বুড়িগঙ্গা : যেভাবে বয়ে চলেছে
বুড়িগঙ্গা - সংগৃহীত
বিষয়টি আমি টিভিতে দেখেছি, সংবাদপত্রে পড়েছি, কিন্তু তবুও কখনো ভাবিনি যে এর অবস্থা এত খারাপ হবে। আমি আমাদের বিভাগীয় পিকনিকে দর্শনীয় এক রিভার ক্রুইজের অপেক্ষায় ছিলাম। প্যাডেল স্টিমার বা লঞ্চযোগে আমার পৈত্রিক বাড়ি যাওয়ার সুখস্মৃতি এখনো আছে। দেখতাম, স্থানীয় লোকজন গোসল করছে, পানিতে খেলা করছে; নদী থেকে খাবার নদীর পানিতেই ধোয়া হচ্ছে। অথচ এখন দুর্গন্ধ আর থিক থিকে আবর্জনা ভিন্ন চিত্র সামনে নিয়ে এলো। আক্ষরিক অর্থেই সেতুর নিচ দিয়ে অনেক পানি প্রবাহিত হয়েছে। একটি সমৃদ্ধিশীল নগরীর পাশে অলসভাবে বয়ে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা, কিন্তু এর দিকে কোনো নজর নেই। এর অর্থ হলো, ঢাকা বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত- এর অনুবাদ মুখস্ত করার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। এর বদলে বিশ্বের সবচেযে দূষিত নদীর খেতাপ এটি পেতে পারে বলে আমার মনে হলো। নর্ম্যান ম্যাকলিনের আধা আত্মজীবনীমূলক অ্যা রিভার রানস থ্রো ইটে ব্ল্যাকফুট রিভারে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার সময় যে একাকিত্ব অনুভব করছিলেন, আমারও তেমনটিই মনে হলো। আমার মনে হয় না কোনো ঢাকাবাসী যে বুড়িগঙ্গার তীরে নগরীটি নির্মিত হয়েছিল, সেটি নিয়ে আর তেমন কিছু মনে করে। কিন্তু তারপরও নদী বিস্তার করে থাকা আবর্জনা আমার মনেই প্রবেশ করতে লাগল, আর বুড়িগঙ্গা ও আমি এক হয়ে গেলাম।
খুনি যে দৃষ্টিতে তার শিকারের দিকে তাকায়, আমি সেভাবেই বুড়িগঙ্গার দিকে তাকালাম। যে নদীটি আমাদের জীবন দিয়েছিল, সেটিই এখন মৃত। আমরা একে হত্যা করে এর কৃপার বদলা দিয়েছি। এখন পতিত বীরের মতো সে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট ছোট নৌকাগুলো বিজয়ীদের এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে নিয়ে যাচ্ছে। নোংরা মৃত অজগরের মতো শুয়ে থাকা মরা শিকারের ওপর দিয়ে তৈরী সেতুগুলোর ওপর দিয়ে হাজার হাজার যানবাহন পারাপার হচ্ছে।
প্রতিদিন বুড়িগঙ্গা ও এর আশপাশের নদী ও শাখাগুলোতে ১৫ লাখ কিউবিক মিটার শিল্প ও মানব বর্জ্য নিক্ষেপ করা হয়। পরিবেশ দফতরের হিসাব অনুযায়ী, ট্যানারিগুলো প্রতি দিন ২১,৬০০ কিউবিক মিটার বিষাক্ত বর্জ্য ফেলছে। আর নগরবাসীরা প্রতিদিন ৪,৫০০ টন বর্জ ফেলছে এখানে। আমরা ট্যানারিক, বোটইয়ার্ড, শিপিয়ার্ড, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ক্যামিক্যাল বর্জ, হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা বর্জ্য, নৌপরিবহন, সিটি স্যুয়ারেজ, মৃত প্রাণী, প্লাস্টিক ব্যাগ ইত্যাদি যাকে খুশি তাকেই দায়ী করতে পারি, কিন্তু দিনের শেষে বলতে হবে, আমাদের সম্মিরিত উদাসিনতার কারণেই নদীটি মারা গেছে। নদীটি প্রাণহীন। এতে মাছ বা জলজ প্রাণী টিকে থাকার মতো অক্সিজেন আর নেই।
১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটির দুই পাড়ে থাকা ৪০ লাখ লোক ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতিনিয়ত বর্জ্য ফেলায় নদীটির গভীরতা কমে মাত্র ৭.৮ মিটারে নেমে এসেছে। ফলে শুষ্ক মওসুমে বড় বড় জলযান এতে চলতে সমস্যায় পড়ে। আবার বর্ষায় নগরী যখন জলাবদ্ধতায় পড়ে, তখন ড্রেজিংয়ের কথা মনে পড়ে।
