কেন তালেবানের সাথে চুক্তি করল যুক্তরাষ্ট্র
কেন তালেবানের সাথে চুক্তি করল যুক্তরাষ্ট্র - ছবি : সংগ্রহ
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে ১৯ বছরের আফগান যুদ্ধের অবসান ঘটতে চলেছে বলে আশা করা হচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর উপস্থিতিতে আফগান বিষয়ে মার্কিন বিশেষ দূত জালমি খলিলজাদ এবং তালেবানের পক্ষে মোল্লা আবদুল গণি বারাদার চুক্তিতে সই করেন। এক বিবৃতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘যদি তালেবান ও আফগান সরকার তাদের অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারে, তাহলে যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে আমরা আমাদের সেনাদের ঘরে ফিরিয়ে আনতে পারি।’
আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলায় কখনো শত্রু বন্ধুতে পরিণত হয়; আবার কখনো বন্ধু হয়ে যায় শত্রু। ২০১০ সালে সিআইএ মোল্লা আবদুল গণি বারাদারকেই ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে পাকিস্তান সরকারের মাধ্যমে করাচিতে গ্রেফতার করিয়েছিল। আট বছর জেল খেটে তিনি মুক্তি লাভ করেন। বারাদার ছিলেন আফগান তালেবান নেতা মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের সহ-অধিনায়ক। সেই সিআইএ’র অনুরোধে বারাদার সমঝোতা চুক্তিতে তালেবানদের পক্ষে স্বাক্ষর করেছেন।
চুক্তি করলেও তালেবান যোদ্ধারা ঘরে ফিরে যায়নি। স্বদেশের পর্বতচূড়া ও গিরি উপত্যকার সব ক্যাম্পে রয়েছে তাদের সতর্ক অবস্থান। পরিস্থিতি তারা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। চুক্তির নেপথ্যে প্রতিপক্ষের কোনো কূটকৌশল আছে কি না তা পরখ করে দেখা হচ্ছে। সমঝোতা চুক্তির পরপরই আফগানিস্তানের ৯টি প্রদেশে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী ও তালেবান যোদ্ধাদের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ শুরু হয়।
নিরাপত্তা বাহিনীর ১৪ সদস্য প্রাণ হারায়। মার্কিন বাহিনী হেলমন্দ প্রদেশে তালেবান ঘাঁটি লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে। গত ৬ মার্চ আফগানিস্তানে অপর এক হামলায় ৩২ জন মানুষ প্রাণ হারায়। আইএস এর দায়ভার স্বীকার করেছে। ট্রাম্প এ নিয়ে ৬ মার্চ এক অভূতপূর্ব মন্তব্য করেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেয়ার পর তালেবান ‘হয়তো’ সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। হোয়াইট হাউজে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আফগানিস্তানের নিজের সুরক্ষার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে। কিছু সময়ের জন্য একজনের হাত ধরে রাখতে পারেন। সব সময়ের জন্য নয়।’ ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তালেবান দেশটির ক্ষমতা দখলে নিতে পারে কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন যে পথে তারা এগোচ্ছে, তা হয়তো সম্ভব নয়। আবার এই সম্ভাবনা উড়িয়েও দেয়া যায় না।’ এসব কথা বেশ গুরুত্বের দাবি রাখে।
বিশ্লেষকদের মতে, মাঝে মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হলেও চুক্তি সফল হওয়ার সম্ভাবনা অধিক। আফগান কারাগারে বন্দী পাঁচ হাজার তালেবান যোদ্ধার মুক্তির ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানির নেতিবাচক মন্তব্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে। তালেবানদের আলোচনায় বাধ্য করার জন্য হয়তো তিনি এমন মন্তব্য করে থাকবেন। তালেবান কমান্ডার জবিহুল্লাহ মুজাহিদ ঘোষণা দিয়েছেন, তালিবান বন্দীদের মুক্তি না দিলে আফগান সরকারের সাথে কোনো আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না। সরকার মূলত জনপ্রতিনিধিত্বহীন মার্কিন বশংবদ হিসেবে অভিহিত। ট্রাম্প ও পম্পেওর সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার শক্তি তার নেই, সাহসও নেই। মার্কিন সমর্থন প্রত্যাহার করা হলে যোদ্ধাদের হাতে সরকারের পতন হতে পারে। চুক্তির অংশ হিসেবে তালেবান আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর এক হাজার বন্দী সদস্যকে মুক্তি দেবে।
