কিল-ঘুষি, লাথি-চড় : যেভাবে তিনি নিঃষ্ব থেকে বিশাল ধনী

নয়া দিগন্ত ডেস্ক | Mar 17, 2020 06:05 am
নাজিম উদ্দিন

নাজিম উদ্দিন - সংগৃহীত

 

সাংবাদিক নির্যাতনকারী কুড়িগ্রামের আরডিসি নিঃস্ব পরিবারের সন্তান নাজিম উদ্দিনের বিত্তবৈভব অর্জন, ক্ষমতার অপব্যবহার, উৎকোচ গ্রহণ, নির্যাতন, স্ত্রী-শ্বশুরের নামে সম্পদ অর্জনসহ নানা অনিয়মের তথ্য বের হতে শুরু করেছে। যশোরের মনিরামপুর সদরে জমি ক্রয় ও অট্টালিকা নির্মাণ এবং মাগুরার মহম্মদপুরে এসিল্যান্ড থাকাকালীন উৎকোচ আদায়সহ নানা অনিয়মের প্রতিবাদে গতকাল মানববন্ধন ও বক্তব্য রেখেছেন এলাকাবাসী।

মনিরামপুর (যশোর) সংবাদদাতা জানান, সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে নির্যাতনকারী কুড়িগ্রামের আরডিসি (সিনিয়র সহকারী কমিশনার রাজস্ব) নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে স্ত্রী ও শ্বশুরের নামে যশোরে কোটি টাকার জমি কেনাসহ কয়েক কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি নির্মাণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্ত্রী সাবরিনা সুলতানার নামে যশোরের মনিরামপুর পৌরশহরে ৮ শতাংশ জমির ওপর পাঁচতলা বিশিষ্ট বিশাল অট্টালিকা নির্মাণাধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে ভবনের চার তলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

নাজিম উদ্দিন মনিরামপুর উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের মৃত নিছার আলীর ছেলে। বাবার বৈবাহিক সূত্র ধরে উপজেলার কাশিপুর গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে ঘর জামাই থাকতেন নিছার আলী। দরিদ্র পরিবারের সন্তান নাজিম উদ্দিন মেধাবী হওয়ায় লেখাপড়ায় স্থানীয়রা সহযোগিতা করেছেন। তার বাবা দিনমজুর ছিলেন। প্রথমে নিছার আলী টালি ভাটার শ্রমিকের কাজ করতেন। কিন্তু নানার পরিবার আওয়ামী লীগ সমর্থক হওয়ায় নাজিম উদ্দিনের উপরের ওঠার সিঁড়ি পেতে অসুবিধা হয়নি। সরেজমিন কাশিপুর গ্রামে গেলে এসব তথ্য উঠে আসে।

নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে কক্সবাজার, বাগেরহাট ও মাগুরার মহাম্মদপুরে সহকারী কমিশনার (ভূমি) থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মের অভিযোগসহ কক্সবাজারে এক বৃদ্ধকে টেনেহেঁচড়ে মারতে মারতে নেয়ার ভিডিও ইতোমধ্যে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। মূলত এ্যাসি ল্যান্ড থাকাকালীন তিনি ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করে বিপুল অঙ্কের অর্থ কামান বলে অভিযোগ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মনিরামপুর পৌর এলাকার গাংড়া মৌজায় তার শ্বশুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক (অব:) আব্দুর রাজ্জাকের নামে ৪৬ লাখ টাকায় ১৪.৬৯ শতক জমি কেনা হয়। কিন্তু জমির সেলামি তোলা হয় ৩০ লাখ টাকা। জমির দত্তা (সাবেক মালিক) আকবর আলী জানান, স্থানীয় মোসলেম উদ্দীনের মধ্যস্থায় ৪৬ লাখ টাকায় তিনি ওই জমি বিক্রি করেন, যা আব্দুর রাজ্জাকের জামাই ম্যাজিস্ট্রেট নাজিম উদ্দিন কিনেছেন। কিন্তু দলিল করা হয় নাজিম উদ্দিনের শ্বশুর আব্দুর রাজ্জাকের নামে।

মনিরামপুর মৌজায় ৮ শতক জমি ১৩ লাখ টাকায় কেনা হয়, যা নাজিম উদ্দিনের স্ত্রী সাবরিনা সুলতানার নামে রেজিস্ট্রি হলেও সেখানে স্বামীর নাম বাদ দিয়ে বাবা আব্দুর রাজ্জাকের নাম দেয়া হয়েছে। এই জমির ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে পাঁচতলা বিশিষ্ট বিশাল অট্টালিকা। ইতোমধ্যে যার চারতলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

