তেলযুদ্ধে ইরান কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
তেলযুদ্ধে ইরান কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে? - সংগৃহীত
করোনার আগ্রাসনে জানুয়ারি থেকেই তেলের মূল্যহ্রাস শুরু হতে থাকে। সরবরাহ নিয়ে সৌদি আরব ও রাশিয়া কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি, কোনো সমঝোতা হয়নি। গত ২০ বছরেও তেলের দাম এত নিচে নামেনি। করোনা ভাইরাস চীন থেকে ছড়ানো শুরু হলে চীনা রিফাইনারিগুলো উৎপাদন কমিয়ে আনে। নানা দৃষ্টিকোণ থেকে চলতি এপ্রিল মাসকে তেলের মূল্য, সরবরাহ, উৎপাদন ও কৌশলের সেরা মাস হিসেবে বিবেচিত করছে তেল-বিশ্ব। এ মাসেই সৌদি আরব তার উৎপাদন প্রতিদিন ১২.৩ মিলিয়ন ব্যারেলে নিয়ে আসছে। রাষ্ট্র পরিচালিত সৌদি তেল জায়ান্ট আরামকো এই ঘোষণা দিয়েছে। তেলযুদ্ধের কারণে সৃষ্ট রাশিয়া-সৌদি সম্পর্ক খুবই বিস্ফোরণমুখ।
রাশিয়া তেল উৎপাদন কাটছাঁট করতে চায় না, তাই তেল-আলোচনা কোনো সফলতা দেখেনি। রাশিয়ার লক্ষ্য যেভাবেই হোক ইউরোপে তেল সরবরাহ করা। কিন্তু রাশিয়া কেন এমনটি করল? রাশিয়া জানে তেলের দাম কমলে তারাও কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। চলতি বছরের মার্চে রাশিয়া প্রতিদিন ১০ হাজার ৮৩৫ মিলিয়ন ব্যারেল উৎপাদন করেছে, যা আগের মাসগুলোর চেয়ে বেশি। পূর্বাভাস দেয়া হয়েছেল, রাশিয়ার জানুয়ারিতে ইকোনমিক গ্রোথ হবে ২.৩ শতাংশ, কিন্তু হয়েছে ১.৬ শতাংশ। ২০১৯ সালের পর এটা রাশিয়ার সর্বনিম্ন গ্রোথ রেট। তেলের টাকায় ক্রেমলিন বাজেট বানায়। এটা ক্রেমলিনের বোঝার কথা নয় যে, সৌদি আরব হঠাৎ দাম কমিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করবে। ধারণা করা হয়েছিল, উভয় দেশ তেল নিয়ে আলোচনা করবে এবং মূল্যের বিষয়টি সুরাহা করবে, আদতে তা হয়নি। মস্কোর আরেকটি কৌশল হলো, মস্কো প্রতি ব্যারেল ২৫-৩০ ডলার করে রাখবে ছয় থেকে ১০ বছরের জন্য। তাদের জাতীয় ওয়েলফেয়ার ফান্ডের সম্পদ থেকে এই বছরগুলোতে সম্পদ জোগান দেয়া সমস্যা হবে না। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৭ সালে তেলের বাজারে কঠিন অবস্থান নেয়। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ইউরোপ, রাশিয়া, ইরান ও ভেনিজুয়েলার বড় বড় ক্রেতা ও সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। রাশিয়া-জার্মানির গ্যাস পাইপলাইনের ওপর নানা ধরনের অবরোধ ও নির্মাণে বাধা দিতে থাকে, ফলে রাশিয়ার তেল ও গ্যাস জায়ান্ট গ্যাজপ্রম ইউরোপে গ্যাস সরবরাহে কাক্সিক্ষত অবস্থান হারিয়ে ফেলে। রাশিয়া এটাও বুঝে যে, তেলের দাম কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তেলযুদ্ধ চালাতে হবে। গ্যাজপ্রমের এনালিস্ট কিরিল কনোনভ বলেন, ৫০ ডলারের নিচে নামলেই যুক্তরাষ্ট্রের তেলের ব্যবসায় লাল বাতি জ্বলবে।
