১৯ বছরের যুদ্ধের পর ১২ দফার চুক্তি
তালেবান আলোচকদের কয়েকজন - ছবি : সংগ্রহ
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে ১৯ বছরের আফগান যুদ্ধের অবসান ঘটতে চলেছে বলে আশা করা হচ্ছে। এই চুক্তির কয়েকটি বিশেষ দিক রয়েছে। এখানে এর ওপর ালোকপাত করা হলো।
প্রথমত. মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী ১৯ বছর ধরে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অর্থ ও প্রাণ এ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মনোবলে ভাটা পড়েছে। এ চুক্তির মাধ্যমে বিদেশী বাহিনীর নিরাপদ প্রস্থানের সুযোগ তৈরি হলো। অপর দিকে আফগানিস্তানের সাধারণ জনগণ যুদ্ধে যুদ্ধে অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় তালেবান পাবলিক সেন্টিমেন্টের প্রতি সম্মান জানাবার সুযোগ পেয়েছে।
দ্বিতীয়ত, এ চুক্তির কৃতিত্ব দেখিয়ে ট্রাম্প আগামী নভেম্বরের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে রাজনীতির হাওয়া নিজের অনুকূলে নিয়ে আসার সুযোগ পেতে পারেন। আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা তার প্রচেষ্টায় হয়েছে- এমন বার্তা তিনি জনগণকে দিতে পারবেন।
তৃতীয়ত, চুক্তির মাধ্যমে পরাশক্তি আমেরিকা তালেবানকে অনস্বীকার্য রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হলো। হানাদার ও আগ্রাসী বিদেশী শক্তির জন্য এ চুক্তিটি এক ‘নির্ভুল বার্তা’। যে তালেবান নেতা সিরাজুদ্দীন হাক্কানীকে ধরার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, সে তালেবানদের সাথে চুক্তি করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতিস্বীকার করাকে ‘করুণ প্রতিরোধ’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
চতুর্থত, তালেবানদের যে করেই হোক আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফিরে আসার সুযোগ হলো। সৃষ্টি দেশের গোত্রপ্রধানদের ‘লরা জিরগা’ ডেকে নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে।
পঞ্চমত, এ চুক্তিতে আফগান সরকার পক্ষভুক্ত ছিল না। তালেবান এ সরকারকে ‘বিদেশী শক্তির পুতুল’ মনে করেন। প্রমাণিত হলো হামিদ কারজাই ও আশরাফ গানিরা জনবিচ্ছিন্ন ও পরাশক্তির এজেন্ট।
ষষ্ঠত, ভিয়েতনামের পর আফগানিস্তানেও আমেরিকার কার্যত পরাজয় তাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি আর নানা ছলছুতোয় বিভিন্ন দেশে সামরিক আগ্রাসন চালানোর উচ্চাভিলাষের লাগাম টেনে ধরতে সহায়ক হওয়ার কথা।
সপ্তমত, এশিয়ার বুকে শরিয়াহ আইনভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হলো।
অষ্টমত, সমঝোতা চুক্তিতে চীন ও পাকিস্তান লাভবান হবে। এ দু’দেশ তাদের অর্থনৈতিক করিডোরের সাথে আফগানিস্তানকে যুক্ত করার সুযোগ লাভ করবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের অবকাঠামো নির্মাণে চীন সুযোগ পেতে মরিয়া হয়ে উঠবে। পাকিস্তানের সাথে তালেবানের সম্পর্ক ভালো। অপর দিকে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রিত আফগান সরকারের সাথে সখ্য গড়ে তুলতে দেরি করেনি। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী ভারত এ পর্যন্ত তিন হাজার মিলয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে আফগানিস্তানে। পাকিস্তানের সাথে আফগানিস্তানের রয়েছে দুই হাজার ৪৩০ কিলোমিটার সীমান্তরেখা (Durand Line)। দু’দেশের সীমান্তবিরোধ পুরনো। সীমান্তের উভয় দিকে পশতুন জাতির অধিবাস। মার্কিন সহযোগিতা ছাড়া এ সঙ্কট সমাধান একা পাকিস্তান করতে পারবে না। তাই সমঝোতা চুক্তিতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে পাকিস্তান।
নবমত, সমঝোতা চুক্তির ফলে চীন, ভারত ও ইরানের উদ্বেগ কিছুটা বাড়বে বলে মনে হয়। ভূরাজনৈতিক কারণে এ তিন দেশ তালেবানদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী হবে।
দশমত, উইঘুরদের কেউ যাতে আফগানিস্তান থেকে সশস্ত্র হয়ে জিনঝিয়াংয়ে ঢুকতে না পারে, চীন তালেবানের কাছে এ নিশ্চয়তা চাইতে পারে।
রাশিয়াও চাইবে না উজবেক ও চেচেন গেরিলারা স্বদেশে ফিরে আসুক। ভারতের চাওয়া-পাওয়া হলো আফগান মুজাহিদরা যেন কাশ্মিরমুখী না হয়। ইরান তালেবান সরকারের কাছে শিয়া মতালম্বী হাজারাদের শক্তিশালী অবস্থান চাইবে।
স্মর্তব্য, ১৯৯৮ সালে মাজার-ই-শরিফে তালেবানদের হাতে ইরানের ন’জন কূটনীতিক প্রাণ হারিয়েছিলেন। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি স্বাভাবিকভাবেই ইরান চাইবে না। দশমত, এ চুক্তির মাধ্যমে ইরান ও পাকিস্তানে আশ্রিত ৩০ লাখ শরণার্থী নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ অবারিত হতে পারে।
একাদশত, চুক্তি পরবর্তী সময়ে আফগানিস্তানে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯ বছরব্যাপী বিভিন্ন প্রদেশে মার্কিন, ন্যাটো বাহিনী ও সিআইএ পরিচালিত ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দীদের ১৯ বছরব্যাপী নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের আন্তর্জাতিক তদন্ত পরিচালনা এবং অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হতে পারে। গত ৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এই যুদ্ধাপরাধের তদন্ত পরিচালনার পক্ষে সায় দিয়েছে। নির্যাতন ও নিগ্রহের বিশ্বাসযোগ্য ও যৌক্তিক কারণ আছে- এমন তথ্য দিয়েছে আইসিসি।
দ্বাদশত, ১৯ বছরব্যাপী মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর তত্ত্বাবধানে হামিদ কারজাই ও আশরাফ গানির সরকার আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতায় ছিল ও আছে। এদের কেন্দ্র করে একটি এলিট সোসাইটি গড়ে উঠেছে, যারা কোটি কোটি ডলার লুটপাট করেছে। আগামীতে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হওয়ার কথা।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ওমর গণি এমইএস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম