করোনার বিপদে আজহারীর পরামর্শ

মিজানুর রহমান আজহারী | Apr 08, 2020 06:48 am
মিজানুর রহমান আজহারী

মিজানুর রহমান আজহারী - সংগৃহীত

 

 

বর্তমান সময়ে একটা মহাবিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে আমরা দিন অতিবাহিত করছি। করোনাভাইরাসের এই মহামারী বিশ্বকে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে। উন্নত দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে যেকোনো ধরনের যেকোনো পেশার মানুষ করোনার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশের অফিস আদালত, ব্যবসা বাণিজ্য, দোকান, শিল্পকারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে। এমন অবস্থায় আমরা আসলে কী করব? আল্লাহর ওপর কিভাবে তাওয়াক্কুল করব, তাওয়াক্কুলের এসেন্সই বা কি।

মহামারীর সময় আল্লাহ কিভাবে আমাদের থাকতে বলেছেন, কী করতে বলেছেন, তা পবিত্র কুরআন ও রাসূল সা:-এর হাদিসে ব্যাখ্যা করা যায়। সূরা তওবার ৫১ নাম্বার আয়াতের সরল অনুবাদ হচ্ছে যে, ‘হে নবী আপনি বলুন কোনো কিছুই আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না বা আমাদেরকে কোনো মুছিবতই পেয়ে বসবে না, যতটুকু আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন। আমাদের নসিবে আল্লাহ যতটুকু রেখেছেন, ততটুকুই আমাদের ওপর বর্তাবে। তার বাইরে কেউ কোনো ক্ষতি আমাদের করতে পারবে না। আর আল্লাহই হচ্ছেন আমাদের রক্ষাকারী, আমাদের অভিভাবক, আমাদের প্রভু আমাদের রক্ষক। আর আল্লাহর ওপরই বিশ্বাসীদের তাওয়াক্কুল বা নির্ভর করা উচিত। এটি হচ্ছে এই আয়াতের সরল অনুবাদ। এই আয়াতটা কিন্তু মোমিনদের জন্য বড় একটা আশার বাণী। আমাদের মনে প্রশান্তি জোগানোর বাণী। চেষ্টা প্রচেষ্টা করার মালিক হলাম আমরা, ফলাফল দেয়ার মালিক আল্লাহ।

এটা আমরা বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ তায়ালা যদি আমার ক্ষতি না চান তা হলে গোটা বিশ্ব আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ যদি আমার ক্ষতি চান তা হলে, গোটা বিশ্ব আমাকে রক্ষা করতে পারবে না। আল্লাহ যদি না চান তা হলে একটা সুঁইয়ের আঘাতও কেউ আমাকে দিতে পারবে না। তিরমিজ শরিফের একটি হাদিসে আছে, সবাই মিলেমিশে যদি তোমার ক্ষতি করতে চায়, কেউ-ই তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। ততটুকুই তোমার ক্ষতি হবে, যেটুকু আল্লাহ তোমার নসিবে রেখে দিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল সা:-এর জীবনের শেষ দিকে নাজিল হওয়া সূরা তাওবার ৫১ নম্বর আয়াতে এ কথাটি বলা হয়েছে। এটা তাবুক যুদ্ধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাজিল হওয়া। আমরা জানি যে, তাবুক যুদ্ধটা হয়েছিল নবম হিজরিতে রোমানদের বিরুদ্ধে। এই সময়ে আবহাওয়া খুবই খারাপ ছিল। খুবই গরম, সামার সিজনে। আর মদিনা ছিল কৃষিনির্ভর একটি এলাকা। যেখানে অনেকে খেজুর চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তখন গরমে খেজুর পেকে গিয়েছিল এবং গাছ থেকে খেজুর কেটে ঘরে রাখার সময় এসেছিল। আর মদিনা হচ্ছে তাবুক অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে, প্রায় ৬০০ কিলোমিটার।

