করোনা ভয়াবহভাবে আঘাত হানবে ভারতে!
করোনা ভয়াবহভাবে আঘাত হানবে ভারতে! - সংগৃহীত
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব নিয়ে করন থাপরের সাথে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিীটর লেকচারার ও ওয়াশিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর ডিজিজ ডাইনামিক্স, ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিসির পরিচালক ড. আর লক্ষ্মীনারায়নের সাক্ষাতকার দেখা সবচেয়ে তৃপ্তিদায়ক অভিজ্ঞতা। অত্যন্ত খোলামেলাভাবে বিপুল পরিমাণ তথ্য সহজলভ্য হয়, পাওয়া যায় যৌক্তিক ব্যাখ্যা।
বৃহস্পতিবার একই বিষয়ের ওপর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতির উদ্দেশে যে ভাষণটি প্রদান করেছেন, এই সাক্ষাতকারটি তা বোঝার জন্য অনেক বেশি সহায়ক হয়েছে।
যেকোনো বিবেচনায়, এটি ছিল মোদির একটি ক্লাসিক বক্তৃতা : খুবই নাটকীয়, তথ্যসমৃদ্ধ ছোট হলেও আবেগের প্রতি আবেদন জাগানিয়া এবং চূড়ান্ত বিশ্লেষণে যেকোনো দৃঢ় সংকল্পবদ্ধতা প্রকাশের ব্যাপারে অস্পষ্টতা।
অবশ্য মোদির বক্তৃতার ধরনই এমন : সংযত কণ্ঠে বিজয়োল্লাস নয়, জাকজমকতা নয়, লম্বা দাবি নয়, সুস্পষ্ট আশ্বাস নয়। সর্বোপরি ভারত কোভিড-১৯-এর যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তা তিনি প্রকাশ করতে অনেক বেশি আগ্রহী, এমন ধারণা সৃষ্টি করে তার বক্তৃতা।
কিন্তু তারপরও এই ধারণা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক যে দেশ কোথায় আছে তা জানার জন্য সরকার অন্ধকারে হাতড়ে মরছে। টেস্ট কেসের কোনো প্রয়াস ছাড়াই সরকার ১২টি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে থেকে আক্রান্তের সংখ্যা সম্পর্কে অনেক কম জানছে। আর ব্রিটেন যে সমস্যায় পড়েছে আজ, তার কারণও এটি। লক্ষ্মীনারায়নের হিসাব অনুযায়ী, ভারতে নিশ্চিতভাবেই অন্তত ১০ হাজার অশনাক্ত করোনাভাইরাস আক্রান্ত রয়েছে।
এটা ‘এক্স’ ফ্যাক্টরে পরিণত হয়েছে। লক্ষ্মীনারায়নের হিসাব অনুযায়ী, ভারত দুই বা তিন সপ্তাহ আগেই মহামারির তৃতীয় পর্যায়ে উপনীত হয়ে গেছে। আর সরকার স্কুল ও এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। তার মতে, সরকার জানে যে মহামারিটি ইতোমধ্যেই তৃতীয় পর্যায়ে উপনীত হয়ে গেছে।
মহামারিটির বিস্তারের ধরণটি প্রকাশ করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু এক থেকে ছয়টি পর্যায় বা ধাপের কথা বলেছে। তৃতীয় পর্যায় মানে কিছু কিছু পরিস্থিতিতে মানুষ থেকে মানুষে সীমিত সংক্রমণ ঘটছে।
এটাকে সাদামাটা শোনাতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেশটি চতুর্থ পর্যায়ের মাত্র একটি পর্যায় পেছনে আছে। চতুর্থ পর্যায় মানে মানুষ থেকে মানুষে ব্যাপকভাবে ছড়াচ্ছে এবং সমাজে রোগটির ছড়াছড়ির সৃষ্টি হয়েছে। আর এর অর্থ হলো, সঙ্কটটি নিয়ন্ত্রণ-অযোগ্য হয়ে পড়েছে। আর পঞ্চম ও ষষ্ট পর্যায়ের অর্থ হলো দেশের সীমানা ছাড়িয়ে রোগটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে যাওয়া।
এমন অবস্থায় প্র্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত ২২ মার্চের ‘জনতা কারফিউ’ বিবেচিত হতে পারে বর্তমান ‘সামাজিক দূরত্বকরণের’ মহড়া এবং চতুর্থ পর্যায়ের আগমন বিলম্বিত করা তথা অনিবার্য লকডাউন (অবরুদ্ধ করা) আরেকটু পিছিয়ে দেয়া।
সহজভাবে বলা যায়, ‘সেল্ফ আইসোলেশন’-এর অর্থ হলো, নিজের বাড়িতে থাকা এবং যতটা সম্ভব অন্য লোকের স্পর্শ এড়ানো। এতে করে সামাজিক দূরত্বকরণ সৃষ্টির মাধ্যমে ভাইরাসটির বিস্তার হ্রাস পাবে। স্কুল বন্ধ করে দেয়া, বাড়ি থেকে কাজ করতে কর্মীদের উৎসাহিত করা, জনসমাবেশ হ্রাস করা ইত্যাদি আসলে নগরগুলো এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পুরো দেশকে লকডাউন করারই প্রক্রিয়া। ইতালি ও ফ্রান্সে এমনটিই ঘটেছে।
ফলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার আগে দিল্লিতে এই গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে তিনি লকডাউনের ঘোষণাই দিতে যাচ্ছেন। কিন্তু তিনি তা দেননি এবং ১৪ ঘণ্টার একটি মিনি লকডাউনের কথা বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার একটি হতাশাজনক বিষয় হলো, তিনি সঙ্ঘবদ্ধ ও ঘুরে দাঁড়ানোর আবেদন জানানোর জন্য জনগণের শুভবুদ্ধর প্রতি আবেদন জানালেও সরকারের অসহায় অবস্থাও প্রকাশ করে ফেলেছেন।
তিনি দৃশ্যত এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন : সরকার আপনার জন্য কী করবে, সে প্রশ্নটি করবেন না, আপনি নিজের জন্য কী করতে পারেন, তা জিজ্ঞাসা করুন। একমাত্র যে আশ্বাসটি পাওয়া গেছে তা হলো সরকার অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা চালু রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী জনসাধারণের সহানুভূতির প্রতি আবেদন জানিয়ে এই কঠিন সময়ে গরিব মানুষের প্রতি দয়া প্রদর্শনের তাগিদ দিয়েছেন। কারণ এই পর্যায়ে তাদের পুরো জীবিকাই শেষ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তাকে কাজ হবে না।
ইতোমধ্যেই অনেক ঘটনায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের ‘বাহত’ হতে পারে সন্দেহে ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণির’ অনেক পরিবার তাদের গৃহকর্মীদের চাকরিচ্যুত করেছে।
ফলে যাদের ওপর সবচেয়ে কঠিনভাবে আঘাত আসতে যাচ্ছে ওইসব গরিব লোকদের জন্য সরকার কেন কিছু আর্থিক সহায়তার কথা ঘোষণা করল না?
প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার আগে কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন গরিবদের জন্য একটি কল্যাণমূলক পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে ৫৫ লাখ লোকের জন্য ২৪ শ’ রুপি করে বরাদ্দ করা, গরিব মানুষের জন্য ২০ রুপিতে এক বেলার খাবারের জন্য এক হাজার খাবারের স্টল স্থাপন, আগামী দুই বছরের জন্য মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এম্প্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিমের আওতায় দুই হাজার কোটি রুপি বরাদ্দ, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ঋণ প্রদানের জন্য দুই হাজার কোটি রুপি বরাদ্দ।
খুবই সীমিত আর্থিক সম্পদের অধিকারী কেরালার মতো একটি রাজ্য যদি এসব দিকে নজর দিকে পারে, তবে কেন্দ্রীয় সরকার অবশ্যই আরো বেশি কিছু করতে পারে।
সর্বোপরি আগামী কয়েক মাসের জন্য স্বাস্থ্য পরিচর্যা খাতে সরকার কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চাচ্ছে, সেটাও বলা উচিত ছিল।
লক্ষ্মীনারায়নের মতে, ২০-৬০ ভাগ লোক আক্রান্ত হওয়ার অর্থ হলো ২৬ থেকে ৭৮ কোটি লোক আক্রান্ত হওয়া।
ভয়াবহ সঙ্কটজনক অবস্থা। এ ধরনের মরীচিকায় আশা রাখতে পারি না যে ভারতীয় গ্রীস্মে শেষ পর্যন্ত এই ক্ষতিকর ভাইরাসটিকে শেষ করে ফেলবে। ইতোমধ্যেই জানা গেছে যে করোনাভাইরাস বদলে যাচ্ছে।
এ কারণেই লক্ষ্মীনারায়ন মনে করছেন যে ৪০ থেকে ৮০ লাখ লোকের আইসিইউ চিকিৎসার প্রয়োজন হবে। ভারতের জরুরি ভিত্তিতে আইসিইউ সরঞ্জাম ও অন্যান্য অত্যাবশকীয় ওষুধ আমদানি করা উচিত।
এখন আমাদের প্রয়োজন একটি কৌশলের, ও একটি বৈজ্ঞানিক মানসিকতার যেটা করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন প্রয়োগ করেছে।
ইন্ডিয়ান পাঞ্চলাইন