রঞ্জন গগৈ চমক!
রঞ্জন গগৈ - সংগৃহীত
এটি বিচারপতি রঞ্জন গগৈকে নিয়ে লেখা কোনো প্রবন্ধ নয়।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টে নেতৃত্ব দেয়া উজ্জ্বল বিচারপতিদের একজন হিসেবে তিনি সম্ভবত প্রথমেই আমি যে উদ্বেগের কথা বলছি, তার সাথে একমত হবেন। গত সাত দশক ধরে দায়িত্বশীল নেতা, বিচারক ও সরকার যে সুনাম তৈরী করেছিল, এটি সেই প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষয় নিয়ে।
আমাদের পরিচালনাব্যবস্থা কাজ করে, কারণ এটি ক্ষমতার আলাদাকরণের মতাবাদের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। ফলে বিচার বিভাগ ও রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের মধ্যে এই বিভক্তির অলঙ্ঘনীয়তার কথা সুপ্রিম কোর্ট বারবার বলেছে। ফলে এটি আমাদের সংবিধানের অপরিবর্তনীয় প্রকৃতির অংশে পরিণত হয়েছে।
আমাদের বিচার বিভাগ কাজ করে বাস্তবতা ও প্রামাণ্য অবস্থার চেয়ে আস্থা, বিশ্বাস ও উপলব্ধির আলোকে। রাজ্যসভায় বিচারপতি গগৈয়ের মনোনয়ে এই স্তম্ভগুলোর প্রতিটির মূলকেই নাড়া দিয়েছে। ব্যক্তির মেধা-নির্বিশেষে এ ধরনের নিয়োগ নিরপেক্ষ বা পক্ষপাতিত্ব- যেভাবেই হোক না কেন, বিচার বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট ও ভারতের সর্বশেষ প্রধান বিচারপতির স্বাধীনতার ওপর একটি প্রশ্নের সৃষ্টি করবে। বিচার বিভাগ যে পরিষ্কারভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, এই ধারণাই ক্রমাগত বেশি করে উপলব্ধি করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে সরকারের কাছে উদাহরণ থাকতে পারে। তবে নিশ্চিতভাবেই তা হবে বিভ্রান্তিকর। বর্তমান পরিস্থিতির সাথে অতীতের ওই নজির কোনোভাবেই খাপ খায় না। বিচারপতি হিদায়াতুল্লাহকে উপ-রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়েছিল প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯ বছর পর। আর বিচারপতি রঙ্গনাথ মিশ্রকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তার অবসরগ্রহণের ৬ বছর পর। বিচারপতি বাহরাউল ইসলাম সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ লাভের আগে কয়েক বছর রাজ্যসভায় ছিলেন। বিচারপতি সুব্বা রাও রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করেছিলেন (তিনি জাকির হোসাইনের কাছে হেরে গিয়েছিলেন)। কিন্তু ওই সময় তার এই কাজের তীব্র সমালোচনা হয়েছিল।
প্রথম দুটি উদাহরণের ক্ষেত্রে অভিন্নতা কী আছে? তাদের রাজ্যসভায় নিয়োগ লাভ ও তাদের অবসর গ্রহণের মধ্যে সময়ের অনেক ব্যবধান ছিল। ফলে কোনো অভিযোগ বা সন্দেহের সৃষ্টি হয়নি।
বর্তমান নিয়োগ হয়েছে তাৎক্ষণিক ও তাড়াহুড়া করে। বিচারপতি গগৈয়ের অবসর গ্রহণের মাত্র চার মাস পর। ফলে প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়াই স্বাভাবিক। এই মেয়াদে অনেক কিছুই খতিয়ে দেখার অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে। এই মেয়াদেই সিলগালা করা খাম বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। খামের ভেতর কী ছিল, তা কেবল সরকারই জানে। এই সময় অনেকবারই নির্বাহী বিভাগের অনুকূলে বারবার ও তাৎপর্যপূর্ণ রায় হওয়ার ঘটনা দেখা গেছে। ফলে লোকজন যদি সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন করে, তবে কেবল তাদেরই দোষারোপ করা যাবে।
বিজেপি তাদের উত্থাপিত একটি সতর্কবার্তার কথাও স্মরণ করতে পারে। অরুন জেটলি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন যে অবসর-পূর্ব রায়গুলো অবসর-পরবর্তী চাকরির আকঙ্ক্ষায় প্রভাবিত। বর্তমানের চেয়ে এসব কথা আর কখনো প্রাসঙ্গিক ছিল না।
আইনে আরেকটি উদ্ধৃতি প্রায়ই দেয়া হয় : সিজারের স্ত্রীর মতো বিচারপতিরাও নিশ্চিতভাবেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে। কিন্তু এই নিয়োগের ফলে কোনো সন্দেহ সৃষ্টি হবে না, তা কী আসলেই বলা যাবে?
কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ করার আগে তাকে নিয়ে সৃষ্ট সব সন্দেহের অবকাশ থেকে মুক্ত রাখার জন্য একটা সময় অতিবাহিত করা দরকার। স্পর্শকাতর অবস্থান থেকে অবসরগ্রহণকারী কর্মকর্তাদেরকে একটি মেয়াদ পর্যন্ত অন্য কোনো নিয়োগ গ্রহণ থেকে বিরত রাখা হয়। সাধারণত এই সময়টি হয় দুই বছর। আগের ক্ষমতাসীন সরকারের সাথে এই নিয়োগের কোনো সম্পর্ক যাতে না থাকতে পারে, সেজন্যই এমনটা করা হয়।
সাম্প্রতিক এক প্রবন্ধে আমি লিখেছিলাম যে আমাদের আদালতগুলোর অবস্থা ভালো নয়। এখানে কঠিন প্রশ্নগুলো মূলতবি রেখে বা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। আর এখন বলা যায়, সুপ্রিম কোর্ট গত কয়েক বছরে সরকারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অনীহা প্রদর্শন করেছে। অতি প্রয়োজনের সময় আদালতগুলোর মধ্যে সরকারকে দীর্ঘ সময় ফুসরত দেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অথচ অতীতে সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে সংযত রাখতে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসত। আমার ভয় হচ্ছে, বিচার বিভাগ তার স্বাধীনতা হারিয়েছে এবং নির্বাহী ও আইনসভার মধ্যে ভারসাম্য বিধানের জন্য যে নির্ভীকতার প্রয়োজন ছিল, তা খুইয়েছে।
মনে হচ্ছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, পক্ষপাতহীনতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়। মনে হচ্ছে, আইন, নীতি, নৈতিকতা ইত্যাদি সবকিছুই নির্ভর করছে বিজেপির ক্ষমতায় থাকা বা না থাকার ওপর। এই মনোনয়নে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের সবচেয়ে প্রাণবন্ত ও গতিশীল প্রাতিষ্ঠানিক স্তম্ভ তথা বিচার বিভাগের ওপর বিরাট ক্ষতি হলো।
হিন্দুস্তান টাইমস