ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি : ৫টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

মাসুমুর রহমান খলিলী | Apr 06, 2020 08:46 pm
ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি : ৫টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি : ৫টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় - সংগৃহীত

 

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী এ নিয়ে পাশ্চাত্য প্রভাবিত সমাজে নানা ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে। এই বিভ্রান্তি ইউরোপ-আমেরিকার অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে পাশ্চাত্য প্রভাবিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও। এ বিভ্রান্তির কেন্দ্রবিন্দুতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে যার শীর্ষে রয়েছে- প্রথমত, ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজে বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতি, বহু মত ও দৃষ্টিভঙ্গি চর্চার অবকাশ কতটা রয়েছে সে বিষয়। দ্বিতীয়ত, আধুনিক গণতন্ত্রে সর্বজনীন ভোটাধিকারভিত্তিক যে গণপ্রতিনিধিত্বের চর্চা রয়েছে সেটি ইসলামী রাষ্ট্রচিন্তায় কতটা বিন্যাস বা প্রয়োগযোগ্য। তৃতীয়ত, হিজাব বা পর্দার মতো যেসব ধর্মীয় বিধান ইসলামের জীবন প্রণালীতে রয়েছে তা অমুসলিম তথা পাশ্চাত্য সমাজে কতটা চর্চার অবকাশ রয়েছে। চতুর্থত, হুদুদ বা ব্যভিচারের মৃত্যুদণ্ডের মতো যে শাস্তি রয়েছে তা এখনকার সময়ে কতটা প্রয়োগযোগ্য। পঞ্চমত, অমুসলিমদের ওপর জিজিয়া করের মতো যে বিধান রয়েছে তা এখনকার মুসলিম দেশগুলোয় প্রয়োগযোগ্য কি না। এর বাইরেও ইসলামের যে খেলাফত ব্যবস্থা একসময় বিদ্যমান ছিল তার বাস্তবায়ন এখনকার সমাজে কিভাবে হবে অথবা রাজতন্ত্র বা অন্য কোনো শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে, মুসলিম সমাজ রাষ্ট্র বা দলে নারী নেতৃত্ব গ্রহণযোগ্য কিনা, ইসলামী দলগুলো সাধারণ দলগুলোর সাথে রাজনৈতিক জোট করতে পারবে কি না- এসব বিষয়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে বিতর্ক রয়েছে। এসব ইস্যু নিয়ে ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনার পাশাপাশি সাধারণ চিন্তাবিদ ও গবেষকরাও নানাভাবে অবদান রাখছেন।

উপরে যেসব ইস্যুর কথা বলা হয়েছে আধুনিক সমাজে এসব বিতর্কের বিষয় একেবারে নতুন নয়। তবে এসব বিষয় নতুন করে আলোচনায় আসছে কমিউনিজমের আদর্শগত পতন বা বিপর্যয়ের পর ইসলামের আদর্শবাদী ধারা যেটাকে পাশ্চাত্য ‘পলিটিক্যাল ইসলাম’ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে তার উত্থানের কারণে। ইসলামের আবির্ভাবের পর গত ১৫ শ’ বছরের ইতিহাসে মুসলিম জনগোষ্ঠী বিভিন্ন পর্ব পার করেছে। এর মধ্যে ‘বিশুদ্ধ ইসলামের চর্চাকাল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় হজরত মুহাম্মদ সা: এবং তাঁর পরবর্তী চার খলিফা হজরত আবু বকর রা:, হজরত উমর রা:, হজরত ওসমান রা: ও হজরত আলী রা:-এর শাসনকালকে। ইসলামী সাম্রাজ্যের মূল বিস্তৃতি ও আদর্শিক সম্প্রসারণ হয়েছিল এ সময়। এরপর উমাইয়া, আব্বাসীয় ও উসমানীয় খেলাফত মুসলিম বিশ্বকে শাসন করেছে। এর বাইরেও মুসলিম বিশ্বের কোনো কোনো অঞ্চলে খেলাফত প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

