করোনাভাইরাস : ইসলামে বন্দীদের অধিকার
করোনাভাইরাস : ইসলামে বন্দীদের অধিকার - সংগৃহীত
নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) বিশ্বকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছে প্রায় চার মাস। চীন থেকে শুরু হয়ে বর্তমানে বিশ্বের ২০৩টি দেশের মানুষের মধ্যে এই মরণব্যাধি ভাইরাস বিস্তার লাভ করেছে। মুসলিমরা মহান আল্লাহর দরবারে এ ভাইরাস হতে মুক্তির জন্য দোয়া করছে। বাংলাদেশের মানুষও এ ভীতির বাহিরে নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) এবং বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব বৃদ্ধি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বলা হচ্ছেÑ একজন আরেকজন থেকে কমপক্ষে ৩ ফুট দূরত্বে থাকতে হবে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ৬৮টি কারাগারে ৮৯ হাজারেরও বেশি বন্দী আটক রয়েছে। অথচ এ কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতা ৪১ হাজার ৩৪০ জন মাত্র। এমতাবস্থায় কারাবন্দী ও কারা কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজন মহা উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় অতিবাহিত করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক কারাগারে ১৬৭ জন কয়েদি ও ১১৪ জন কারাকর্মীর শরীরে করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। এর প্রেক্ষিতে নিউ ইয়র্ক সিটির গভর্নর এন্ড্রু কুমো বলেন, ধারাবাহিকভাবে বন্দী মুক্ত করা হবে। অন্য দিকে করোনাভাইরাসের ভয়াবহতায় ইতোমধ্যে ইরান ৮৫ হাজার কয়েদিকে জামিন দিয়েছে। ইরানের বিচার বিভাগীয় প্রধান ইবরাহিম রঈসি জানান, করোনার ভয়াবহতা না কমা পর্যন্ত বন্দী মুক্ত করার এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
কারা সূত্রে জানা যায়, দেশের ৬৮টি কারাগারের মধ্যে মাদারীপুর কারাগার লকডাউন করা হয়েছে। মাদারীপুরে অধিকসংখ্যক বিদেশফেরত প্রবাসীদের কারণে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারা অধিদফতর। বাগেরহাট কারাগারে নতুন বন্দী তিন চীনা নাগরিককে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে প্রতিটি কারাগারে নতুন বন্দীদের জন্য আলাদা সেল খোলা হয়েছে। এই সেলে রাখা হয়েছে ১৪টি কক্ষ। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বন্দীদের পর্যায়ক্রমে ১৪টি কক্ষে নেয়া হচ্ছে। ‘নতুন আমদানি সেল’ নামে এই সেলে বন্দী আনার আগেই তাদের পরীক্ষা ও তল্লাশি করার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
কারা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হতে বাঁচতে এই মুহূর্তে কারাগারের ধারণক্ষমতা বিবেচনা করে কিছু বন্দী কমানো দরকার। অথচ কোর্ট বন্ধ থাকায় অন্যান্য সময়ের মতো স্বাভাবিক জামিনও হচ্ছে না, অন্যদিকে কয়েদি বাড়ছে প্রতিনিয়ত। কারাগার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক ডিআইজি প্রিজন মেজর জেনারেল সামছুল হায়দার সিদ্দিকউ গণমাধ্যমকে বলেছেন, করোনাভাইরাস একটি ছোঁয়াচে রোগ, সে তুলনায় কারাগারে বন্দীদের ভিড় বেশি থাকে সব সময়। গাদাগাদি করে থাকতে হয়। লঘু দণ্ডপ্রাপ্ত যেসব অপরাধী রয়েছে তাদের জামিনের ব্যবস্থা করলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি কমত। বিষয়টি সরকার ও সংশ্লিষ্টরা বিবেচনা করতে পারেন। বন্দিদের মর্র্যাদা ও অধিকার প্রদানে ইসলাম : ইসলাম বন্দীদের সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করেছে। রাসূল সা. বন্দীদের সাথে কোমল ব্যবহার করার জন্য কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। বদর যুদ্ধের বন্দীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করার জন্য তিনি সাহাবিদের নির্দেশ দেন।
