করোনায় একজন মুসলিমের করণীয়
করোনায় একজন মুসলিমের করণীয় - সংগৃহীত
সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ বিপদ আপদকে সঙ্গী করেই পথ অতিক্রম করেছে। হজরত আদম আ: থেকে শুরু করে আজ অবধি মানবজাতি যেসব বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে তা যেমন মানুষের হাতের অর্জন তেমনি মহান রবের পক্ষ হতে স্পষ্ট সতর্কবার্তা। বর্তমান সময়ে সারা দুনিয়ার চিকিৎসাবিজ্ঞানের উৎকর্ষতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনকারী অতিক্ষুদ্র অণুজীব ‘করোনা’ও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। যদিও করোনার উৎপত্তি ও বিস্তৃতি নিয়ে কিছু বিশ্লেষকদের মতামত হলো এটি একটি জীবাণুযুদ্ধ যার সূচনা হয়েছে চীন অথবা যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে। মূলকথা হলো এটি প্রাকৃতিকভাবেই হোক আর মানবসৃষ্টই হোক মহান আল্লাহ তায়ালা তার ও তার রাসূলের ভবিষ্যদ্বাণী এভাবেই বাস্তবায়িত করেছেন।
এখন কথা হলো এই মহামারী হতে উত্তরণের কোনো উপায় আছে কি না? অবশ্যই রয়েছে। মহামারী হতে উত্তরণের জন্য দুই ধরনের উপায় অবলম্বন করতে হবে। প্রথমটি হলো চিকিৎসাবিজ্ঞানের শরণাপন্ন হওয়া, আর এটি রাসূল সা:-এর নির্দেশনাও বটে। এ বিষয়টি হলো সার্বজনীন। চিকিৎসকরা যেসব পরামর্শ দিচ্ছেন তা সবার জন্য প্রযোজ্য। যেমন বেশি বেশি সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা প্রভৃতি। এ বিষয়গুলো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গ্রহণযোগ্য। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, এ বিষয় মেনে চলার পাশাপাশি মুসলিম হিসেবে আমাদের রয়েছে বিশেষ কিছু করণীয়। আর এটিই হলো মৌলিক বিষয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘ইউনুসের সম্প্রদায় ব্যতীত আর কোনো জনপদ এমন কেন হলো না যে, তারা ঈমান আনত এবং তাদের ঈমান উপকারে আসত? যখন তারা ঈমান আনল আমি তাদের ওপর থেকে দুনিয়ার জীবনের অপমানজনক আজাব দূর করে দিলাম’ (সূরা ইউনুস : ৯২)।
হজরত ইউনুস আ: তার জাতিকে বারবার দাওয়াত দেয়ার পরও যখন হেদায়েত গ্রহণ করেনি, তখন তার জাতির উপরে আল্লাহর আজাব নির্ধারিত হয়। হজরত ইউনুস আ: জনপদ ছেড়ে চলে যান। তার কওম বুঝতে পারল তাদের প্রতি শিগগিরই আল্লাহর আজাব আপতিত হবে। তাদের অন্তরে তাওবার অনুভূতি সৃষ্টি হলো এবং নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করায় অনুতপ্ত হলো। তারা জীর্ণবস্ত্র পরিধান করল এবং নারী-পুরুষ আলাদা করে রাখল। এমনকি পশুগুলোকেও এভাবে আলাদা করে রাখল। তারা এক মরু প্রান্তরে গিয়ে মাতা-পিতা, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা ও শিশুদের পাশাপাশি উষ্ট্র, গাভী, বকরি ও অন্য পশুগুলোকে নিয়ে হাজির হয়ে চোখের পানি ঝরিয়ে বিনয়ের সাথে চিৎকার করে আল্লাহকে ডাকতে শুরু করল। মোটকথা তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে এত অস্থির হয়েছিল যেন তারা কেয়ামতের ভয়াবহতা স্বচক্ষে অবলোকন করছে।
তার পর আল্লাহ তাদের প্রতি বিশেষ রহমত নাজিল করলেন এবং তাদেরকে শাস্তি থেকে রক্ষা করলেন। আল্লাহ তায়ালা উল্লিখিত আয়াতে বলেছেন, অতীতে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি কেন ঈমান আনছিল না, যে ঈমানের কারণে আমি তাদের ক্ষমা করে দিতাম। তাই বোঝা যায় আমাদেরকে কওমে ইউনুসের মতো আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে হবে। আমাদের সব কৃতকর্মের জন্য কান্নাকাটি করে আল্লাহর নিকট তওবা করতে হবে। আমরা যদি তাদের মতো করে তাওবা করতে পারি হয়তো আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করবেন এবং করোনাভাইরাস হতে রক্ষা করবেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যখন কোনো জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তা ছাড়া এমনসব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকদের মাঝে কখনো দেখা যায়নি।’ (ইবনে মাজাহ ৪০১৯) এ হাদিস যেন বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই বর্ণিত হয়েছে।
প্রযুক্তির অগ্রযাত্রার কল্যাণে অশ্লীলতা আজ সহজলভ্য। ঘরে ঘরে অশালীন গান-বাদ্য, মুভি-নাটক-সিনেমা চলছে অবলীলায়। মানুষের নৈতিক ও চারিত্রিক অধঃপতন সমাজকে অশ্লীলতার চরম পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। এই মহামারী থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সব ধরনের অশ্লীলতা থেকে ফিরে এসে আল্লাহর কাছে তাওবা করতে হবে। চিকিৎসকদের পরামর্শগুলো মেনে চলার ক্ষেত্রে আমাদের নিয়ত সঠিক করে নেয়া উচিত কেননা রাসূল সা: বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই প্রতিটি কাজের প্রতিদান তার নিয়ত অনুযায়ী দেয়া হবে’। রাসূল সা:-এর সুন্নাত হলো রোগের সময় ওষুধ গ্রহণ করে আল্লাহর ওপরে ভরসা করা। যদি আমরা চিকিৎসকের পরামর্শকে রাসূল সা:-এর সুন্নত হিসেবে গ্রহণ করি এটি হবে আমাদের জন্য কল্যাণকর। আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে, ধৈর্যসহকারে তার কাছে এখন বেশি বেশি সাাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। আল্লাহ বলেন ‘তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর’ (সূরা বাকারা ১৫৩)। আল্লাহ আরো বলেছেন, ‘আর সব ব্যাপারে মুমিনদের আল্লাহর ওপরই ভরসা করা উচিত’ (সূরা তাওবা ৫১)।
আজ আমরা মসজিদে সালাত আদায়ের জন্য যেতে পারছি না এটি বেদনাদায়ক বিষয়। কিন্তু এটা পুরো জমিনকে মসজিদে পরিণত করার সুযোগও বটে। প্রতিটি ঘরকেই ইসলামের আলোয় আলোকিত করার সুযোগ। ঘরে ঘরে কুরআনের তালিম, হাদিসের দারস চালু করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার সুযোগ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে করোনাতেই হোক আর যেভাবেই হোক আল্লাহর কাছেই আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তারা বিপদে পতিত হয় তারা বলে নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য আর তার দিকেই আমাদের প্রত্যাবর্তন’। “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন”।
লেখক: খতিব, জান্নাতুল মাওয়া জামে মসজিদ, গাজীপুর