ইমরান খানের নতুন চাল!
ইমরান খান - সংগৃহীত
পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাব ভাগ করা নতুন কোনো ইস্যু না হলেও এবার মনে হচ্ছে তাতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। অবশ্য পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সরকার নতুন আলাদা একটি প্রদেশ গঠন করার জন্য পার্লামেন্টে একটি বিল এনেছে। সম্ভাব্য নতুন প্রদেশকে বলা হচ্ছে দক্ষিণ পাঞ্জাব। পাঞ্জাব ভাগ করার পূর্ববর্তী প্রয়াসগুলো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বেশি কিছু ছিল না, প্রস্তাবগুলো আনা হতো সাধারণভাবে বিরোধী বা স্বতন্ত্র সদস্যরা।
পাঞ্জাবের দক্ষিণাঞ্চলের লোকজনের দীর্ঘ দিনের বৈধ আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে পাঞ্জাব আসলেই ভাগ হবে কিনা তা বলার সময় এখনো আসেনি। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই যে সম্ভব সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ ধরনের প্রয়াস চালানোর ফলে মনে হচ্ছে, গত এক যুগে পাকিস্তানের রাজনৈতিকব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন এসেছে।
২০১০ সালে ১৮তম সংশোধনী ঐকমত্যের সাথে পাস হওয়া ও বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি বিশেষভাবে বলা যায়। এই সাংবিধানিক পরিবর্তনের ফলে কেন্দ্র থেকে প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তিত হয়। এতে করে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কয়েক দশকের দাবি পূরণ হয়।
১৮তম সংশোধনী কেবল বর্তমান সাংবিধানিক সমবর্তী তালিকাই বিলুপ্ত ও এই তালিকায় থঅকা সব বিষয় প্রাদেশিক তালিকায় স্থানন্তরিত করেনি, সেইসাথে শক্তিশালী প্রদেশ মানে শক্তিশালী কেন্দ্রের ধারণাটিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছে। এই ধারণাটি শক্তিশালী কেন্দ্র হলো জাতীয় শক্তির নিশ্চয়তার ধারণার বিপরীত।
বাস্তবতা হলো ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি সরকার যে সংবিধান পাস করেছিল তাতে বলা হয়েছিল যে বর্তমান সমবর্তী তালিকাটি ১০ বছর পর বাতিল হয়ে সব ক্ষমতা প্রদেশের হাতে হস্তান্তরিত হবে।
অবশ্য দুটি প্রধান কারণে তা ঘটেনি : প্রথমত, বারবারের সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার সুযোগ ঘটেনি। সামরিক স্বৈরাচারদের পাস করা সংশোধনীগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বদলে কেন্দ্রীভূত করার প্রবণতা ছিল। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের বেসামরিক ও সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট ও এর কেন্দ্রবাদী রাজনীতিবিদদের কাছে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন অনেকটাই হজমঅযোগ্য বড়ি ছিল।
১৮তম সংশোধনী হয় জেনারেল পারভেজ মোশাররফের প্রায় ৯ বছরের শাসনের পর নির্বাচনের মাধ্যমে বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। এই সংশোধনীর মাধ্যমে কাঠামোগত ও অ-কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতাগুলো অপসারণ করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করার উদ্যোগ বিস্ময়কর কিছু মনে হচ্ছে না। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল বিরোধিতা করলেও এ ধরনের বিরোধিতা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন নয়, অন্যান্য কারণে হবে।
রাজনীতি
বাস্তবতা হলো এই যে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পিটিআই সরকার নতুন প্রদেশ সৃষ্টির জন্য যে বিলটি এনেছে তা পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রদেশিকরণের দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ।
পিএমএল-এন যদিও বিলটির বিরোধিতা করেছে, কিন্তু গত নির্বাচনে দেখা গেছে, মধ্য ও উত্তর পাঞ্জাব এখনো এর শক্ত ঘাঁটি হিসেবে বহাল রয়েছে। পিটিআই সরকার দক্ষিণ পাঞ্জাব প্রদেশের ইস্যুটিকে উন্মুক্ত স্থানে নিক্ষেপ করেছে। যেখানে পিএমএল-এনের শক্তিশালী অবস্থান নেই, সেখঅনে তাদের অবস্থান সংহত করার চেষ্টা করছে। এই প্রদেশ সৃষ্টি কেবল পিটিআইয়ের ভোট ব্যাংকই জোরদার করবে না, সেইসাথে রূপকভাবে বলা যায়, তাদেরকে দক্ষিণ পাঞ্জাবের ‘পিএমএল-এন’ বানিয়ে দেবে।
অর্থাৎ, সত্যিকারের রাজনৈতিক প্রণোদনা না থাকলে নতুন প্রদেশ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত না ইমরান খানের সরকার। মনে রাখতে হবে যে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই অনেকবার ইমরান খান ১৮তম সংশোধনীর সমালোচনা করেছেন এই বলে যে প্রদেশগুলোতে খুব বেশি ক্ষমতা দিয়ে দেয়ায় কেন্দ্র অর্থ সঙ্কটে ভুগছে।
ঘটনা যদি তাই হয়, তবে পিটিআই সরকার কেন দক্ষিণ পাঞ্জাবে নতুন প্রদেশ সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে। কারণ নতুন প্রদেশ মানে তাদের সঙ্কট আরো বাড়া।
এ কারণেই বলা যায়, বিদ্যমান পাঞ্জাব ভাগ করে নতুন প্রদেশ সৃষ্টির পেছনে রাজনীতি আছে। নিজস্ব প্রাদেশিক শক্ত ঘাঁটি সৃষ্টির চেষ্টায় পিটিআই কেবল পিএমএল-এনের ভোট ব্যাংকই সঙ্কোচিত করবে না, সেই সাথে দক্ষিণ পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়ার (এখানে পিটিআইয়ের অবস্থান খুবই ভালো) থেকে আসন পেয়ে পরবর্তী নির্বাচনে কেন্দ্রে ক্ষমতা গ্রহণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলবে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের ফলাফল পুরো চিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছে : দক্ষিণ পাঞ্জাবের ৪৬টি আসনের মধ্যে পিটিআই পেয়েছে ২৫টি, পিএমএল-এন পেয়েছে ১১টি। ২০১৮ সালে দক্ষিণ পাঞ্জাবে পিটিআইয়ের বেশি ভোট পাওয়ার একটি কারণ হলো দক্ষিণ পাঞ্জাব প্রদেশ সৃষ্টির স্লোগান দেয়া।
পিএমএল-এনের মতো প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল মুখে মুখে পাঞ্জাব বিভক্তির কথা বললেও বাস্তবতা হলো, বিলটি পাস হতে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন হওয়ায় এটি পাস হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
পাঞ্জাবে পিটিআইয়ের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পিএমএল-এন ও পাঞ্জাবে রাজনৈতিক উপস্থিতি আবারো সৃষ্টি করার চেষ্টায় থাকা পিপিপি বিলটিকে পরাজিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। তবে পিটিআইয়ের দিক থেকে বলা যায়, তাদের প্রস্তাব পাস না হলেও তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে। তারা তখন দক্ষিণ পাঞ্জাবের ভোটারদের বলতে পারবে যে তারা আলাদা প্রদেশ সৃষ্টির জনগণের দাবির প্রতি সোচ্চার।
সূত্র : এসএএম