ছেলের আবেগঘন খোলা চিঠি বাবা তোমার অপেক্ষায় আমরা
শফিকুল ইসলাম কাজল - সংগৃহীত
প্রায় এক মাসেও সন্ধান মেলেনি নিখোঁজ ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটছে স্বজনদের। এই বুঝি ফিরে এসে ঘরের দরজায় নক করছেন কাজল। এভাবে আশায় বুকবেঁধে দর+জার দিকে তাকিয়ে থাকেন স্ত্রী-সন্তানরা।
এ দিকে করোনাভাইরাসের কারণে ঘরবন্দী কাজলের ছেলে পলক নিখোঁজ বাবার প্রতি আবেগঘন একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। তার আশা, বাবা যেখানেই থাকুন এটি দেখবেন এবং একদিন ফিরে আসবেনই।
গত ৩০ মার্চ পলক তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে চিঠিটি লিখেছেন। তাতে লেখাÑ প্রিয় বাবা, আমি জানি না তুমি কোথায় আছো। ভালো যে নেই তা তীব্রভাবে বুঝতে পারছি। কল্পনা করতে পারছি, কী ভীষণ একা একা সময় পার করছ। বুঝতে পারছি, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছ তুমি। ঠিক সেই সময়ের মতো, যখন তুমি মাকে ভারত থেকে সার্জারির পর ফেরত নিয়ে এসেছিলে। আমার মনে হয় না তারা তোমার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারবে। এই চিঠি কি আদৌ তোমার কাছে পৌঁছবে? তোমাকে কি তারা এই চিঠি পড়তে দেবে? তোমাকে কি তারা ফেরত আসতে দেবে? দিলে কখন দেবে? এই চিঠি যদি তোমার কাছে পৌঁছায়, তবে কিছু কথা তোমাকে বলতে চাই, তোমার পরিবার এখনো শক্ত আছে। আশায় বুক বেঁধে আছে। এই আশা কখনো ঝাপসা হবে না। আমরা তোমার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় আছি। অধীর আগ্রহের সাথে বসে আছি তোমার জন্য। পৌষি খুবই আশাবাদী। ও এখনো খারাপ কোনো চিন্তা করছে না একটি বারের জন্যও। ওর অনেক কথা বলার আছে তোমাকে। ও এখন মায়ের পাশে ঘুমায়। মা আমাকে জিজ্ঞেস করে, তুই কি সত্যিই তোর বাবাকে ফেরত আনতে পারবি? কাজল কবে আসবে? আমাদের কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? আমি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কখনো দেই না, কারণ উত্তরগুলো আমার জানা নেই।
আমি তোমাকে ফেরত আনার চেষ্টা করছি। অনেকে বলছেন, আমি ছেলে হিসেবে অনেক করছি। আমি ছেলে হিসেবে পর্যাপ্ত করেছি, এ কথা তখনই ভাবতে পারব যখন তোমাকে আমাদের মাঝে আবার ফেরত পাবো। কেউ কেউ বলছেন, আমার মতো ছেলে তাদের যদি থাকত! পিতামাতাকে তাদের সন্তানের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলে যেকোনো সন্তানই তাদের পিতামাতাকে ফেরত পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে। আমিও তাই করছি। আমি আমার বাবা-মা কে চিনি। আমি জানি না আমার বাবা-মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা-মা কি না কিন্তু আমি জানি, তোমাদের থেকে শ্রেষ্ঠ বাবা-মা আমার কখনো হতে পারত না। আমি সবসময়ই জানতাম, তোমার আর মায়ের আমার থেকে যোগ্য সন্তান প্রাপ্য ছিল। পিতাকে নিয়ে চলে যাওয়ার ২০ দিন পরেও যে সন্তান তার পিতাকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি, সন্তান হিসেবে তার যোগ্যতা কী? এমন ছেলে থেকে কী লাভ?
আমি জানি, এমন কোনো কিছু আমার সাথে হলে তুমি এতক্ষণে আমাকে ফিরিয়ে আনতে। তুমি আমাকে ফিরিয়ে আনা ছাড়া কখনো ঘরে ঢুকতে না। অনেকের জীবন তুমি এতদিনে কঠিন করে দিতে। আমি তোমার মতো ক্ষমতা রাখি না। আমাদের পরিবার সবসময়ই তোমার ওপরে ভরসা করেছে, বিপদে-আপদে, অসুখে, রোগে, আর্থিক সঙ্কটে। এখন যখন তুমি নেই, আমিই দিশেহারা হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি আমাদের পরিবারের রক্ষণকর্তাকে।
প্রতি রাতে বাসায় সবার পরে আমি ঘুমাতে যাই। যখন রাতে একা জেগে থাকি, সবসময় আশা করি তুমি চলে আসবে। আমি জানি, তারা তোমাকে আহত করেছে, তবু আশা করি, যেকোনো উপায়ে তুমি এখনো নিজের পায়ে ফিরে আসতে পারবে। রাতে বাইরে পায়ের আওয়াজ শুনলে খুবই উদ্বিগ্ন হই। কারো গলার আওয়াজ শুনলে ভাবি, তুমি কি এসেছ?
দেশের পরিস্থিতি আগের কোনো সময়ের মতোই না। রাস্তাঘাট সম্পূর্ণভাবে ফাঁকা। সবাই বাড়িতে থাকছে। আমাকেও বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। লজ্জাজনক, আমি জানি। তুমি কখনো বাসায় বসে থাকতে না। এখন কেউ আমার সাথে দেখা করতে রাজি হয় না। আমার যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। এমন এক অসহায় অবস্থায় আছি আমি এখন। দেশ অচল হওয়ার আগে আমি ভোরবেলা বের হয়ে যেতাম। রাত ১-২টার আগে ফিরতাম না। আমি একা বের হতে পারি না। আমাকে অনেকেই বলেছে, আমার ওপর নজর রাখা হচ্ছে। কারা রাখছে, কেন রাখছে, আমি তা জানি না। আমি সাবধান থাকছি যেন আমাদেরকে ব্যবহার করে তোমাকে ভয় দেখাতে না পারে।
আমি আশা করি, তুমি তোমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছ বের হয়ে আসার। এই বাজে পরিস্থিতি থেকে আমিও সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমি কোনোদিনও থামব না। তোমাকে সুস্থ, জীবিত অবস্থায় ফেরত পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাকে থামানো যাবে না। আমি আমার বাবাকে যেকোনোভাবে আমাদের মধ্যে ফেরত চাই ।
আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। আশা করছি, তুমি দ্রুতই চলে আসবে। আশা করছি, এই চিঠি তোমার কাছে পৌঁছাবার আগেই তুমি চলে আসবে। আশা করছি, এখনি তুমি দরজায় টোকা দেবে, আমি এই শেষ কথা লিখে চিঠি শেষ করার আগে-
ফটো সাংবাদিক কাজল গত ১০ মার্চ থেকে নিখোঁজ হন। ওই দিন বাসা থেকে বেরিয়ে হাতিরপুলে তার অফিসে যান। এরপর তিনি আর বাসায় ফেরেননি। কাজলের পরিবার মনে করে, তাকে অপহরণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে একটি অপহরণ মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু নিখোঁজের প্রায় একমাস হলেও কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
নিখোঁজের একদিন আগে আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য কাজলের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেন। মামলায় দৈনিক মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীসহ ৩২ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার পরদিনই কাজল নিখোঁজ হন।