অর্থনৈতিক ব্যর্থতার কারণে ভারতে এই দাঙ্গা!

নরেন্দ্র মোদি - সংগৃহীত
নয়া দিল্লির সাম্প্রতিক দাঙ্গায় প্রায় ৫০ জন নিহত ও প্রায় ৩০০ জন আহত হওয়ার ঘটনাটি মুসলিমদের ওপর তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি প্রভাব ফেলেছে। ওই ঘটনার পর দুই হাজারের বেশি মুসলিম বাস্তুচ্যুত হয়ে আছে। কারণ তাদের বাড়িঘর, ব্যবসা ও আশপাশের এলাকা পুড়িয়ে দিয়েছে হিন্দু দাঙ্গাবাজেরা। সব নজর নিবদ্ধ হিন্দু ডানপন্থীদের ক্রমবর্ধমান হারে অসহিষ্ণু ও জাতীয়তাবাদী ভাষ্য ও মোদি সরকারের নিস্ক্রিয়তার ওপর নিবদ্ধ। তবে মুসলিম লোকজনের ওপর সাম্প্রতিক হামলার মূলে রয়েছে ভারতীয় অর্থনীতির মন্থরতা।
ভারতের অর্থনৈতিক ত্রাণকর্তা হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিছুই করতে পারেননি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়া গত কোয়ার্টারে ভারতের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪.৭ ভাগ, যা সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। কিন্তু এই খারাপ অবস্থা বৈশ্বিক স্থবিরতা বা করোনাভাইরাসের আতঙ্কে হয়নি। ওই পর্যায়ে এ দুটির আত্মপ্রকাশই ঘটেনি। প্রবৃদ্ধিতে মন্থরতা কারণ কাঠামোগত ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিবন্ধকতা। ভঅরত ১৯৯০-এর দশক থেকে কখনো বাণিজ্য ও শিল্প লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে উদারিকরণের ওপর নির্মিত হতে পারেনি। নোট বাতিলকরণ ও ব্যয়বহুল গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্সের (জিএসটি) মতো মোদির সাম্প্রতিক ভুলগুলোর কারণে অর্থনীতি মারাত্মক সমস্যায় পড়েছে।
গত বছর ভারতের ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিসের জরিপের ফলাফল সরকার প্রকাশ করেনি। কারণ এতে দেখা যায় যে ২০১৭-১৮ সময়কালে সার্বিক বেকারত্বের হার ৬.১ ভাগ, যা ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ফাঁস হওয়া নথিতে অনেক আতঙ্কমূলক তথ্য দেখা যায় : শহরের তরুণদের (১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে) বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ১৮.৭ ভাগে, গ্রামের একই বয়সীদের মধ্যে ১৭.৪ ভাগ। তরুণীদের (১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে) বেকারত্ব ২৭.২ ভাগ। শ্রমিক সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনার মধ্যেই এমনটা ঘটেছে। ধারণা করা হয়, ২০১১-১২ সময়কালে যেখানে শ্রমিক শক্তি ছিল ৫৫.৯ ভাগ, ২০১৭-১৮ সময়কালে হয়েছে ৪৯.৮ ভাগ। আর সেন্টার ফর মনিটরিংয়ের তথ্য মতে ভারতে বর্তমান বেকারত্বের হার ৮ ভাগ।
ভারতের ১.৩৫ বিলিয়ন লোকের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বয়স ১৫-২৪ বছর। ফলে ভারত হলো বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী লোকের আবাসভূমি। ইন্টারনেটের কল্যাণে তরুণ ভারতীয়দের মধ্যে রয়েছে বৈশ্বিক আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু চাকরির সুযোগ কম থাকায় তারা ওইসব স্বপ্ন পূরণ করতে পারে না। ভারতে প্রতি বছর নতুন চাকরিপ্রার্থী যোগ হয় ১০-১২ মিলিয়ন। একইসংখ্যক চাকরি যোগ করা না হলে ভবিষ্যতে চাকরির সুযোগ আরো কমে যাবে। তরুণদের, বিশেষ করে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের জন্য এটি তাদের সামাজিক অবস্থানের প্রতি সত্যিকারের হুমকি। এসব বেকার ও ছদ্মবেকার তরুণ হিন্দু গোরক্ষকদের মতো সংগঠনে যোগ দিচ্ছে সামাজিক উদ্দেশ্য সাধন ও মর্যাদা পাওয়ার জন্য। তারা হলো আরো বড় জাতিভিত্তিক ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও শ্রেষ্ঠত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) চেয়ে অতি প্রান্তিক গ্রুপ।
ড্রিমার্স নামের বইতে স্নিগ্ধা পুনম যেসব গোরক্ষকদের সাক্ষাতকার নিয়েছেন, তাতে তারা গর্বভরে স্বীকার করেছেন যে সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার ও প্রহারের ঘটনায় (তাদের কাছে গরুর গোশত থাকার সন্দেহে) তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের মর্যাদা বাড়ে। মোদি এ ধরনের গোরক্ষক ও সঙ্ঘ সদস্যদের টুইটারে ফলো করেন, তাদের সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান জ্ঞাপন করেন। এমনকি দিল্লিতে সাম্প্রতিক সহিংসতার আগেও গোরক্ষকেরা মুসলিমদের প্রহার করার ঘটনা ঘটেছে।
১৯৯১ সাল থেকে উদারিকরণের ফলে ২৭০ মিলিয়ন ভারতীয় দারিদ্র থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে তাদের সার্বিক অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে। কিন্তু শহরের উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই এর বেশিরভাগ পেয়েছে। ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে এসেছে, বেকারত্ব বেড়েছে, তরুণ উচ্চবর্ণের হিন্দুরা তাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সুযোগ পাচ্ছে না। ভারতের প্রবৃদ্ধি ও বেকারত্বের হারে উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত গোরক্ষক ও সঙ্ঘ পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা ভাষ্য ও রাজনীতিতে বৃহত্তর পরিবর্তনের পথ দেখাতে পারে। ২০১৪ সালে মোদির নির্বাচনী স্লোগান ছিল ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ।‘ এর সরল অনুবাদ করা যায় এভাবে যে সবার উন্নয়নের জন্য প্রত্যেকের সমর্থন লাভ। কিন্তু নোট বাতিলকরণ ও জিএসটি বাস্তবায়নের পর সৃষ্ট বিপর্যয়কর পরিস্থিতি এবং সার্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর মোদি আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলছেন না।
এর বদলে তিনি ২০১৯ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় আরো আগ্রাসীভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথা বলেন, কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করেছেন, বিরোধপূর্ণ অযোধ্যায় একটি হিন্দু মন্দির নির্মাণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ২০১৪ সালে যেখানে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি (যা বাস্তবায়িত হয়নি) দিয়েছেন, সেখানে ২০১৯ সালে উদ্দীপনায় হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভিত্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। হিন্দুদের খুশি করার জন্য প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলো থেকে মুসলিমদের বাদ দিয়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন করেছেন, সারা দেশে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
মোদি অর্থনৈতিক হতাশাজনক কাজের ফলে বৃহত্তর ভোটারমণ্ডলীর কাছ থেকে সমর্থন পাবেন না বুঝতে পেরে তার মূল হিন্দু ঘাঁটি রক্ষার দিকে জোর নজর দিয়েছেন। একইসাথে বিশাল তরুণ শ্রম জনসংখ্যার যে সুবিধা ছিল সেটিকে অর্থনৈতিক মন্থরতার সময়ে সাম্প্রদায়িক দুঃস্বপ্নে পরিণত করা হয়েছে।
দি ডিপ্লোম্যাট