চীনের ওপর মন্দার পরোক্ষ প্রভাব কেন কম হয়েছিল?
চীনের ওপর মন্দার পরোক্ষ প্রভাব কেন কম হয়েছিল? - ছবি : সংগ্রহ
আমাদের গ্লোবাল হয়ে ওঠা পণ্য-লেনদেন-বিনিময় সম্পর্কের কথা এখানে যেমন বলছি, তেমনি এর উল্টো পরিস্থিতি বা ধারণাটা হলো গ্লোবাল পণ্য-লেনদেন-বিনিময়ের ব্যবস্থাটাই আবার ঢলে পড়া বা শ্লথ হয়ে পড়া- যেটাকে রিসেশন বা ‘মহামন্দা’ বলা হয়- এটাও ঘটা স্বাভাবিক। আর তা ঘটেছিল, প্রথম গ্লোবাল মহামন্দা বলা হয়, ১৯৩০ সালে সময়টা হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে, প্রায় ২১ বছরের এমন বিরতির কালে। এই মহামন্দার মূল কারণ ছিল ইউরোপের প্রায় সব রাষ্ট্রই। আর অন্তত কলোনি মালিক রাষ্ট্রগুলো যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যয়ভার মিটাতে গিয়ে নিজ নিজ আয়ের চেয়ে ছাড়িয়ে যুদ্ধের ব্যয় বেশি করে ফেলেছিল। তাই যুদ্ধ শেষে সেই ঘাটতিটা পূরণ করতে চেয়ে পরিকল্পিত মুদ্রাস্ফীতি ঘটিয়েছিল প্রত্যেক রাষ্ট্র। এতে সবাই নিজ নিজ মুদ্রার মূল্যমান ফেলে দিয়ে রফতানি-বিক্রি বাড়ানোর জন্য আত্মঘাতী প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল। এর সামগ্রিক প্রভাব ও ফলাফলই হলো ওই মহামন্দা। আবার এখান থেকে বের হতে গিয়ে, হিটলারি-জাতিবাদকে ঠেকাতে আরো বড় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া- এভাবে এক চক্রে পড়ে ইউরোপ নিজের সক্ষমতা বা সম্ভাবনা শেষ করে দিয়েছিল।
এখান থেকেই আইএমএফ-বিশ্ব ব্যাংকের জন্মের সময় তাদের কর্মসীমা বা ম্যান্ডেটে যে মুখবন্ধ লেখা হয়েছিল তাতে উল্লেখ করা হয়েছিল, ১৯৩০ সালের মতো মহামন্দা আবার যাতে দুনিয়াতে না আসে তা ঠেকানোও এ দুই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম লক্ষ্য। তবু মহামন্দা আবার এসেছিল ২০০৭ সালের শেষে আর ২০০৮ এর শুরুতে। বলা যায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের দ্বিতীয় ও শেষ জমানায় শুরু হয়ে পরের প্রেসিডেন্ট ওবামাসহ সব প্রেসিডেন্টকেই তা সামলাতে হয়েছিল। এখনো হচ্ছে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত রিসেশনের ভয় দুনিয়া থেকে আর কখনো যায়নি, এভাবেই দিন কাটছে।
তবে ২০০৭ সালের যে মহামন্দা, এখানে মূল কারণ কী ছিল? আসলে এখানেও কারণ একই, রাষ্ট্রের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করে ফেলা। কিন্তু কেন?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের ২০০১ সালের আফগান-ইরাক দখলের যুদ্ধ; যেটাকে আমেরিকা নিজের ইজ্জত ঢাকতে, পর্দার আড়ালে ফেলতে বলে থাকে ‘ওয়ার অন টেরর’। ওই যুদ্ধে আমেরিকার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি আর এর চেয়েও বড় বিষয় হলো, আমেরিকার এই যুদ্ধ জয়লাভের অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল। তা হয়ে পড়েছিল সমাপ্তির টার্গেটবিহীন এক অনন্ত যুদ্ধ। অথচ এ যুদ্ধের খরচ বইবার সামর্থ্য আমেরিকার অর্থনীতির ছিল না। তাই আমরা স্মরণ করতে পারি পরের প্রেসিডেন্ট ওবামার সিদ্ধান্তকে। আফগান যুদ্ধ কবে শেষ হবে সেই টার্গেট নয়, বরং আমেরিকান অর্থনীতি কষ্ট করে হলেও সর্বোচ্চ কত দিন ব্যয় বইতে সক্ষম হতে পারে বা করা ঠিক হবে- এই ভিত্তিতে টার্গেট ঠিক হয়েছিল ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে মার্কিন সৈন্য ফেরত আনতেই হবে।
এভাবেই যুদ্ধের খরচ থামানোর প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করেছিলেন ওবামা। এটা চলতি বছরে আর একটা ধাপ শেষ করার জন্য চুক্তি করা হলো। আর সঙ্গী ইউরোপের যারা ভেবেছিল লোভ-লিপ্সার কথিত যুদ্ধজয়ের থেকে উচ্ছিষ্ট কিছু নিজের ভাগেও আসবে, সেটিও না হওয়াতে তাদের অর্থনীতিও একই সময়ে মহামন্দায় বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যে কথাটা বলার জন্য এখানে এত আয়োজন, তাহলো- এই ২০০৭ সালের দ্বিতীয় মহামন্দার ধাক্কা প্রধানত লেগেছিল আমেরিকা-ইউরোপে, পশ্চিমা দেশে। এমনকি সেকালের ক্রমশ দৃশ্যমান, উত্থিত (১৯৯০-২০১০ বিশ বছরের রাইজিং চীন) হতে থাকা চীন- এই চীনের ওপর মন্দার পরোক্ষ প্রভাব কমই হয়েছিল। আমাদের এশিয়াতেও এর প্রভাব হয়েছিল আরো কম। কেন?
এর সোজা অর্থ হলো, তত দিনে পশ্চিমের সাথে এশিয়ার পণ্য-বিনিময় লেনদেন সম্পর্ক হাল্কা হতে শুরু হয়ে গিয়েছিল; আবার এশিয়ায় চীনের সাথে নতুন করে ততটাই সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল, তাই।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com