ভাইরাসে লণ্ডভণ্ড
ভাইরাসে লণ্ডভণ্ড - ছবি : সংগ্রহ
কিছু দিন আগেও আমরা অনেকে ভাইরাস শব্দটাও শুনিনি। কিন্তু এখন সেটা শুনতে পাচ্ছি বিশেষভাবে। ভাইরাস আমাদের দেহে প্রবিষ্ট হয়ে বহুপ্রকার রোগ উৎপাদন করে। কারণ তারা আমাদের দেহকোষকে বাধ্য করে ভাইরাস উৎপাদনে। আমাদের দেহকোষের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে ভাইরাসের আক্রমণে বদলে যায় বিশেষভাবে।
যাকে বলা হচ্ছে করোনাভাইরাস, তাকে শ্রেণিবদ্ধ করা হয় সাধারণ সর্দি রোগ উৎপাদক ভাইরাসের সাথে। সাধারণ সর্দি রোগ উৎপন্ন হয় প্রায় ষাট রকম বা ষাট প্রকার সর্দি রোগের ভাইরাসের জন্য। যাকে বলা হচ্ছে করোনাভাইরাস, যার প্রভাবে উদ্ভব হচ্ছে করোনিয়া নিউমোনিয়া, তা আগে ছিল না। রোগটার উদ্ভব হয়েছে হঠাৎ করেই। মনে করা হচ্ছে এই রোগজীবাণুটির সৃষ্টি করেছে চীন, জীবাণু যুদ্ধের প্রয়োজনে। চীনের উহান শহরে প্রথম জানা যায় করোনাভাইরাসের কথা।
উহান শহরের এক তরুণ চক্ষু বিশেষজ্ঞ লি ওয়েন লিয়াং প্রথম বলেন এই ভাইরাসের কথা। লি ওয়েন লিয়াং ছিলেন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ। বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ নন। কিন্তু তিনি প্রথম বিশেষভাবে বলেন করোনাভাইরাসের কথা ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে। তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, এ সময় উহান শহরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে থাকে শত শত লোক। লি ওয়েন লিয়াং নিজেও আক্রান্ত হন এই রোগে। আর তার মৃত্যু ঘটেছে এই একই রোগে। চীন বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কৃত্রিমভাবে এই জীবাণুটির উদ্ভব ঘটিয়েছে, জীবাণুযুদ্ধের প্রয়োজনে। কিন্তু রোগটির আবির্ভাব ঘটেছে প্রথমে চীনে।
চীনের পর এখন ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। আতঙ্কে দেশে দেশে স্থবির হয়ে পড়ছে জনজীবন। খালি চোখে দেখা যায় না যে শত্রুকে, তার হাত থেকে বাঁচতে বিশ্বজুড়ে চলছে মরিয়া চেষ্টা। গত সোমবার বিকেলে জেনেভায় সংবাদ সম্মেলন করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এক লাখ ৬৮ হাজার ১৯ জনের সংক্রমণ এবং ছয় হাজার ৬১০ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছিল। ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদন ও অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের করা হিসাবে মঙ্গলবার বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছেছে এক লাখ ৮২ হাজার ৪০৫ জনে, মৃত্যু হয়েছে সাত হাজার ১৫৪ জনের। এ পর্যন্ত আক্রান্তদের মধ্যে ৭৯ হাজার ৪৩৩ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন বলে জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানিয়েছেন।
করোনাভাইরাস আতঙ্কে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজারে নজিরবিহীন দরপতন হয়েছে সোমবার। বিভিন্ন দেশ সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছে এবং মহামারী ঠেকাতে। বিমান সংস্থাগুলো ব্যাপকভাবে বন্ধ করে দিচ্ছে ফ্লাইট। সরকারগুলো কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে। ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে কোয়ারেন্টাইন। অবরুদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে শহরের পর শহর। আর তাতে বিশ্বব্যাপী মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা দারুণভাবে বিঘিœত হওয়ার খবর আসছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে।
করোনাভাইরাসের কারণে চীন এখন কার্যত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। চীনে এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে নানা প্রশ্ন, নানা জিজ্ঞাসা। যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’ বিশ্বাস করেন, তারা চীনে এ ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার পেছনে একটা ‘ষড়যন্ত্রের’ গন্ধ খুঁজে পেয়েছেন। বিবিসির একটি প্রতিবেদনেও পরোক্ষভাবে এ ‘ষড়যন্ত্রের’ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে রাশিয়ার টিভি চ্যানেল ওয়ানের একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এ ভাইরাসটি কৃত্রিমভাবে ল্যাবরেটরিতে উৎপাদন করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার এক ল্যাবে এটি তৈরি করা হয়। ভাইরাসটি একটি জৈব মারণাস্ত্র। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে- চীনের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়া।
ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথাটা এ জন্যই এসেছে যে, চীনের অর্থনীতিকে একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিলে কারা লাভবান হবে? করোনাভাইরাসের কারণে চীনের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটি বলার অপেক্ষা রাখে না। চীনের রফতানি খাতে এখন শ্লথগতি আসবে। চীন তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এককাতারে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছিল।
এটি একটি বিরাট কর্মযজ্ঞ। এর মাধ্যমে বিশ্বে চীনের গ্রহণযোগ্যতা একদিকে যেমনি বৃদ্ধি পাবে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে হ্রাস পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতা। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সমর্থকরা এর সাথে চীনের বর্তমান পরিস্থিতিকে মেলাতে পারেন এবং এক ধরনের ‘ষড়যন্ত্র’ আবিষ্কার করতে পারেন।
নিঃসন্দেহে চীন এ মুহূর্তে একটি বিশ্বশক্তি। চীন বিশ্বে যে পরিবর্তন ডেকে এনেছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব অনেক অংশেই খর্ব হয়েছে। আমরা কিছু তথ্য দিয়ে বিষয়টি বোঝাতে চেষ্টা করব। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীন অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে, যা মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্টদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
এটি সত্য, এ মুহূর্তে জিডিপিতে চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছুটা পিছিয়ে আছে। সাধারণ নিয়মে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি যেখানে ১৯.৩৯ ট্রিলিয়ন ডলার, সেখানে চীনের জিডিপি ১২.২৪ ট্রিলিয়ন ডলার। বিশ্বে চীনের অবস্থান দ্বিতীয়। কিন্তু ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে জিডিপি-পিপিপিতে চীনের অবস্থান শীর্ষে, ২৯.৭ ট্রিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দ্বিতীয়, ২২.২ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থনীতিবিদরা যে প্রাক্কলন করেছেন, তাতে সাধারণ নিয়মে জিডিপিতে ২০৫০ সালে চীন শীর্ষে অবস্থান করবে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হবে দ্বিতীয়। ২০৩০ সাল পর্যন্ত অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব বজায় থাকবে। কিন্তু ২০৫০ সালে এ দৃশ্যপট বদলে যাবে। সুতরাং চীনের অর্থনীতি যে পশ্চিমাদের কাছে টার্গেট হবে, তা বলাই বাহুল্য।
সিরিয়াস পাঠকরা স্মরণ করতে পারেন ১৯৭৮-৮১ সালে কিউবার পরিস্থিতির কথা। ওই সময় পাঁচ লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। ফিদেল কাস্ত্রো তখন অভিযোগ করেছিলেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের ‘বায়োলজিক্যাল অ্যাটাক’। অর্থাৎ জৈব রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও ওই অভিযোগের কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। আরেকটি তথ্য দেই- পৃথিবীর ২৫টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের জৈব রাসায়নিক ল্যাব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি থ্রেট রিডাকশন এজেন্সি এসব ল্যাব পরিচালনা ও গবেষণার জন্য ২.১ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে।
ওইসব ল্যাবে কী ধরনের গবেষণা হয়, তা অনেকেই জানে না। যুক্তরাষ্ট্র কখনো তা স্বীকারও করেনি। সুতরাং হঠাৎ করেই চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব, এর কারণে এ যাবৎ হাজারের ওপর মানুষের মৃত্যু এবং সেই সাথে চীনের অর্থনীতিতে ধস নেমে আসা- সব মিলিয়ে সেই ষড়যন্ত্র তত্ত্বকেই সামনে নিয়ে আসে। আমরা জানি না এর প্রকৃত রহস্য আদৌ কোনোদিন জানতে পারব কি না।
কিংবা চীন নিজে তা স্বীকার করে বিশ্ববাসীর কাছে তার ‘অযোগ্যতার’ কথা বিশ্ববাসীকে জানান দিতে চাইবে কি না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের ‘ঘটনা’ চীনসহ বৈশ্বিক রাজনৈতি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে। শুধু তাই নয়, এমন মন্তব্যও করা হয়েছে, করোনাভাইরাস চীনের কমিউনিস্ট ব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে পারে। এ ধরনের মন্তব্য কতটুকু বাস্তবসম্মত, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। তবে নিঃসন্দেহে এ ধরনের ‘ঘটনা’ চীনের জন্য একটি বড় ‘শিক্ষা’।