যেসব ভাইরাস দিয়ে তৈরী করা হয়েছে জীবাণু অস্ত্র
যেসব ভাইরাস দিয়ে তৈরী করা হয়েছে জীবাণু অস্ত্র - সংগৃহীত
করোনাভাইরাস নিয়ে মহামারর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার সময়ই ষড়যন্ত্রের তত্ত্বটা তুলেছিলেন ইসাইলের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা ও জীবাণু অস্ত্র বিশারদ ড্যানি শোহাম। বলেছিলেন, দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের কারণ উহান ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল বায়োসেফটি ল্যাব। তার এই দাবি কিন্তু নানা শাখা-প্রশাখা মেলে নতুন নতুন ধারণা নিয়ে আসছে। এ নিয়ে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিবাদ শুরু হয়ে গেছে।
ড্যানিকে উদ্ধৃত করে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন টাইমস দাবি করেছিল, করোনা ভাইরাসগুলো নিয়ে গবেষণা করা হয় ওই গোপন পরীক্ষাগারে। সেখান থেকেই লিক হয়েছে এই ভাইরাস! চীন অবশ্য বিতর্কিত জৈব অস্ত্র কর্মসূচি পরিচালনার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। জৈব রাসায়নিক অস্ত্র কর্মসূচি থেকে নতুন করোনা ভাইরাসটির উৎপত্তি কি না, জানতে চেয়ে আমেরিকার চীনা দূতাবাসের কাছে ইমেইল পাঠালেও কোনো উত্তর পায়নি ওয়াশিংটন টাইমস। চীনের দাবি, তারা এই ভাইরাসের উৎস সম্পর্কে কিছুই জানে না।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক স্তরে আরো একটি তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। আর তা ৩৯ বছর আগে প্রকাশিত একটি ‘বেস্ট সেলার’ বইকে কেন্দ্র করে। ১৯৮১ সালে আমেরিকার থ্রিলার লেখক ডিন কুন্স একটি বই লেখেন। বইয়ের নাম ‘দ্য আইস অব ডার্কনেস’। ডিন কুন্সের পাঠকরা বলছেন, লেখক এই করোনা ভাইরাসের বিষয়টা সেই ৩৯ বছর আগে হুবহু বইতে লিখেছেন। তাঁর বইয়ে একটি জীবাণু-অস্ত্রের কথা লেখা আছে। উহান-৪০০। ডিন কুন্স লিখেছেন, চীনের উহানে ওই জীবাণু অস্ত্র কারখানা অবস্থিত এবং এই ভাইরাসটি মানুষের তৈরি অণুজীবের ৪০০তম সংস্করণ হওয়ায় এমন নামকরণ। ফলে বায়োলজিক্যাল উইপন অর্থাৎ জীবাণু অস্ত্র বানাতেই যে করোনা ভাইরাসটি তৈরি করেছিল চীন— এমন জল্পনা আবার শুরু হয়ে গেছে।
বিশ্বে বায়োলজিক্যাল যুদ্ধের শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। ক্ষমতাশালী দেশগুলোতে এই অস্ত্র তৈরির ইতিহাসও বেশ পুরনো। যুদ্ধে অ্যানথ্রাক্স, ব্রুসেলোসিস, কলেরা, নিউমোনিক প্লেগ, টুলারেমিয়া, স্মলপক্স, গ্ল্যান্ডার্সের মতো নানা ধরনের প্রাণঘাতী ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত কিউবাতে ডেঙ্গু জ্বরে কয়েক লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, এর সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ। ওই সময় কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো অভিযোগ করেছিলেন, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল আমেরিকার জীবাণু অস্ত্রের আক্রমণে। পেন্টাগন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনুদান দিয়ে থাকে জীবাণু অস্ত্র নিয়ে গবেষণা করার জন্য। এমন অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। অভিযোগ রয়েছে, অনুদানপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার নামে জীবাণু অস্ত্রের গবেষণাগার গড়ে তোলে। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত মার্কিন সামরিক বাহিনীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পোকামাকড়ের মাধ্যমে জীবাণু অস্ত্র ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা আমেরিকারই ছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ আ্যালগিপ্টি মশার মাধ্যমে আফ্রিকায় ইয়েলো ফিভার ছড়ানো হয়। ১৯৭৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে সামরিক বায়ো-ল্যাব থেকে অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণু প্রবলভাবে ছড়িয়ে পরে সর্বত্র। বহু মানুষ মারা যায়। তদন্তের পর প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন এর দায় স্বীকার করে নেন। করোনার ক্ষেত্রে জীবাণু অস্ত্রের ধারণাও একেবারেই বাতিল করে দেয়া যায় না। অস্ত্র ছাড়াই প্রাণঘাতী কোনো ভাইরাসের মাধ্যমে শত্রুপক্ষকে তিলে তিলে খতম করে দেয়ার জন্যই মূলত এসব ভাইরাস তৈরি করা হয়। জৈবিক বিষাক্ত পদার্থ কিংবা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং ছত্রাকের মতো সংক্রামক অণুজীবের মাধ্যমে বায়োলজিক্যাল এসব অস্ত্র নাকি পারমাণবিক অস্ত্রের থেকেও ভয়ঙ্কর! আসলে মানুষই মানুষের শত্রু সৃষ্টি করে। তারপর তা যখন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে ওঠে, তখন তাকে ধ্বংস করার জন্য হিমশিম খায়।