এসব বিষয়ে নাজিম উদ্দিন দাবি করেন, তার শ্বশুর পেনশনের টাকা দিয়ে গাংড়া মৌজায় জমি কিনেছেন। আর শ্বশুরের কিনে দেয়া ৮ শতক জমির ওপর স্ত্রীর সাবরিনা সুলতানার নামে ভবনটি প্রবাসী শ্যালিকা নির্মাণ করছেন। আসলে তার কিছুই নেই বলে তিনি দাবি করেন।
মহম্মদপুর (মাগুরা) সংবাদদাতা জানান, সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে নির্যাতনকারী কুড়িগ্রামের আরডিসি নাজিম উদ্দিন মাগুরার মহম্মদপুরে থাকাকালীন ক্ষমতা অপব্যবহার করে উৎকোচ আদায় ও নির্যাতন করতেন বলে অভিযোগ করেছে এলাকাবাসী। মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় ভুক্তভোগী ও এলাকাবাসী মুখ খুলতে শুরু করেছেন। সোমবার নাজিম উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করার দাবি জানিয়ে তারা মহম্মদপুর বাজারের বাসস্ট্যান্ড চত্বরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।

মানববন্ধনে সমবায় সমিতির সভাপতি জহুরুল হক বলেন, মহম্মদপুরের সাবেক এসিল্যান্ড, নাজিম উদ্দিনের কর্মকাণ্ড এতই খারাপ এবং জঘন্য যে, ব্যক্তিমালিকানা জমি সরকারি দাবি করে জমি বরাদ্দ দেয়ার বাণিজ্য করেছেন। তিনি এ উপজেলা থেকে কোটি কোটি টাকা উৎকোচ আদায় করেছেন। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানা করেছেন। কিল-ঘুষি, লাথি-চড়সহ অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতেন।

হাবিবুল্লাহ খান বাদশা নামে এক ভুক্তভোগী ওষুধ ব্যবসায়ী বলেন, আদালতে মামলা-মোকদ্দমা চলমান মালিকানাধীন জমি নিয়ে মহম্মদপুরের সাবেক এসিল্যান্ড নাজিম উদ্দিন নিষ্পত্তির জন্য তিন লাখ টাকা চান। আমি তাকে টাকা দেই। কিন্তু তার পরও তিনি আমার সমস্যার সমাধান করেননি। পরবর্তীতে আমি ওই টাকা ফেরত চাইলে নাজিম উদ্দিন আমাকে বাড়ি থেকে ধরে এনে অবৈধ গর্ভপাত ঘটানোর অভিযোগ এনে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো তিন মাসের জেল দেন। পরে দুই মাস তিন দিন কারা ভোগের পর হাইকোর্টের জামিনে বের হয়ে আসি।
অন্যের জমি বেদখলে বাধা দেয়ায় রড, সিমেন্ট ব্যবসায়ী মেজবাহুল ইসলামের দোকানঘর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এক মাস তালাবদ্ধ করে রাখেন বলে জানান ওই ব্যবসায়ী।

এ দিকে নাজিম উদ্দিন এ উপজেলায় এসিল্যান্ড থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, ভয়ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ মিছিল বের করেছিলেন উপজেলার নহাটা বাজারের ঘর মালিক ও ব্যবসায়ীরা।

তাদের মধ্যে নহাটা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ঘর মালিক মোস্তফা কামাল সিদ্দিকী লিটন এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম লুলুসহ কয়েকজন জানান, নাজিম উদ্দিন বিনা নোটিশে সময় না দিয়ে খাস জমি দাবি করে জমির ওপর স্থাপনা ভেঙে দিয়েছেন এবং কিল-ঘুষি ও লাথিসহ অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছেন দোকানদারদের সাথে।

হোটেল ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিনকে কিল, ঘুষি ও লাথি মেরে তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে মিষ্টির রান্না ঘর ভেঙে দিয়েছেন। এসিল্যান্ড নাজিম উদ্দিন তাদেরকে বলেন, বাজারের সব জমি আমার। আমিই সরকার। আমি বন্দোবস্ত দেবো। আমার সাথে যোগাযোগ করুন। পরবর্তীতে অফিসের পিয়ন দিয়ে বাজারের কিছু কিছু দোকানদারকে ডেকে বন্দোবস্ত নিতে বলেন এবং প্রতি আধা শতক ফাঁকা জায়গার জন্য দুই লাখ এবং যেখানে ঘর অবস্থিত সেখানে আধা শতকের জন্য এক লাখ টাকা দাবি করেন। তিনি তালা দেখিয়ে তাদের বলেন, টাকা দিয়ে বন্দোবস্ত না নিলে এই তালা লাগিয়ে দেয়া হবে। নাজিম উদ্দিন দাবি করেছিলেন, ওগুলো খাস জমি।

এ ব্যাপারে আরডিসি ও ম্যাজিস্ট্রেট মো: নাজিম উদ্দিনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মিজানূর রহমান বলেন, আমার যোগদানের আগেই মো: নাজিম উদ্দিনের বদলি হয়। তাই তার ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us