করোনাভাইরাস ভয়াবহ জীবাণু অস্ত্র!
করোনাভাইরাস ভয়াবহ জীবাণু অস্ত্র! - ছবি : সংগ্রহ
তুমুল আলোচনা চলছে কোভিড-১৯ নামে পরিচিত করোনাভাইরাস নিয়ে। সারা বিশ্বে এখন এ নিয়েই আলোচনা। আতঙ্ক তো অবশ্যই আছে। এর মধ্যেই ষড়যন্ত্র তত্ত্বও সামনে আসছে। প্রশ্ন-উত্তরের আলোকে এসব প্রশ্নর জবাব দিয়েছেন ভারতের
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন ইউনিটের প্রধান ডাঃ সুগত দাশগুপ্ত।
• নোভেল করোনা কি জীবাণু অস্ত্র?
•• বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়তেই বিভিন্ন মহলে ছড়াতে শুরু করেছে আতঙ্ক। কেউ কেউ হয়তো মনে করছেন সাম্প্রতিক নোভেল করোনা ভাইরাস আসলে একধরনের জীবাণু অস্ত্র এবং তা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে! অথচ সত্যিটা হলো নোভেল করোনা ভাইরাসকে জীবাণু অস্ত্র ভাবার কোনো কারণ নেই। এখনও পর্যন্ত করোনার বিরুদ্ধে এইরকম কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কোভিড-১৯ একটি বিশ্বব্যাপী মহামারী। একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সেভাবেই এর মোকাবিলা সারা পৃথিবী করছে।
• জীবাণু অস্ত্র তাহলে কী?
•• ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া হলো এক ধরনের অণুজীব। এই ধরনের অণুজীব দ্বারা তৈরি হয় বায়োলজিক্যাল উইপেন বা জীবাণু অস্ত্র। উদাহরণ হিসেবে অ্যানথ্রাক্স, বটুলিনিয়াম টক্সিন, প্লেগের মতো জৈবিক উপাদানের কথা বলা যায়। কোনও রাষ্ট্র বা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী দ্বারা পরীক্ষাগারে এই ধরনের জীবাণু প্রস্তুত করে অন্য কোনো রাষ্ট্রে নিয়ন্ত্রিতভাবে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছড়িয়ে দিলে তখন বলা যায় জীবাণু অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, যে পক্ষ জীবাণু ছড়াচ্ছে, তারা কিন্তু এই জীবাণু অস্ত্রের দ্বারা বহুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। শত্রুপক্ষ জীবাণুর ক্ষতিকর প্রভাবে ভোগে। ক্ষতিকর অণুজীবগুলো খুব কম সময়ের মধ্যে উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহে ছড়িয়ে যায়, বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি করে ও দ্রুত জীবটির মৃত্যু ঘটায়।
• জীবাণু অস্ত্র ব্যবহারের নজিরগুলি সম্পর্কে যদি বলেন?
•• আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল-এর পক্ষ থেকে জীবাণু অস্ত্রের ভয়াবহতার উপর ভিত্তি করে মোট তিনটি শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গেই জানিয়ে রাখি, খোদ আমেরিকার বিরুদ্ধেই কিন্তু বেশ কয়েকবার জীবাণু অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে! এবার দেখে নেয়া যাক জীবাণু অস্ত্রের শ্রেণীবিভাগ এবং সেগুলো ব্যবহারের নজির।
বিভাগ-ক (জনস্বাস্থ্যের প্রবল ক্ষতি)
১) অ্যানথ্রাক্স রোগ। রোগের কারণ ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস (ব্যাকটেরিয়া)। এই জীবাণু অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়েছিল প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। এছাড়া জানা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালে, জাপান ১৯৯৫ সালে ও আমেরিকা ২০০১ সালে এই জীবাণুর অপব্যবহার করে।
২) বটুলিজম অসুখ। রোগের কারণ ক্লসট্রিডিয়াম বটুলিনাম টক্সিন ব্যাকটেরিয়া। শোনা যায় বিশ্বযুদ্ধগুলিতে ছাড়াও পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপান ও আমেরিকা এই ব্যাকটেরিয়ার ব্যবহার করেছিল।
৩) হেমোরেজিক ফিভার (অসুখ)। মারবার্গ, ইবোলা, অ্যারেনা ভাইরাস। সোভিয়েত ইউনিয়ন জৈব অস্ত্র হিসেবে এই ভাইরাসের ব্যবহার করেছিল বলে সন্দেহ করা হয়।