খেলাফতের রাজতান্ত্রিক ধারা শুরু হওয়ার পর্বগুলোতেও ইসলামের আদর্শগত সম্প্রসারণ এবং রাষ্ট্রের সীমানা বিস্তৃত হয়েছে। ইসলামের প্রচার প্রসার সাহাবা, তাবেইন, তাবে-তাবেইনের সময় এবং এর পরও অব্যাহত থাকে। ইসলামের বিধিবিধান ও ধ্যান-ধারণা নিয়ে গবেষণা চলমান থাকায় বিদ্যমান তত্ত্বের উন্নয়ন এবং বিকাশও ঘটেছে। একই সাথে চিন্তাগত ধ্যান-ধারণায় নানা স্কুল বা ধারারও সৃষ্টি হয়। চিন্তা ও বিশ্লেষণের বহুমুখী ধারার বিকাশের মধ্য দিয়েই ইসলামের ভাবনা চিন্তার উন্নয়ন বর্তমান পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।

ইসলামের বিকাশ ও উন্নয়নের বর্তমান পর্যায়ে পাশ্চাত্য ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইসলামের বিধিবিধান ও চিন্তাধারা নিয়ে যে বিতর্ক ও সংশয় দৃশ্যমান, তার কিছু মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন বিশিষ্ট গবেষক শাহ আবদুল হালিম তার ‘ডিসকোর্স অন কনটেমপরারি পলিটিক্যাল থট’ নামের বইয়ে। এই বইটিতে সমসাময়িক ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে, যা পাঠকদের অনেক অব্যক্ত বিষয় বুঝতে সহায়তা করবে। বইটিতে আলোচিত ইস্যুগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে রয়েছে, ইসলাম গণতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, মানুষের সার্বভৌমত্ব ও আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, দার আল হারব এবং দার আল ইসলাম, অমুসলিমদের ওপর জিজিয়া কর, হুদুুদের মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি, ধর্মত্যাগের শাস্তি, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এবং এ-সংক্রান্ত অন্য বেশ কিছু বিষয়। ৩৪টি নিবন্ধের এই বইটির বিষয়বস্তু ১৯৯২ থেকে ২০১৯ এর পটভূমিতে বাছাই করা হয়েছে। আর গত তিন দশকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দৃশ্যের খুব বেশি মৌলিক অর্থবহ পরিবর্তন হয়নি। এতে আলোচিত প্রতিটি ইস্যু এখনো প্রাসঙ্গিক।

ইসলামের সুবর্ণ যুগের ইসলামী পণ্ডিতরা ভাবতেন যে, মুসলমানরা বিশ্বজুড়ে ইসলামের শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে এবং ইসলামকে একটি বিজয়ী দ্বীন তথা জীবনের পথ হিসেবে গড়ে তুলতে জন্মগ্রহণ করেছে। ধ্রুপদী ফিকাহবিদগণের অনেকে ধারণা করেছিলেন, মুসলিম সমাজ চিরকাল শক্তিশালী এবং সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে। তারা আজকের যে পরিস্থিতিতে মুসলমানরা বাস করছে সে সম্পর্কে হয়তোবা পুরোপুরি ভাবতে পারেননি। ফলে মুসলিমরা বিজয়ী শাসক থাকাকালে তারা অনেক বিষয়ে খুব কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন যদিও ইসলামের মূল নির্দেশনাকে পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে চিরন্তন এবং বেশ নমনীয় দেখা যায়।

এখন খেলাফত আমলের (উসমানীয় খেলাফতের সময় পর্যন্ত) ইমাম, ফকিহ এবং পূর্ববর্তী প্রজন্মের পণ্ডিতদের অপেক্ষাকৃত কঠোর ব্যাখ্যা ব্যবহার করে মুসলিমদের অসহিষ্ণু প্রমাণ করার চেষ্টা করতে দেখা যায়। প্রচার করা হয় যে, মুসলমানরা বহুমতে বিশ্বাস করে না এবং তাদের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানের কোনো আশাও নেই।
অথচ ইসলামের একটি বড় সৌন্দর্য হলো, এর অনুসারী মুসলিমরা কুরআন-সুন্নাহর মৌলিক বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যশীল ইজতিহাদ বা অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হলে, নতুন কিছু গ্রহণ করতে পারে। সতর্ক ইজতিহাদের মাধ্যমে যদি কোনো ইস্যুতে আরো বেশি সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয় তাহলে মুসলিমরা সর্বদা নতুন অবস্থানকে বিন্যাস করে নিতে পারে। এ কারণেই ইসলামকে একটি ‘গতিশীল ধর্ম’ যা চির-পরিবর্তিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে সক্ষম, হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

