বিষয়। অথচ ওই মহামারীর প্রাদুর্ভাবের ফলে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে এবং বেশ কিছুদিন ধরে ওই সংবাদ মানুষের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছিল।
এখন করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সারা বিশ্ব যখন তৎপর ও তটস্থ তখন ওই দৃষ্টিভঙ্গি যে বজায় রয়েছে তা মোটেই মিথ্যা নয় বরং সত্য। অনেক দেশ ও অঞ্চল অত্যন্ত জরুরিভাবে এই মহামারীকে প্রতিরোধের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কারণ ক্ষমতাধর পরাক্রমশালী দেশগুলোও এই ভাইরাসের শিকার হয়েছে। তাই এই রোগের ব্যাপারে আমরা কি উপলব্ধি করতে পারছি, কি কি চিন্তাভাবনা করছি সে ব্যাপারে অবশ্যই আমাদের আন্তর্জাতিকভাবে উদ্যোগ নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
অনেক মানুষের এখনো এই শিক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন যে, রোগ হচ্ছে যেটা মানুষের শরীরকে পীড়া দেয়, অর্থাৎ শরীরকে আক্রান্ত করে। চীনা, আফ্রিকান বা পশ্চিমা শরীর বা দেহ নয়, এটি হলো মানুষের শরীর। যে মুহূর্তে রোগটিকে কোনো অঞ্চলভিত্তিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তখন থেকে একটি অসৎ পন্থায় এবং বিপজ্জনক প্রয়াসের মাধ্যমে মানবতাকে মুছে ফেলা বা বিলুপ্ত করা হলো। সম্ভবত গভীর একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয় হলো, আমরা মানসিকভাবে এমন কিছু ধারণা করে নেই যেটা আমাদের ক্ষতি করতে পারে। সম্ভবত এটা অসংখ্য বর্ণবাদের মধ্যে অন্যতম একটি বর্ণবাদ। প্রকৃতপক্ষে মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মকাণ্ডে এবং স্বার্থে এই বর্ণবাদ পাওয়া যেতে পারে।
কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব প্রমাণ করেছে, আপনি কে এবং কোত্থেকে এসেছেন সে ব্যাপারে ভাইরাস থোড়াই কেয়ার করে। অনেকে উল্লেখ করেছেন, এটা আমাদের নতুন বিশ্বব্যবস্থার একটি কৃত্রিম সৃষ্টি বা মানুষের তৈরি; আমি সম্মানের সাথে এর সাথে দ্বিমত পোষণ করি। বণিক, ব্যবসায়ী এবং পণ্ডিত ব্যক্তিরা একে অপরের সংস্কৃতি এবং পণ্যকে পরস্পরের কাছে নিয়ে এসেছেন। এভাবে বিশ্ব সদাসর্বদা বৈশ্বিক বা বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত।
আমরা যখন অন্যদের ব্যাপারে গভীর পরিবর্তন নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি, তখন একই সময়ে আমরা দেখতে পেলাম এই বিশেষ মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের দেখার এবং শোনার সুযোগ করে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী কিভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে এবং আবার মহাধুমধাম করে কিভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উদযাপন করা হচ্ছে। আমরা নিজেদের থেকে অন্যদের জীবন এবং জীবনসংগ্রামকে আর স্বাধীন অথবা আলাদা করে ভাবতে পারি না। আমরা বেশি দিন তাদের দুঃখ-দুর্দশাকে অন্য কোনো স্থানে সরিয়ে দিতে পারি না।
কারণ আমরা যে বিশ্বে বাস করি, তারাও তারই অংশ। মানুষের স্কিন বা চামড়া নিয়ে আমি যখন পেইন্টিং শুরু করি, তখন মানুষের প্রকৃতিগত কিছু অমোচনীয় বিষয় আমাকে শিখে নিতে হয়। আমার প্রাথমিক চিন্তাভাবনা ছিলÑ মানুষের শরীর একটি ক্যানভাস হিসেবে কাজ করতে পারে। সুতরাং আমি তাই করেছি। কিন্তু আমি আমার কাজ নিয়ে অগ্রসর হয়ে যখন তার গভীরে প্রবেশ করি, তখন দেখি প্রত্যেকের শরীর বা দেহ পেইন্টিংকে একটু ভিন্নভাবে এবং অনন্য সাধারণ রূপে প্রকাশ করছে। আমার রঙ-তুলি দিয়ে আফ্রিকান সংস্কৃতির গভীরের শেকড় অনবদ্যভাবে তুলে ধরি। কিন্তু যে ব্যক্তি তাদের বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি তাদের জীবন এবং জীবনের অর্থ রঙ-তুলিতে মূর্তভাবে তুলে ধরেন। যখন আমি বিশ্বে ঘটে যাওয়া দুর্যোগ-দুর্বিপাকের কথা চিন্তা করি, তখন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তি ও তাদের লাশ নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। একটি ভাইরাসকে আফ্রিকান বা চীনা বা আমেরিকান বা ফরাসি ভাইরাস বলে অজুহাত বের করা প্রত্যেকের জন্য ক্ষতিকর। সামাজিক ব্যাধি, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় যে আমাদের সবার কারণে হচ্ছে, সে ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই সামষ্টিকভাবে উপলব্ধি থাকতে হবে। ভালো হোক বা মন্দ হোক, এগুলো আমাদের অংশ এবং আমরা এগুলোর অংশ।