ঠিক ওই পরিস্থিতিতে এত গরম এত লম্বা সফরকে ব্যাখ্যা করে এমন পরিস্থিতিতে অনেক মুনাফেক সাহাবাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বলেছিল, তোমরা যদি যাও তা হলে তোমরা মারা যাবে। রোমান সৈনিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এটা সহজ বিষয় নয়। না খেয়ে, লম্বা পথ পাড়ি দিতে গিয়ে বরং তোমরা মারা পড়বে। বরং তোমরা থেকে যাও, এটাই তোমাদের জন্য ভালো। তখন আল্লাহ তায়ালা এ মুসলমানদের গাইডলাইন হিসেবে এই আয়াত নাজিল করেছিলেন। সেখানে আল্লাহ বলেছেন, ‘হে নবী সা: আপনি বলুন, মুসলমানদের কোনো ভয়ভীতিতে পেয়ে যেতে পারে না। বরং একজন বিশ্বাসী এটুকুই বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তার জন্য যতটুকু ক্ষতি রেখেছে এর চেয়ে বেশি ক্ষতি তার হবে না। কারণ আল্লাহই আমাদের অভিভাবক। তিনিই আমাদের আশার স্থল। এটাই তাওয়াক্কুল। আমরা চেষ্টার পর চেষ্টা চালিয়ে যাবো, চেষ্টা চালানোর মালিক আমরা। ফল নির্ভর করবে আল্লাহর ওপর। এটাই তাওয়াক্কুল।

আমরা কিভাবে তাওয়াক্কুল করব। তাওয়াক্কুলের ইসলামিক কনসেপ্টটা কী। পূর্ববর্তী আম্বিয়া আলাইহিস্সালামরা কিভাবে তাওয়াক্কুল করতেন, কিভাবে তারা আল্লাহর ওপর ভরসা করতেন সে বিষয়টি আলোচনা করব। এ বিষয়ে সূরা আনফালের ৬৪ নম্বর আয়াতের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘বিশ্বাসী তো তারাই, যাদের সামনে আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তাদের অন্তর কেঁপে ওঠে এবং তাদের সামনে যখন আল্লাহর হায়াত তেলাওয়াত করা হয়, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায়। তারা তখন আল্লাহর ওপর, তাদের রবের ওপর তার তাওয়াক্কুল করে।
এই আয়াত থেকে আমরা যেটা পেলাম তা হলো, বিশ্বাসীরা আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে এবং যে ব্যক্তি প্রকৃত অর্থে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তায়ালা ওয়াদা করেছেন তখন তাদেরই জন্য যথেষ্ট হয়ে যান আল্লাহ।

সূরা তালাকের তিন নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর যথানিয়মে নির্ভর করে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান।’ আম্বিয়াদের জীবনীতে আমরা দেখব, সব নবীই আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করেছেন।
হজরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসালাম যখন তার এলাকাবাসীর কাছে আল্লাহর দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং তার পিতাকে সত্যের দিকে দাওয়াত করেছিলেন তখন তিনি আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, হে আমাদের রব আমরা আপনার ওপর তাওয়াক্কুল করলাম এবং আপনার দিকে, আমরা আপনার কাছেই ফিরে আসব।

নবী করিম সা: জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করেছেন এবং আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। আমরা যখন ঘর থেকে বের হবো, তখন যেন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে বের হই। তিনি বের হওয়ার সময় বলতেন, বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আ’লাল্লাহ। আমি তাওয়াক্কুল করলাম আল্লাহর ওপর। অর্থাৎ হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে সাহায্য চাই। আমি যেন কারো কষ্ট না দেই, কেউ যেন আমাকে কষ্ট না দেয়। আমি নিজেও যাতে কারো পদস্খলন না ঘটাই, নিজেও যেন পদস্খলিত না হই। কারো ওপর যেন জুলুম না করি।

মুমিন জীবনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিটি কাজে মহান আল্লাহ তায়ালার ওপর তাওয়াক্কুল করা। আর দায়িত্ব পালন করে যাওয়া। গোটা বিশ্ব আজ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে। সবাই তটস্থ, আতঙ্কিত। এই মুহূর্তে আমাদের কি করণীয়, আল্লাহর ওপর আমাদের তাওয়াক্কুলের ধরনটা কী হবে। এই মুহূর্তে আমরা আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করি, ইবাদত করি, কুরআন পড়ি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখি, ঘরে অবস্থান করি এবং আমরা যারা ধনী আছি তারা গরিবদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই।