২০১৮ সালে জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার এক সভায় আর অ্যান্ড ডি ব্লুপ্রিন্টের বিশেষজ্ঞ দল প্রথম ‘ডিজিজ এক্স’ নাম দিয়ে পরবর্তী মহামারী সম্পর্কে সতর্ক করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, পরবর্তী মহামারী কী থেকে উদ্ভূত হবে, তা জানা নেই। কিন্তু এর আশঙ্কা প্রবল। অজানা সেই জীবাণুর নাম তারা দিয়েছিলেন, ‘ডিজিজ এক্স’। তারা বলেছিলেন, চেনা কোনও জীবাণু থেকে পরবর্তী মহামারী হওয়ার আশঙ্কা কম। আর তেমন হলেও চেনা শত্রুর বিষয়ে মানুষের মোটামুটি প্রস্তুতি থাকে। মুশকিল হচ্ছে অজানা জীবাণু নিয়ে। সেই সময় গবেষকরা এও বলেছিলেন যে, এই ডিজিজ এক্স কোনও প্রাণীদেহ থেকে আসা ভাইরাস থেকেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। মানুষ এখন এক নতুন মহামারীর যুগের সামনে দাঁড়িয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্য সব মহামারীর মতোই, করোনা ভাইরাসের মহামারী এবং আতঙ্ক একদিন শেষ হবে। এর আগে সার্স, তারপর সোয়াইন ফ্লু মহামারীও দমন হয়েছে। আরো আগে, অনেক ভয়াবহ মহামারী ছিল। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু। স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পাঁচ থেকে দশ কোটি মানুষ মারা যায়। সেনাশিবিরে এই ভাইরাস ছড়ায় বেশি। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে যখন এক জায়গায় গাদাগাদি করে সেনাদের থাকার প্রয়োজন পড়ল না, তখন সেই স্প্যানিশ ফ্লু’র সংক্রমণও আপনা-আপনি কমে গেল।
প্লেগ হয়তো মানুষের সংস্কৃতির অংশ ছিল না। কিন্তু মানুষের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিস্তারই প্লেগের জন্মভূমি। একই কথা প্রযোজ্য মধ্যযুগে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়া ‘ব্ল্যাক ডেথের’ ক্ষেত্রেও। প্রাচীন সিল্ক রোড ধরে বাণিজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বিস্তার পেয়েছিল অসংখ্য রোগও। এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল জীবাণু। ইনফ্লুয়েঞ্জার নতুন ধরনটি এসেছিল গবাদিপশুর খামার থেকে। হালের করোনা ভাইরাস থেকে শুরু করে ইবোলা, সার্স, মার্স, জিকা— এই সবেরই সংযোগ রয়েছে কোনো না কোনো বন্যপ্রাণীর সঙ্গে। তার উপর রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। যার কারণে গলে যাচ্ছে বড় বড় বরফের চাঁই। ফলে নিদ্রা ভাঙছে অচেনা-অজানা অনেক অণুজীবের।
করোনা ভাইরাস যে রোগটি ঘটাচ্ছে, তার নাম কোভিড-১৯। এটি আসলে একধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু। একই লক্ষণ। সাধারণ ফ্লু’র সঙ্গে এর অনেক মিল এবং বেশ কিছু তফাৎও রয়েছে। এটা সহজে একজনের থেকে আরেকজনের কাছে চলে যাচ্ছে। ওষুধ নেই। এই ভাইরাস সম্পর্কে অনেক কিছু এখনো অজানা। লক্ষণ শুরুর আগেই আক্রান্ত মানুষটি ভাইরাস ছড়াচ্ছে। এই ব্যাপারটা সাধারণ ফ্লু’র বেলায় ঘটে না। করোনা ভাইরাস অন্য মানুষের কাছে যাচ্ছে মুখ থেকে বের হওয়া হাঁচি-কাশির সঙ্গে। জানা-বোঝা বলতে ওইটুকুই। ভয় হল, একে এখনই থামানো না গেলে কিংবা সে যদি নিজেই বসন্তে বা গ্রীষ্মে থেমে না যায়, তাহলে বিপদ হবে। ভাইরাস বারবার ফিরে আসবে। যার একবার হয়েছে, তার অ্যান্টিবডি সৃষ্টি হওয়ার কারণে আরেকবার হবে না, সেটাও বলা যাচ্ছে না। এটা মিউটেট অর্থাৎ অভিযোজনের মাধ্যমে আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে। সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ, করোনা ভাইরাস সম্পর্কে অনেক কিছুই এখনো বিজ্ঞানীদের অজানা রয়ে গেছে।
অনেকেই বলছেন, করোনা ভাইরাস একটি জীবাণু অস্ত্রই। অস্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য সাধারণের মধ্যে জীবাণু ছেড়ে দেয়া হয়েছে। পরীক্ষা–নিরীক্ষা শেষে যথাসময়ে প্রতিষেধকও চীনের ওষুধ কোম্পানিগুলো বাজারে ছাড়বে। কাড়ি কাড়ি মুনাফা ঘরে তুলবে। অপেক্ষা করুন!
সূত্র : বর্তমান