খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন : দুঃসময়ের কাণ্ডারি
খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন - ছবি : সংগ্রহ
খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ছিলেন একজন আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। তার জন্ম মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার খিরাই পাচুরিয়া গ্রামে ১৯৩৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। মৃত্যু ২০১১ সালের ১৬ মার্চ। তার বাবা খোন্দকার আবদুল হামিদ ছিলেন একজন আলেম। মায়ের নাম আকতারা খাতুন। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ১৯৪৭ সালে মানিকগঞ্জ হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯৪৯ সালে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স), ১৯৫৩ সালে এমএ এবং ১৯৫৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার জন্য তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
খোন্দকার দেলোয়ার সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে মানিকগঞ্জ মহকুমা আদালতে আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৫৭ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দিয়ে সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে ওই দলের মানিকগঞ্জ মহকুমা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। আইনজীবী সমিতিগুলোর কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী গণ-আন্দোলনেও ছিলেন সক্রিয়। ১৯৭০ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক এবং মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধে মানিকগঞ্জে গঠিত বিপ্লবী কম্যান্ড কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল প্রতিষ্ঠা করলে তাতে যোগ দেন খোন্দকার দেলোয়ার এবং দলের মানিকগঞ্জ জেলা শাখার আহ্বায়ক নিযুক্ত হন। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠার পর মানিকগঞ্জ মহকুমা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৮৫ সাল থেকে বিএনপির জাতীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৭৯ সালে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মানিকগঞ্জ-১ (ঘিওর-দৌলতপুর) নির্বাচনী এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মানিকগঞ্জ-১ থেকে পঞ্চম (১৯৯১), ষষ্ঠ (১৯৯৬), সপ্তম (১৯৯৬) ও অষ্টম (২০০১) সংসদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি পঞ্চম, ষষ্ঠ ও অষ্টম সংসদে ক্ষমতাসীন সংসদীয় দলের চিফ হুইপ এবং সপ্তম সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপ ছিলেন। তিনি দুই মেয়াদে পার্লামেন্ট মেম্বার্স ক্লাবের সভাপতি এবং বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সদস্য ছিলেন।
আশির দশকের শেষদিকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির পর বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সেপ্টেম্বর মাসে গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের প্রাক্কালে খালেদা জিয়া দলের মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়াকে বহিষ্কার করে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিব পদে নিয়োগ দেন। এক-এগারোর পর যখন বেগম খালেদা জিয়াসহ দলের সিনিয়র নেতারা আটক ছিলেন, খোন্দকার দেলোয়ার তখন সাহসিকতার সাথে দলের ঐক্য ও অখণ্ডতা ধরে রাখেন। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর ফের তিনি বিএনপির মহাসচিব নিযুক্ত হন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে তিনি ছিলেন আপসহীন এক সাহসী নেতা। সরকার এক দিকে দলীয় নেতাদের গ্রেফতার করছিল, অন্য দিকে দলের ভেতর থেকে কিছু নেতা গোপনে সরকারকে সহযোগিতা দেয়ায় সে সময় বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছিল। তেমনি এক কঠিন সময়ে খোন্দকার দেলোয়ারকে বিএনপির মহাসচিব পদে নিযুক্ত করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। পরে দলের জন্য তো বটেই; এ সিদ্ধান্ত দেশ ও জাতির জন্যও সঠিক এবং ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হয়। মামলা ও গ্রেফতারের হুমকি এবং দমন-পীড়নের ভয়ভীতি দেখানোসহ সবভাবে তাকে বাগে আনার চেষ্টা চালায় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু মাথা নোয়ানো দূরের কথা, খোন্দকার দেলোয়ার এমনকি সামান্য নমনীয়তাও দেখাননি। সাংবাদিক আতাউস সামাদ তখন বলেছিলেন, খোন্দকার দেলোয়ার ছিলেন রাজনীতির দুঃসময়ের কাণ্ডারি।
খোন্দকার দেলোয়ার অনেক সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ১৯৭৬-১৯৭৮ এবং ১৯৮৪-১৯৮৫ সালে মানিকগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং ১৯৭৯-১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় সিনেটের সদস্য ছিলেন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ছিলেন মানিকগঞ্জ খোন্দকার নূরুল হোসেন ল’ একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ। নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন কলেজ এবং পাচুড়িয়া মাদ্রাসা।