বিপদে সৌদি অর্থনীতি!
বিপদে সৌদি অর্থনীতি! - ছবি : সংগ্রহ
সৌদি আরব মারাত্মক বাজেট ঘাটতি নিয়ে সমস্যায় পড়েছে। তেলের এই হ্রাসকৃত মূল্য আঘাত দেশটির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বিশাল হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে ঘোষিত বাজেট অনুযায়ী, সৌদি আরবের ২০২০ অর্থবছরের মোট বাজেট বরাদ্দ ১.০২ ট্রিলিয়ন রিয়াল (২৭২ বিলিয়ন ডলার)। এটি ২০১৯ অর্থবছরের বাজেটের ১.০৪৮ বিলিয়ন রিয়ালের (২৭৯.৫ বিলিয়ন ডলার) তুলনায় কম। ২০১৯-এর জন্য রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার পরিমাণ ৯১৭ বিলিয়ন রিয়াল (২৪৪.৫ বিলিয়ন ডলার) থাকলেও ২০২০ সালের বাজেটে এটি ৮৩৩ বিলিয়ন রিয়াল (২২২.১ বিলিয়ন ডলার) নির্ধারণ করা হয়েছে। বাস্তবে তা আরো নিচে নেমে যাবে।
পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০১২ সালে সৌদি বাজেটের ঘাটতি ছিল ৩৫ বিলিয়ন ডলার, আর ২০২০ সালের জন্য এটি প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫০ বিলিয়ন ডলারে। তেলের দামের সাম্প্রতিক তীব্র অবনয়নে সৌদি বাজেটের ঘাটতি প্রাক্কলিত অঙ্কের চেয়ে আরো বেশি হবে। এটি দেশের অবনতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ।
দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক এই ঘটনাগুলোতে আরো প্রকাশ পেয়েছে, বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে সৌদি আরবের আর আগের নিয়ন্ত্রক প্রভাব থাকছে না। প্রকৃতপক্ষে গত বছর ওপেক থেকে বিতর্কিতভাবে কাতারকে বিদায় করার পর এই সংস্থার জ্বালানিসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সৌদিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে এসেছে।
কিন্তু সম্প্রতি তেলের দাম কমে যাওয়া ঠেকাতে উৎপাদন কমানোর সৌদি প্রস্তাব রাশিয়ার বিরোধিতার কারণে কার্যকর করা যায়নি। অতীতে সৌদি আরব তেল সরবরাহ কঠোরভাবে হ্রাস বৃদ্ধি করে তেলের দামের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখত। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াসহ বড় উৎপাদকরা বাজারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এবং সৌদি আরবের সাম্প্রতিক ব্যয়বহুল বৈদেশিক নীতিতে সে দু’টি দেশই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ায় রাজস্ব হ্রাসের ঝুঁকি নিয়ে তেলের উৎপাদন কমানোর কৌশল বাস্তবায়ন সৌদির জন্য অসম্ভব করে তুলেছে।
এখনকার বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের কাঠামোটি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, সৌদিদের দ্বারা তেলের সম্ভাব্য উৎপাদন হ্রাস যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মতো বৃহত্তম উৎপাদকদের কেবল বাজারে তেলের সরবরাহ বাড়াবে তাই নয়; অধিকন্তু এর পরিণতিতে তারা সৌদিদের জ্বালানির মার্কেট শেয়ারও দখল করে নেবে। গত সপ্তাহান্তে ওপেকের পক্ষ থেকে তেলের উৎপাদন কমানোর দাবি প্রত্যাখ্যানের পরে, রিয়াদ প্রশাসন শেষ পর্যন্ত বিশ্ব তেল বাজারে তার শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীদের ক্ষতি করার নীতি বেছে নিয়ে তেল উৎপাদন আরো বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তৃতীয়ত করোনাভাইরাসের হুমকির কারণে পবিত্র ওমরাহ স্থগিত করা এবং সতর্কতামূলকভাবে মসজিদ আল হারাম ও মসজিদ আন নববী অস্থায়ী বন্ধ হওয়ায় দেশটির বার্ষিক হজ ও ওমরাহ রাজস্ব বাবদ ২৫ থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হচ্ছে, যা অর্থনৈতিক মন্দাকে আরো গভীর করে তুলছে।
হজ ও ওমরাহ পর্যটন দুর্বল হওয়ার আরেকটি পরিণতি হলো, সৌদি আরবের শাসকদের খাদেম আল হারামায়েন আশ শরিফায়েন (দু’টি পবিত্র স্থানের সেবক) হিসেবে বহু বছর ধরে তাদের রাজনৈতিক বৈধতা লাভ এবং ইসলামী বিশ্বে নেতৃত্বের দাবির যে ভিত্তি ছিল, তা দুর্বল হয়ে পড়া। এটি দেশটির অভ্যন্তরে শাসকদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে। একই সাথে ইসলামী বিশ্বে সৌদিদের সুনামও ক্ষুণ্ন করতে পারে।
এমবিএসের উদ্যোগে শুরু হওয়া ইয়েমেন যুদ্ধ, সাংবাদিক খাশোগি হত্যার মাধ্যমে সৌদিদের আন্তর্জাতিক সুনামের ক্ষতি, বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে সৃষ্ট বাধায় সৌদি অর্থনীতির পশ্চাৎপদতা, মধ্যপন্থী ইসলামের নামে সৌদি আলেমদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, বিতর্কিত বিনোদন খাতের পুনরুজ্জীবন এবং রাজপরিবারের শক্তিশালী সদস্যদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান সৌদি আরবকে এক গভীর খাদে ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে।
তুর্কি অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. নেমমেতিন আকারের বিশ্লেষণটি এ ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে, এমবিএস প্রশাসনের ব্যর্থতা সৃষ্ট ক্ষোভ দেশের রাজনীতিকে ভিন্নমুখী করার কাজ সহজ করে তুলতে পারে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে দেখা যায়, এমবিএস এবং তার প্রশাসনবিরোধী ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ তিনি গভীরভাবে অনুভব করছেন। রাজপরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আজিজের ছেলে আহমদ বিন আবদুল আজিজকে গ্রেফতার করার ঘটনায় সেটিই মনে হয়। আর এটিও মনে হয় যে, তিনি যে পথে এর আগে এগিয়েছেন সেই জবরদস্তির পথে অগ্রসর হওয়া ছাড়া তার সামনে বিকল্প নেই। এ বিষয়টি অন্য কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব।
mrkmmb@gmail.com