তাওয়াক্কুলের ধরনটা কী হবে এ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে আমাদের মাঝে। অনেকে এমন ধারণা করছেন যে, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করলে এবং সূরা কেরাত ও কুরআন পড়লে আমাদের আর কিছু করতে হবে না। করোনাভাইরাস আমাদের কোনো কিছুই করতে পারবে না। অনেকে ভাবছেন, শুধু আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুূল করে জামাতে অংশগ্রহণ করলে, জুম্মার নামাজ পড়লে, মসজিদে গেলে করোনা আমাদের আক্রমণ করতে পারবে না। একটা গ্রুপ আছে যারা এ ধগ্রণর ধারণা পোষণ করছেন। আরেকটা গ্রুপ বলছে, তারা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছেন, সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন এবং আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে যারা নিয়মনীতি মানছেন না, শুধু তাওয়াক্কুলের ওপর স্থির রয়েছেন তাদের পশ্চাৎপদ বলছেন। আসলে উভয় গ্রুপই চরমপন্থা অবলম্বন করছেন। এক্সট্রিম মনোভাবের মধ্যে ইসলাম নেই। ইসলাম আসলে এই দুই গ্রুপের মাঝামাঝি অবস্থানে। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে বসে থাকলাম, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের কারণে আমি সাবধানতা অবলম্বন করলাম না, এটা ভুল ধারণা। আবার আমি চেষ্টা প্রচেষ্টা সবই চালিয়ে গেলাম, সর্বোচ্চ হাইজিন মেনটেন করে চললাম আর আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করলাম না, এটাও একটা ভুল ধারণা।

আমাদের এটা খেয়াল রাখতে হবে যে, অসতর্কতা কিংবা সাবধানতা অবলম্বন করা কিন্তু তাওয়াক্কুল পরিপন্থী নয়। তাওয়াক্কুলেরই একটা অংশ। বিষয়টা আমরা কুরআন থেকে ব্যাখ্যা করতে পারি। সূরা ইউসুফের ৬৭ নম্বর আয়াতে নবী ইয়াকুব আ: দুর্ভিক্ষের সময় তার সন্তানদের মিসরে খাদ্য আনার জন্য পাঠানোর সময় একটি চমৎকার নসিহত দিয়েছিলেন। কুরআনে সেটা আল্লাহ তায়ালা সরাসরি কোড করেছেন। এখানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তিনি (ইয়াকুব আ:) তার সন্তানদের ডেকে বলেছিলেন, খাবার আনার জন্য তোমরা মিসরে যখন প্রবেশ করবে, তখন সবাই একই গেট দিয়ে ঢুকবে না। সাবধানতা অবলম্বন করবে এবং একেকজন একেক গেট দিয়ে মিসরে প্রবেশ করবে। যাতে তোমাদের কেউ চিনতে না পারে। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করবে, তিনি যেটা হুকুম দিয়েছেন সেটাই হবে।’

এই আয়াতে সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে, সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এবং আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করতে হবে। এটাই ইয়াকুব আ: তার সন্তানদের বলেছিলেন।

দ্বিতীয়ত, তাওয়াক্কুলের কাজটি হচ্ছে পরে। আগে আপনার কাজটি করতে হবে। চেষ্টা আগে, এরপর তাওয়াক্কুল টু আল্লাহ। আপনি আগে আপনার সাধ্যের সবটুকু করবেন, তারপর আল্লাহর ওপর ভরসা করবেন। এটা হচ্ছে ইসলামের বিধান। এটাই হচ্ছে তাওয়াক্কুলের সঠিক পদ্ধতি। সহিহ মুসলিম শরিফের একটি হাদিসে বলা হয়েছে, এক সাহাবা তার উটটি ছেড়ে দিয়ে মসজিদে ঢুকবেন, নাকি উটটি বেঁধে রেখে ঢুকবেন এ বিষয়ে আল্লাহর রাসূলের কাছে জিজ্ঞেস করেন। রাসূল সা: তখন বলেছিলেন, আগে তোমার উটটি রশি দিয়ে বাঁধো, তারপর তুমি আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে মসজিদে ঢুকো। তোমার কাজ তোমাকে করতে হবে। তোমার কাজ না করে তুমি আল্লাহ ওপর তাওয়াক্কুল করতে পারো না। আগে নিজের কর্ম করে যেতে হবে, তারপর তার ফলাফলের জন্য আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করতে হবে। এটাই আল্লাহর নির্ধারিত।

ভিডিও ক্লিপ থেকে অনুলিখন


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us