নারী অধিকার নিয়ে কিছু কথা
নারী অধিকার - সংগৃহীত
শুধু আমাদের দেশে নয় বরং গোটা বিশ্বেই নারী অধিকার নিয়ে নানা ধরনের মতবাদ চালু রয়েছে। ধর্ম, বিশ্বাস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, চিন্তা ও আদর্শগত পার্থক্যের কারণে নারী অধিকার নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান ও মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। একপক্ষের কাছে যা অধিকার, অপরপক্ষের কাছে তা অনধিকার বলে বিবেচিত হয়। কেউ কেউ পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনকেই নারীর প্রকৃত অধিকার বলে মনে করেন। এদের পক্ষ থেকেই এসেছে উভলৈঙ্গিক পোশাকের ধারণা। তাদের মতে, পুরুষ-নারী উভয়ই মনুষ্য প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। তাই পুরুষ-নারীর মধ্যে কোনো পোশাকি পার্থক্য থাকা যৌক্তিক নয়। তাদের ভাষায়, যে পোশাক লিঙ্গ নির্দেশ করে তা বৈষম্যমূলক ও মানবতার অপমান। আবার পক্ষবিশেষ নারীর সমঅধিকারের পক্ষপাতি। তারা মনে করেন, পুরুষ-নারীকে কোনোভাবেই সমান্তরাল করা যাবে না। শুধু অধিকারের ক্ষেত্রে সমতা আনাই যুক্তিযুক্ত। কারণ, সৃষ্টিগতভাবে উভয়ের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা সমান করার ভাবনা বাতুলতা মাত্র।
তারা মনে করেন, পুরুষ যা পারে নারীর পক্ষেও তা করা সম্ভব। তাই সব ক্ষেত্রেই পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমান সুযোগ নিশ্চিত হওয়া দরকার। সমাজে পুরুষরা যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন, নারীদের ক্ষেত্রে তা নিশ্চিত করতে হবে। আবার বিশেষ পক্ষ সমঅধিকার নয় বরং নারীর ন্যায্য অধিকারের পক্ষে। তারা মনে করেন, নারী-পুরুষের মধ্যে সৃষ্টিগত যে পার্থক্য রয়েছে তা কোনোভাবেই সমান করার সুযোগ নেই। খুব সঙ্গত কারণেই পুরুষ ও নারীর মধ্যে দায়িত্ব, কর্ম ও অধিকারগত ভিন্নতা রয়েছে। তাই ন্যায্য অধিকারের ধারণাটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে আসা নারী অধিকারবিষয়ক এসব মতপার্থক্যের বিষয়ে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কোনো একক ও অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়নি।
প্রথমেই আলোচনায় আসা যায়, নারীকে পুরুষের সমান মনে করা এবং সমঅধিকার বিষয়ে। মূলত এ দুটো ধারণা ত্রুটিপূর্ণ মনে করার মতো যথেষ্ট উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। কারণ, মানুষে মানুষে সমান হওয়ার সুযোগ নেই। কোনো পুরুষ যেমন অপর পুরুষের সমান নন, ঠিক তেমনিভাবে কোনো নারীও অন্য কোনো নারীর সমান হতে পারেন না। আর নারীকে পুরুষের সমতুল্য বা পুরুষকে নারীর সমতুল্য করার চিন্তা এক ধরনের বিকারগ্রস্ততা বলা যায়। কারণ, নারী-পুরুষ যে-ই হোন না কেন, তারা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা সত্তা। প্রত্যেকের অবয়ব, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তিত্ব, মেধা, মনন, কর্মতৎপরতা, যোগ্যতা, প্রজ্ঞা, রুচি-অভিরুচি, শক্তি-সামর্থ্য ও কর্মপরিধিও ভিন্নতর। তাই এক মানবসত্তা অপর মানবসত্তার সমান্তরাল হওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। আর সমঅধিকারের ধারণা তো আরো বেশি ত্রুটিপূর্ণ।
বিদগ্ধজনরা বলছেন, মানুষের অধিকার কখনো সমান হয় না। চাই সে পুরুষ হোক বা নারী। পৃথিবীতে যত মানুষ অধিকারও তত ধরনের। যে অধিকার পিতার রয়েছে, সে অধিকার সন্তানের নেই; পক্ষান্তরে যে অধিকার সন্তানের রয়েছে সে অধিকার পিতার নেই। একইভাবে মা-মেয়ের অধিকারও সমান নয়। মূলত নারী-পুরুষ সমঅধিকার তো দূরের কথা পুরুষে-পুরুষেও তো অধিকার সমান নয়। সঙ্গত কারণেই কোনো পুরুষ অফিসের ডিসি, অপর পুরুষ চাপরাশি। কেউ প্রধান শিক্ষক, কেউ সহকারী আর কেউ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। এরা প্রত্যেকেই পুরুষ বা নারী হলেও অভিজ্ঞান ও পদমর্যাদার কারণেই কর্মে, অধিকারে, দায়িত্বে ও মর্যাদায় এক ও অভিন্ন নন। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, সমঅধিকারের ধারণাটা ইতর প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারলেও মানুষের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ, পশুতে পশুতে কোনো স্তরবিন্যাস না থাকলেও মানুষে মানুষে স্তরবিন্যাস রয়েছে সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই। এটি অনিবার্য বাস্তবতা।
নারী অধিকার নিয়ে এই বিস্তর মতপার্থক্য ও রকমফেরের প্রেক্ষাপটেই ১৯১০ সাল থেকে আন্তর্জাতিকভাবে নারী দিবস পালিত হয়ে আসছে। গত ৮ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আমাদের দেশেও দিনটি পালিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠন বাণী দিয়েছে। জাতিসঙ্ঘ এ বছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্য করেছে, ‘আনি প্রজন্মের সমতা : নারী অধিকারের প্রতি সচেতনতা’। আর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়, ‘প্রজন্ম হোক সমতার, সকল নারীর অধিকার’।