৪) প্লেগ রোগ। অসুখের কারণ ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস ব্যাকটেরিয়া। চতুর্দশ শতকে ইউরোপে প্রকোপ দেখা যায়। এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এই ব্যাকটেরিয়ার ব্যবহার হয়েছিল বলে সন্দেহ।
৫) স্মল পক্স অসুখ। রোগের কারণ ভ্যারিওলা ভাইরাস। উত্তর আমেরিকায় অষ্টাদশ শতকে এই ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল।
৬) টুলারেমিয়া অসুখ। রোগের কারণ ফ্রান্সিসেলা টুলারেনসিস ব্যাকটেরিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই ব্যাকটেরিয়ার ব্যবহার করা হয়েছিল।
বিভাগ-খ (জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি)
১) ব্রুসেলোসিস অসুখ। কারণ ব্রুসেলা ব্যাকটেরিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল।
২) কলেরা। কারণ ভিব্রিও কলেরি ব্যাকটেরিয়া। ব্যবহার হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।
৩) এনকেফেলাইটিস। রোগের কারণ আলফা ভাইরাস। ব্যবহার হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।
৪) ফুড পয়েজনিং। সালমোনেলা, শিগেলা ব্যাকটেরিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ৯০-এর দশকে শীতল যুদ্ধে আমেরিকা এই ব্যাকটেরিয়ার ব্যবহার করে বলে সন্দেহ।
৫) গ্ল্যান্ডার্স। বারখলডেরিয়া ম্যালেই ব্যাকটেরিয়া। ব্যবহার করা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে।
৬) সিটাকসিস অসুখ। ক্ল্যামাইডিয়া সিটাকি ব্যাকটেরিয়া। ব্যবহার করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।
৭) কিউ ফিভার । কক্সিয়েল্লা বারনেটি ব্যাকটেরিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
৮) টাইফাস রোগ। রিকেটসিয়া প্রাওয়াজেকি(রিকেটশিয়া)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার হয়েছিল।
বিভাগ-গ
(নতুন জীবাণু যাদের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দ্বারা বেশি ক্ষতিকারক করে তোলা হয়)
হান্টা ভাইরাস, নিপা ভাইরাস, টিক্-বর্ন এনকেফেলাইটিস ভাইরাস, হেমারেজিক ফিভার ভাইরাস, ইয়েলো ফিভার ভাইরাসগুলো এবং বিভিন্ন মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া।
• জৈব অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেই?
•• প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জীবাণু অস্ত্রের ব্যবহারের ভয়াবহতা কাঁপিয়ে দিয়েছিল সমগ্র বিশ্বকে। লাখ লাখ মানুষ এবং সৈনিকের অকাল মৃত্যুর কারণে জীবাণু অস্ত্রের ব্যবহারকারী রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভ বাড়ছিল ক্রমশ। আন্তর্জাতিক নানা মহলের চাপে শেষ পর্যন্ত ১৯২৫ সালে স্বাক্ষরিত হয় জেনেভা চুক্তি। এই চুক্তি অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বজুড়েই জীবাণু অস্ত্র ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়। তবে জেনেভা চুক্তিতে জীবাণু .নিয়ে গবেষণা স্তব্ধ করার কথা বলা হয়নি। তাই বিভিন্ন দেশ যেমন ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ইতালি, কানাডা, বেলজিয়াম, পোলান্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন (অধুনা রাশিয়া) জীবাণু নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকে। মনে রাখতে হবে, ১৯২৫ সালের জেনেভা চুক্তিতে আমেরিকা কিন্তু সই করেনি। বরং জীবাণু গবেষণাকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় তারা। