‘ছোঁয়াচে রোগ’ সম্পর্কে ইসলাম
‘ছোঁয়াচে রোগ’ সম্পর্কে ইসলাম - সংগৃহীত
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের এই সঙ্কটময় সময়ে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক নিরাপত্তার পাশাপাশি ‘ছোঁয়াচে রোগে’র অস্তিত্ব নিয়েও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে সাধারণ মুসলমানরা। আভিধানিক অর্থে, স্পর্শ করলেই বা ছুঁলেই সংক্রামিত হয়, এমন রোগকে বলে ‘ছোঁয়াচে রোগ’। এখন কথা হলো, ছোঁয়াচে রোগ বলে ইসলামে কিছু আছে কি নেই। এ সম্পর্কে জানার আগে একটি বিষয় জানতে হবে যে, ইসলাম মধ্যপন্থার অমায়িক একটি ধর্ম। পার্থিব উপায়-উপকরণ গ্রহণ ও সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল বা অগাধ ভরসাই ইসলামের মূল শিক্ষা। যার অর্থ, সৃষ্টিকর্তাকে উপেক্ষা করে শুধু উপায়-উপকরণ গ্রহণ করার নাম যেমন ইসলাম নয়; তেমনি উপায়-উপকরণ গ্রহণ ছাড়া শুধু সৃষ্টিকর্তার ওপর সব ভরসা চাপিয়ে দেয়াও ইসলামের শিক্ষা তো নয়-ই, এর দ্বারা একজন ব্যক্তির বড় বুজুর্গ হওয়াও সাব্যস্ত হয় না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়, করোনাভাইরাসের এই সময়ে মানুষকে দু’ভাগে বিভক্ত দেখা যাচ্ছে। একদল বলছে, সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগ বলতে ইসলামে কিছু নেই। রোগ দেয়া না-দেয়ার মালিক আল্লাহ। আরেক দল মনে করে, রোগবালাই এসব শরীর ও জনস্বাস্থ্যজনিত ব্যাপার, এখানে সৃষ্টিকর্তার কোনো হাত নেই। উল্লেখ্য, এর মধ্যে প্রথম দল মূলত আল্লাহর পৃথিবী-পরিচালনানীতিকে উপেক্ষা করে সব কিছু আল্লাহর ওপর চাপিয়েছে। যা মূলত বান্দার কেবল অক্ষমতাবাদকে উৎসাহিত করে; যা ইসলামী শরিয়তে গ্রহণযোগ্য নয়। অক্ষমতাবাদীরা বিশ্বাস করে, বান্দার কোনো শক্তি নেই, করণীয় নেই, দায় নেই; বরং বান্দা কেবলই আল্লাহর ইচ্ছায় পরিচালিত। আবার দ্বিতীয় দল আবার সৃষ্টিকর্তার শক্তি-ক্ষমতাকে উপেক্ষা করে কেবলই পৃথিবীর উপায়-উপকরণে বিশ্বাসী; যা বস্তুবাদকে নির্দেশ করে। এটিও ইসলামী শরিয়তে অগ্রহণযোগ্য।
‘ছোঁয়াচে’ কি তবে নেই?
ছোঁয়াচে রোগ সম্পর্কে একজন মুসলমানের স্বচ্ছ ধারণা ও বিশ্বাস থাকা জরুরি। এ প্রসঙ্গে প্রথম বিশ্বাসটি হচ্ছে, আসমান-জমিন, গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র, মহাকাশ, সাত আসমান সর্বত্রই এক আল্লাহই সর্বশক্তিমান। সর্বৈব তাঁরই রাজত্ব। কোনো কিছুই তাঁর অগোচরে নেই। সব কিছুই তাঁর ইচ্ছাধীন। আল্লাহ বলেন, ‘স্থলভাগ ও সমুদ্রের সব কিছুর ব্যাপারে তিনি অবগত রয়েছেন; তাঁর অবগতির বাইরে একটি বৃক্ষপত্রেরও পতন ঘটে না...।’ (সূরা আনআম, আয়াত : ৫৯)।
অত্র আয়াত থেকে জগতের সব কিছুরই এক আল্লাহর একচ্ছত্র কর্তৃত্বে পরিচালিত হওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার। অনুরূপ কোনো রোগের মধ্যে ছোঁয়াচভাব বা সংক্রমণের ক্ষমতাও আল্লাহই দেন; যে ক্ষমতা বলেই মূলত রোগটি লোক থেকে লোকান্তরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ছোঁয়াচে রোগ বলে কোনো রোগই নেই মর্মে যে হাদিসে এসেছে, তার কী ব্যাখ্যা। সে ব্যাখ্যায় যেতে হলে প্রথমেই আমাদের সেই হাদিসটিকে সামনে আনা জরুরি। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘রোগের কোনো সংক্রমণ নেই, কু-লক্ষণ বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই, প্যাঁচা অশুভের লক্ষণ নয়, (হিজরি সনের) সফর মাসের কোনো অশুভ ব্যাপার নেই। কুষ্ঠরোগী থেকে দূরে থাকো, যেমন তুমি বাঘ থেকে দূরে থাকো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৭০৭)। ওই হাদিসটি ভালো করে বুঝে নিলেই ছোঁয়াচে রোগ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া সম্ভব। হাদিসের প্রথমাংশে যে বলা হয়েছে, ‘রোগের কোনো সংক্রমণ নেই’, তার অর্থ এটা নয় যে পৃথিবীতে কোনো সংক্রামক রোগ নেই;
বরং এর অর্থ হচ্ছে, কোনো রোগের মধ্যে নিজে থেকে সংক্রমণের ক্ষমতা নেই। আল্লাহ কোনো রোগের মধ্যে সংক্রমণের ক্ষমতা দিলেই তা সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগে পরিণত হতে পারে। এবং জমিনে কিছু রোগ তো অবশ্যই সংক্রামক রয়েছেই। যদি তা না-ই থাকত, তবে হাদিসটির শেষাংশে নবীজি সা: বলতেন না, ‘তুমি কুষ্ঠরোগী থেকে এতটা দূরত্ব বজায় রাখো, যতটা তুমি বাঘ থেকে দূরত্ব রাখো’। এর মানে কুষ্ঠরোগ একটি ছোঁয়াচে রোগ। আর ছোঁয়াচে রোগ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে সচতনতা অবলম্বন করাও এই হাদিসের শিক্ষা।
লেখক : মুহাদ্দিস, সিরাজুল উলুম মহিলা মাদরাসা, সাভার।