তালেবান-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে পাকিস্তানের লাভ
তালেবান-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে পাকিস্তানের লাভ - সংগৃহীত
কাতারের রাজধানী দোহায় ২৯ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে শান্তিচুক্তি সই হওয়ার সময় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি দারুণভাবে খুশি হয়েছিলেন।
তার খুশি হওয়ার যৌক্তিক কারণও ছিল : ওয়াশিংটনের সাথে ইসলামাবাদের সম্পর্কের যে টানাপোড়েন চলছিল, তার কারণ ছিল তালেবান। কাজেই তাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিচুক্তি হওয়াটা পাকিস্তানের জন্য খুশির খবরই। ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পাকিস্তানের মাটিতে অবস্থানরত স্ব-নির্বাসিত তালেবান নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বা বহিষ্কার করার মার্কিন চাপ প্রতিরোধ করে এসেছিল এই আশায় যে হোয়াইট হাউস দেশটির দীর্ঘতম যুদ্ধের অসারতা বুঝতে পেরে তালেবানের সমঝোতায় আসবে।
ওই সময় যখন এলো, তখন পাকিস্তান সরকার আলোচনার ব্যবস্থা করল এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলল। এর ফলে ভারত সফরকালেই পাকিস্তানের প্রশংসা করেন ট্রাম্প। অথচ মাত্র ২০ মাস আগে তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয় প্রদানের অভিযোগ এনে প্রকাশ্যে দেশটিকে অপদস্থ করেছিলেন, সামরিক সাহায্য বন্ধ করেছিলেন।
আবার তালেবানের পক্ষ থেকে চুক্তিটিতে সই করেছিলেন গ্রুপটির রাজনৈতিক প্রধান মোল্লা আবদুল গনি বারাদার। তিনি ১০ বছর আগে সিআইএর সাথে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর যৌথ অভিযানে করাচিতে গ্রেফতার হয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান চুক্তির ফলে আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে বিদেশী বাহিনী প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করবে। এটি পাকিস্তানের জন্য একটি উইন-উইন অবস্থা। শান্তিপ্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করে দেশটিকে আর আন্তঃআফগান আলোচনায় বিলম্ব করার জন্য দায়ী করা যাবে না।
এখন ক্ষমতা নিয়ে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর মধ্যে যে লড়াই চলছে, তা নিরসন করার দায়িত্ব তাদেরই। তারা তালেবানের সাথে আলোচনার জন্য ঐক্যবদ্ধ দল গঠন করতে পারবে কিনা তা তাদের ওপর নির্ভর করছে। শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে বন্দী ৫ হাজার তালেবানকে মুক্তি দিতে বিলম্ব করার মাধ্যমে গনি দেউলিয়ার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বন্দী মুক্তির বিনিময়ে তার ক্ষমতায় থাকার প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি করে আসছেন।
শান্তিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে আফগানিস্তানের সাথে থাকা দুই হাজার কিলোমিটার (প্রায় ১,২৫০ মাইল) সীমান্ত স্থিতিশীল হবে বলে পাকিস্তান আশা করছে। আর তা হবে ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত হামলার পর স্বস্তিদায়ক খবর।
যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান চুক্তির মধ্যে আইএসের বিরুদ্ধে সমন্বিত অভিযান পরিচালনা ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার কথাও পরোক্ষভাবে উল্লেখ রয়েছে। এর ফলে যেসব সন্ত্রাসী পাকিস্তানে হামলা চালিয়ে আফগানিস্তানে পালিয়ে যেত, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সমন্বিত অভিযানের প্রয়োজনীয়তা বোঝা যায় গত নভেম্বরের একটি ঘটনায়। এ সময় মার্কিন ও আফগান বাহিনীর সাথে সমন্বয়মূলক ভূমিকা পালন করে বিশেষভাবে মোতায়েন করা তালেবানের কয়েকটি ইউনিট ও পাকিস্তান বাহিনী। ফলে আইএস আর নাঙ্গাহার প্রদেশে অগ্রসর হতে পারেনি।
এরপর থেকে আইএসের ওপর চাপ বাড়িয়েই যেতে পারছে মার্কিন বাহিনী। তাদের বিমানগুলো নিয়মিতভাবে আইএসের লোকজনের ওপর বোমা বর্ষণ করে যাচ্ছে।
শান্তিচুক্তির পর পাকিস্তান এখন এই সমন্বিত ভূমিকায় থাকতে চাচ্ছে। আফগানিস্তানের বাকি অংশকেও হুমকিমুক্ত করা দরকার বলে ভাবছে পাকিস্তান।
তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, তালেবান-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তির ফলে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী অনেক স্বস্তিতে থঅকবে। বিশেষ করে ভারতের সাথে উত্তেজনা বাড়লেও আফগান সীমান্ত নিয়ে তাদের চিন্তিত থাকতে হবে না। উল্লেখ্য, আফগান সীমান্ত রক্ষা করা ও পাকিস্তান তালেবানকে পরাজিত করতে দেশটি প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছে।
ভারতের সাথে আকাশযুদ্ধের সময়ও আফগান সীমান্তে পাকিস্তানকে বিপুলসংখ্যক সৈন্য মোতায়েন রাখতে হয়েছিল। চুক্তিটি কার্যকর হলে পাকিস্তান কেবল ভারতের দিকেই মনোযোগী হতে পারবে। তাছাড়া এর ফলে নরেন্দ্র মোদি যাতে উত্তেজনা না বাড়ান, সে চেষ্টা করতে পারেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
তবে তা নিশ্চিত করতে হলে পাকিস্তানকে অবশ্যই তালেবানকে পুনর্বাসন করা, বিশেষ করে বহুল আলোচিত হাক্কানি নেটওয়ার্ককে নিস্ক্রিয় করার কাজ করতে হবে, জৈশ-ই-মোহাম্মদের মতো ভারতবিরোধী সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। আর যাতে হস্তক্ষেপের অভিযোগ না ওঠতে পারে, সেজন্য পাকিস্তানকে আন্তঃআফগান আলোচনা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে।
কোনো ধরনের সুযোগ গ্রহণ না করতে পরোক্ষভাবে ভারতকে হুঁশিয়ার করে দেয়ার মাধ্যমেও পাকিস্তানের নীতি স্পষ্ট করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোরেশি।
আর পাকিস্তান চায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার সম্পর্ক আবার জোরাল হোক। মার্কিন সামরিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার পাকিস্তানের জন্য খুবই দরকার।
পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকেরা এখন বুঝতে পারছেন যে তারা টেকসই স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করার একটি সুযোগ পেয়েছেন।
আল জাজিরা