বলা হয়েছে, তেলের দাম হঠাৎ করে ৩০ শতাংশ নেমেছে। রাশিয়া ও সৌদি আরবের তেলের দামের যুদ্ধে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ৩৫ ডলার বা তারও নিচে বিক্রি হচ্ছে। ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট বা ডব্লিউটিআই ২৮ ডলার দাম হেঁকেছে। ২০১৬ সালের পর এমনভাবে আর তেলের দাম পড়েনি। সৌদি আরব এশিয়া, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের ছয় ও আট ডলার করে ডিসকাউন্ট দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সৌদি আরব আরো বলে, অপরিশোধিত তেলের দাম পড়ে গেলেও এবং বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও তারা তেলের উৎপাদন বাড়াবে। ওপেক ও রাশিয়ার সাথে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ার পর সৌদি আরব এ পদক্ষেপ নেয়। তেলযুদ্ধের এই পর্যায়ে ওপেক ও নন-ওপেক দেশগুলো ভিয়েনায় বৈঠকে বসে। কিন্তু বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির মারাত্মক অবস্থানের কারণে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি এতগুলো দেশের কর্মকর্তারা। বৈঠকে রাশিয়া ও সৌদি আরবের প্রতিনিধিদের মধ্যে বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়।
ইরান আন্তর্জাতিক অবস্থার চাপে পড়ে তার উৎপাদন দুই হাজার ১০০ মিলিয়ন ব্যারেল থেকে কমে এখন ৯ হাজার ব্যারেলে নেমেছে। মেহের নিউজের সংবাদে জানা যায়, তেলের দামও পড়ে গেছে। ফলে ইরানের আয়ের পথও সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই ভাইরাস মহামারীর ভেতরও ইরানে কয়েক দফা অবরোধ দিয়েছে। ইরানকে এখন করোনা ও তেল উভয় সঙ্কটের মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
২০১৯ সাল ইরানের জন্য ভালো ছিল না, ২০২০ যেন আরো খারাপ। যুক্তরাষ্ট্র ইরানে সবচেয়ে ‘বেশি চাপ প্রয়োগের নীতি’ নিয়ে এগোচ্ছে। এতে ইরানের ত্রাহি অবস্থার মতো। ইরান কত আর চুপ থাকবে? হরমুজ প্রণালীতে হিট অ্যান্ড রান পলিসি প্রয়োগ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ ও ম্যান অব ওয়্যারের বিরুদ্ধে তাদের তৈরি মনুষ্যবিহীন ছোট টর্পেডো বোটগুলো ছোটখাটো টার্গেট প্র্যাকটিস করে জাহাজকে বেকায়দায় ফেলছে এখন। হরমুজ প্রণালী থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ তেলবাহী জাহাজ ও রণতরীগুলো পারস্য উপসাগরে যাতায়াত করে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরানে অবরোধ দিতে থাকে তার ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে ইরানের তেলের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেয়। তথাপি চীন, ভারত, কানাডা ও অন্যান্য দেশ ইরান থেকে তেল ক্রয় করে। এখন দাম কমে যাওয়ায় ইরান আরো বেকায়দায় পড়েছে। হেনরি রোম, ওয়াশিংটনভিত্তিক ইউরেশিয়া গ্রুপের এক বিশ্লেষক বলেন, ২০২০ ইরানের অর্থনীতি খুবই বিপদাপন্ন হবে। তবে একেবারে ধসে পড়বে না।
কোভিড-১৯ এর ভেকসিন তৈরি না হলে তেল উৎপাদন, মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহের ওপর এবং একে অন্যের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারবে না এবং ওপেকের ২০১৬ সালের মূল্য নির্ধারণ নীতিমালাও মানবে না বলেও মনে হচ্ছে। রিগের সংখ্যা কমিয়ে নিলে তেল ইন্ডাস্ট্রিতে বেকারত্ব সমস্যাও প্রকট হয়ে দেখা দেবে। জরুরি এই সময়ে বিশ্ব শাসনে তেল ও স্বর্ণ বড় হাতিয়ার। আমরা দেখেছি, প্রায় ক্ষেত্রে অপরিশোধিত তেলের উৎপাদন খরচ ব্যারেল প্রতি পাঁচ ডলার, অন্যান্য খরচসহ ১০ ডলারে দাঁড়ায়। এই তেল যখন ব্যারেল প্রতি ১০০ বা ১৫০ ডলার বিক্রি হয়, তখন কী পরিমাণ অর্থ হাতে আসে তা কল্পনাতীত। এই পৃথিবীকে শাষণ করার জন্য যার হাতে যত বেশি ডলার রয়েছে সে দেশ তত শক্তিশালী। এই অবস্থানটি কেউ ছাড়তে রাজি নয়।