অসুস্থ বন্দীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে তাগিদ দেন। ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী বন্দীদের এমন স্থানে রাখতে হবে যেখানে তারা জীবনের নিরাপত্তাবোধ করবে। কেননা বন্দীদের আটকের উদ্দেশ্য হলো মানব মর্যাদা অক্ষুণœ রেখে তাদের সংশোধন করা ও সমাজের কল্যাণে প্রস্তুত করা। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘শরিয়তের দৃষ্টিতে কয়েদিকে নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন জায়গায় আটক রাখবে, যেখানে তার ব্যক্তিগত কোনো শক্তি প্রয়োগের সুযোগ থাকবে না। চাই সে বন্দিত্ব ঘরে, মসজিদে কিংবা কারাগারে হোক। মাজমুউল ফাতাওয়া : ৩৫/৩৯৮
রাসূল সা: বন্দীদের রাখার জন্য প্রশস্ত ও আলো প্রবেশ করে এমন তাঁবু নির্বাচন করতেন। যাতে বন্দীরা শারীরিক ও আত্মিক প্রশান্তি লাভ করে। আধুনিক যুগে এ ধরনের কারাগারকে ঙঢ়বহ চৎরংড়হ তথা উন্মুক্ত কারাগার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যাতে কয়েদিদের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করে।
[সহিহ ইবনে খুজায়মা : ২/২৮৫, হুকুকুল মাসজুন ফিশ শরিয়াতিল ইসলামিয়া : পৃষ্ঠা ৫৪]
মানবমণ্ডলিকে অসুস্থতা, ঝুঁকি ও মহামারী হতে রক্ষা করা ইসলামী শরিয়তের অন্যতম নির্দেশনা। আল্লাহর ভাষায় : তোমরা নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না (সূরা বাকারা : ১৯৫)।
ফিকহ বিশেষজ্ঞরা বলেন, বেশিসংখ্যক বন্দীকে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে আটক রাখা জায়েজ নয়। যেখানে শীতে ও গরমে বন্দীদের কষ্ট হয়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব কয়েদিদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। ইসলামী আইনবিদরা আরো বলেন, বন্দীদের কারাগারে চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। জেল কর্তৃপক্ষ যদি কোনো কয়েদিকে বাইরে চিকিৎসা করাতে বাধ্য হন তাহলে বিচারক তাকে বাইরে নেয়ার অনুমতি দেবেন (আল এখতিয়ার : ৫/২৬, হাশিয়াতু ইবনে আবেদিন : ৫/৩৭৮, ফাতহুল কাদির ইবনুল হুমাম : ৫/৪৭১, আদাবুল কাযি লিল খাসসাফ : ২/৩৭৫, ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৪/৪১২, হুকুকুল মাসজুন ফিশ শরিয়াতিল ইসলামিয়্যা : পৃষ্ঠা ৭৬)।
ইতোমধ্যেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে কারাগার সংরক্ষিত রাখতে দেশের তিন হাজার কারাবন্দীকে জামিন দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। করোনায় সৃষ্ট দুর্যোগের কারণে কারাবন্দীর সংখ্যা কমাতেই দেশের ৬৮ কারাগারে ছোটখাটো অপরাধ ও জামিনযোগ্য ধারায় বিচারাধীন তিন হাজারের বেশি কারাবন্দীকে জামিন দিতেই এ উদ্যোগ বলে জানা গেছে। এর পরও ৪১ হাজার ৩১৪ জন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন কারাগারগুলোতে বাকি ৮৬ হাজারেরও বেশি কারাবন্দীকে গাদাগাদি করে থাকতে হবে, যা করোনাসৃষ্ট মহামারীর সময়ে ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ। এমতাবস্থায় কারাগার বিশেষজ্ঞ ও আইন গবেষকদের মতামত অনুযায়ী ১৯৬০ সালের বিচার বিভাগীয় অধ্যাদেশ আলোকে লঘু দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি, রাজনৈতিক বন্দী, শিক্ষাবিদ, বয়োবৃদ্ধ বন্দী ও নারী বন্দীদের শর্তসাপেক্ষে জামিন দেয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা, বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টদের গুরুত্বের সাথে দেখা প্রয়োজন।
মুফতি, আরবি ভাষাবিদ, এমফিল গবেষক