বুড়িগঙ্গার নামের সাথে বিশাল গঙ্গার সাথে মিল আছে। এই গঙ্গাই আমাদের দেশে পদ্মা নাম ধারণ করেছে। একসময় গঙ্গার (এ কারণেই এর নাম বুড়িগঙ্গা) শাখা ছিল এই নদী। এখান দিয়েই গঙ্গার পানি ধলেশ্বরীতে পড়ত। এখন এর ধারা বদলে গেছে। বুড়িগঙ্গা এখন পানি পায় তুরাগ থেকে এবং মুন্সিগঞ্জের কাছে ধলেশ্বরীতেই মিশেছে।
ঢাকার জমির দাম অবিশ্বাস্য হারে বেড়ে যাওয়ায় নদীটি ভূমিদস্যূদের লোভাতুর হাতে পড়েছে। এই নদী দখল করার জন্য তারা তাদের প্রতিটি অস্ত্র ব্যবহার করে আসছে। যখন যে বেশ গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাই তারা করছে।
আমরা স্বপ্ন দেখছি ২০২৪ সাল নাগাদ আমরা মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবো, এলডিসির ট্যাগ ত্যাগ করব। কিন্তু তখন রাজধানী নগরী প্রাণবন্ত থাকবে কিনা সেটাও তো প্রশ্ন। নগরীর অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু এর নদীগুলো রক্ষা করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নগরীর প্রাণ ফিরিয়ে দিতে হতে এর রক্তনালী তথা বুড়িগঙ্গাকে প্রাণ ফিরিয়ে দিতে হবে।
নদীর তীরে সুন্দর ওয়াকওয়ে নির্মাণ বা একে কম নোংরা করার চেয়ে নদীটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের নদীর প্রতিবেশ ও সামাজিক কার্যক্রম বুঝতে হবে। আমরা ভাবি যে নদী বুঝি মুনাফা করার প্রাকৃতিক সম্পদ। নদী নিয়ে আমরা যা চিন্তা করি, তা পরিবর্তন করে এর যথাযথ মূল্য বোঝার সময় এসেছে। আমাদের পাঠ্যসূচি এমন করতে হবে যাতে আমাদের সন্তানেরা তাদের চারপাশকে ভালোবেসে বেড়ে ওঠে, তরুণ যাতে নদী বাঁচাও আন্দোলনে যাওয়ার আগে বিষয়টি বুঝতে পারে। আমাদের নীতি নির্ধারকদের বিদেশী ব্যাংকের এফডিআরের চেয়ে নদীর প্রবাহের গুরুত্ব বুঝতে হবে। এ ধরনের একটি নদীকে রক্ষার সামাজিক দায়িত্ব সমাজকেই নিতে হবে।
নদীপথের মেরামতের সাথে জড়িত একটি নদীকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনাটা প্রয়োজনীয় প্রতিবেশ ও সামাজিক কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় নয়। আজকের বুড়িগঙ্গ বন্যা প্রশমন, পরিষ্কার খাবার পানি যোগান দেয়া, তীরকে অতি দরকারি পুষ্টি ও পলির ব্যবস্থা করবে, মাছ ও বন্য প্রাণীকে সমর্থন দেবে- এমন কিছু দিতে পারবে না। এসব ক্ষতি আমাদের নজরে পড়া উচিত। এমনাকি বাণিজ্যিক পরিভাষায় বলা যায়, স্বাস্থ্যবান নদী সম্পত্তির মুল্য বাড়ায়, বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়।
নদীকে নতুন করে জীবন দেয়ার ঘটনা খোঁজার জন্য আমাদেরকে খুব বেশি দূর তাকাতে হবে না। সিঙ্গাপুর তা করেছে বেশ সফলভাবে। আমরা আবর্জনা তুলে বুড়িগঙ্গায় নতুন পানির প্রবাহ দিতে পারি। আমাদের নোংরা চিন্তাগুলেঅ ঝেড়ে ফেলে ইতিবাচক চিন্তার শ্বাস গ্রহণের এটাই সময়। আর নদীটি যাতে কোনো কষ্ট ছাড়াই নগরীর বুক চিড়ে প্রবাহিত হতে পারে তা নিশ্চিত করতে পারাটাই স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনে আমাদের উদ্দীপ্ত করবে।
দি ডেইলি স্টার