টুইন টাওয়ারে হামলার পর ২০০১ সালে ন্যাটো বাহিনীর সহযোগিতায় আমেরিকা আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালায়। সামরিক ও বেসামরিক বিপুল সংখ্যক মানুষের রক্ত ঝরিয়েও মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী জয় লাভ করতে পারেনি। দেশের ৭০ শতাংশ এলাকা তালেবানের দখলে। এ পর্যন্ত আড়াই হাজার মার্কিন সেনা তালেবান যোদ্ধাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। আহত ২০ হাজার সেনা। এখনো আফগানিস্তানে ১২ হাজার মার্কিন সৈন্যসহ ন্যাটোর ১৭ হাজার সৈন্য রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রোড আইল্যান্ডের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের মতে, আফগান যুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর ৫৮ হাজার সদস্য এবং বিরোধী পক্ষের ৪২ হাজার যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার জোটভুক্ত দেশগুলো ‘পছন্দের সরকার’ গঠন করেও ১৯ বছরে আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে এবং সাড়ে তিন কোটি মানুষের চাহিদা মেটাতে চরমভাবে ব্যর্থ। ২০০৯ সালে সমাজবিজ্ঞানী থমাস এইচ জনসন ফরেন পলিসি জার্নালের এক নিবন্ধে তদানীন্তন কারজাইয়ের সরকারকে ‘সম্পূর্ণ অবৈধ ও অদক্ষ চোরের সরকার’ বলে অভিহিত করে ছিলেন।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ১৪ মাসের মধ্যে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী পর্যায়ক্রমে সব সেনাসদস্য ফিরিয়ে আনবে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আমেরিকার সামরিক ব্যয় হয়েছে ৮২২ বিলিয়ন ডলার।
আফগানরা বীরের জাতি। তাই বিদেশী কোনো শক্তি তাদের বেশি দিন পদানত করে রাখতে পারেনি। তিনটি সুপার পাওয়ার সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পরিশেষে আমেরিকাকে তারা আফগানিস্তান ত্যাগে বাধ্য করেছে। খ্রিষ্টের জন্মের ৩৩০ বছর আগে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে ভারতে আগমন করেন কিন্তু আফগানিস্তান দখল করে রাখার সাহস করেননি। (১৮৩৯ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আফগানিস্তান দখল করার দুঃসাহস দেখায়। কিন্তু ১৮৪২ সালে আফগান গেরিলাদের প্রতিরোধের মুখে তাদের পাততাড়ি গুটাতে হয়। ১২ হাজার সৈন্যের মধ্যে মাত্র একজন সৈন্য জীবিতাবস্থায় ব্রিটেনে ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের সব লাশই আফগানিস্তানের গিরিকন্দরে ফেলে যেতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশ কমান্ডার মেজর জেনারেল স্যার এলফিনস্টোন গেরিলাদের হাতে তখন প্রাণ হারান।
১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বছর সোভিয়েত ইউনিয়ন এক লাখ ৪০ হাজার সেনাসদস্য নিয়ে আফগানিস্তানে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। তারা পাহাড়ে-পর্বতে এবং গুরুত্বপূর্ণ Strategic Point এ এক কোটি শক্তিশালী মাইন পুঁতে রাখে এবং ১৫ লাখ আফগানকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছে। এত কিছু করেও কমপক্ষে ১৫ হাজার সৈন্যের লাশ ফেলে সোভিয়েত পরাশক্তিকে আফগানিস্তান ছাড়তে হয়। স্বদেশী প্রতিরোধ আন্দোলনকারীদের মোকাবিলায় ভাড়াটিয়া ও হানাদার বাহিনী বেশি দিন টিকতে পারেনি এবং পারে না। ইতিহাসে এর প্রমাণ একটি নয়, বহু। একটানা ১০ বছর বোমাবর্ষণ করে এবং ৫০ হাজার মার্কিন সৈন্যের লাশের বিনিময়েও ভিয়েতনামকে পরাজিত করা আমেরিকার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এ তিক্ত স্মৃতি নিশ্চয় আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রকে ধাওয়া করছে। আফগানিস্তানেও ভিয়েতনামের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল- ইতিহাসের শিক্ষা কত নির্মম!
টুইন টাওয়ারে হামলার পর ২০০১ সালে ন্যাটো বাহিনীর সহযোগিতায় আমেরিকা আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালায়। সামরিক ও বেসামরিক বিপুল সংখ্যক মানুষের রক্ত ঝরিয়েও মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী জয় লাভ করতে পারেনি। দেশের ৭০ শতাংশ এলাকা তালেবানের দখলে। এ পর্যন্ত আড়াই হাজার মার্কিন সেনা তালেবান যোদ্ধাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। আহত ২০ হাজার সেনা। এখনো আফগানিস্তানে ১২ হাজার মার্কিন সৈন্যসহ ন্যাটোর ১৭ হাজার সৈন্য রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রোড আইল্যান্ডের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের মতে, আফগান যুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর ৫৮ হাজার সদস্য এবং বিরোধী পক্ষের ৪২ হাজার যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার জোটভুক্ত দেশগুলো ‘পছন্দের সরকার’ গঠন করেও ১৯ বছরে আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে এবং সাড়ে তিন কোটি মানুষের চাহিদা মেটাতে চরমভাবে ব্যর্থ। ২০০৯ সালে সমাজবিজ্ঞানী থমাস এইচ জনসন ফরেন পলিসি জার্নালের এক নিবন্ধে তদানীন্তন কারজাইয়ের সরকারকে ‘সম্পূর্ণ অবৈধ ও অদক্ষ চোরের সরকার’ বলে অভিহিত করে ছিলেন।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ১৪ মাসের মধ্যে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী পর্যায়ক্রমে সব সেনাসদস্য ফিরিয়ে আনবে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আমেরিকার সামরিক ব্যয় হয়েছে ৮২২ বিলিয়ন ডলার।