পাশ্চাত্য অবশ্য ইচ্ছাকৃতভাবে পূর্ববর্তী প্রজন্মের কয়েকজন বিশিষ্ট আলেম ও বুদ্ধিজীবীর পুরানো ইজতিহাদি সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে এসবকে মুসলিমদের ‘চিরায়ত সিদ্ধান্ত’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। উদাহরণস্বরূপ একটি বিষয়ের উল্লেখ করা যেতে পারে। বিশ্বকে দারুল ইসলাম বা শান্তির বাসস্থান এবং দার আল হার্ব বা যুদ্ধের আবাসে বিভক্ত করার ইজতিহাদ ছিল হাজার বছরের পুরনো। এখনকার মুসলিম আলেম ও ফকিহরা সে ক্ষেত্রে বিশ্বকে বিভক্ত করেছেন দু’টি অংশে- দার আল ইজাবাহ বা গ্রহণযোগ্যতার দেশ, যে দেশটি ইসলামকে গ্রহণ করেছে এবং যেখানে ইসলামী মূল্যবোধ চর্চা করা হয়। আর দ্বিতীয়টি হলো দার আদ দাওয়াহ বা দাওয়াতের দেশ, যে ভূমিতে দাওয়াত উপস্থাপিত হয়েছে এবং এর জনগণকে ইসলামী মূল্যবোধ ও রীতি অনুসরণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। মুসলিম স্কলারদের এই দুই ইজতিহাদের মধ্যে হাজার বছরের পুরনোটি এখনকার সময়ে আর গ্রহণযোগ্য নয়। প্রথমটি হাজার বছর আগের প্রেক্ষাপটে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়েছিল। এখন সেই বিভাজন গ্রহণযোগ্য নয়।

এ প্রসঙ্গে উত্তর আমেরিকার ফিকাহ কাউন্সিলের সভাপতি এবং জেদ্দাভিত্তিক আন্তর্জাতিক একাডেমি ফিকাহের সদস্য, ড. তাহা জাবির আল আলওয়ানি উল্লেখ করেছেন যে, দার আল কুফর এবং দার আল হার্বের বিভ্রান্তিকর বিষয়টি গ্রহণ করার অর্থ- যুক্তরাষ্ট্রের মতো অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোর আইন ও বিধিবিধান লঙ্ঘনের অধিকার মুসলিমদের রয়েছে। এ ধারণা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ড. আলওয়ানি উল্লেখ করেন, আমরা বহু আমেরিকান বহু সংস্কৃতি ও বহু জাতিগত সমাজে অমুসলিমদের মধ্যে ছোট সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হয়ে উত্তর আমেরিকাতে বাস করছি।

ইসলামী শরিয়াহ ও ফিকাহ অনুসারে মুসলিমদের এখানে জীবনযাপন করার সুযোগ রয়েছে। উত্তর আমেরিকার পরিবেশটি অধ্যয়ন না করে ফতোয়া এলে সেটি উত্তর আমেরিকান মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি বিরাট যুক্তিহীন কাজ হবে। প্রকৃতপক্ষে, এ ধরনের রায় বা ভুল ব্যাখ্যা মহাদেশটিতে ইসলামের ভবিষ্যতের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এই ইস্যুটি এখনকার সময়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যখন উগ্রবাদী চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের কারণে পাশ্চাত্য সমাজে মুসলিমরা তীব্র চাপের মুখে রয়েছেন। শাহ আবদুল হালিম এ বিষয়টিকে তার বইয়ে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us