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধলে ফের জীবাণু অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। পুনরায় সংগঠিত হয় প্রতিবাদ চিকিৎসাশাস্ত্রের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে। জেনেভা চুক্তির অর্ধশতক পর, অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে আয়োজিত হয় বায়োলজিক্যাল উইপেনস কনভেনশন (বিডব্লিউসি)। সেখানে সমস্তরকমের জীবাণু অস্ত্র তৈরি ও মজুত রাখা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আগে থেকে মজুত করা সমস্ত জীবাণু বা জৈব অস্ত্র ধ্বংস করার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়। আমেরিকাও শেষ পর্যন্ত এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
মনে রাখতে হবে, ১৯৭৫ সালের বিডব্লিউসি ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি যেখানে শুধুমাত্র রোগ প্রতিরোধ, রোগ নির্ণয় বা রোগ নিরাময়ের জন্য জীবাণু বা জৈব পদার্থের ব্যবহার বাদ দিয়ে সমস্ত রকম হানিকর জীবাণু অস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭৫-এর পর থেকে প্রতি ৫ বছর এই নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। এখনো এই কাজ চলছে।
২০১৫ অবধি ১৭৩টি দেশ এই চুক্তির আওতাধীন হয়েছে। তবে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, জেনেভা চুক্তি বা বিডব্লিউসি— কোনো চুক্তিতেই জীবাণু নিয়ে গবেষণা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি।
এই প্রসঙ্গেই বলে রাখি, ২০০১ সালে ‘আমেরিকার অ্যানথ্রাক্স লেটারস’ বা ‘অ্যানথ্রাক্স পত্র’ র ঘটনার পরে গত কুড়ি বছরে সারা পৃথিবীতেই কোনও প্রমাণিত জীবাণু-অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনা ঘটেনি।
• জীবাণু নিয়ে গবেষণা চলছে মানে, বেশ কিছু দেশের কাছে ভয়ঙ্কর জীবাণু রয়েই গেছে?
•• উন্নত বেশ কিছু দেশে মারাত্মক ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থাযুক্ত পরীক্ষাগারে জীবাণু নিয়ে গবেষণা চলতেই পারে। কোন ধরনের জীবাণু আছে তা বলা সম্ভব নয়।
জীবাণু নিয়ে গবেষণা মূলত তিনটি কারণে করা হয়—
ক) জীবাণু সংক্রমণের দ্বারা হওয়া ব্যাধির উন্নততর নির্ণয়পদ্ধতি আবিষ্কার।
খ) রোগ প্রতিরোধের জন্য উন্নততর ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক আবিষ্কার।
গ) রোগ নিরাময়ের উন্নততর ওষুধ আবিষ্কার।
এবার খেয়াল করে দেখুন, বহু জটিল রোগের জন্ম দেয়া ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো ওষুধ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আজকের কোভিড-১৯ এবং ডেঙ্গু। এমনকী এর আগে অন্য ধরনের করোনা ভাইরাস দ্বারা হওয়া সার্স বা মার্স-এর কোনো অব্যর্থ ওষুধ তৈরি হল না। এমনকী প্রতিষেধকও তৈরি হলো না।
এই প্রসঙ্গেই একটা কথা বলা দরকার— শুধু জীবাণু অস্ত্র নিয়েই আমরা এতক্ষণ কথা বলছি। অথচ খেয়াল করে দেখুন, সচেতনতার অভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে নিঃশব্দে, বহু ব্যাকটেরিয়া ভোল বদল করে ফেলছে।
আজকের ক্রিটিক্যাল কেয়ার চিকিৎসার একটি বড় সমস্যা হলো, বিভিন্ন মারণ ব্যাকটেরিয়ার চরিত্রে রদবদল এবং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়া। ফলে চেনাজানা বহু ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে উন্নত সব অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করছে না! বহু ওষুধে কাজ না হওয়া ব্যাকটেরিয়াদের বলা হয় মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া। এই সব সংক্রমণ মারাত্মক। কারণ চিকিৎসক হিসেবে মোকাবিলা করার মতো পর্যাপ্ত রকমের ওষুধ আমাদের হাতে থাকে না। এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া পরিবেশে ছড়িয়ে পড়লে কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। তাই গবেষণা থমকে দেয়ার ফল মারাত্মক হতে পারে।